মে দিবস ও শ্রমিকসমাজের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথা

Editor
4 Min Read

জুয়াইরিয়া হক মাহী


১৮৮৬ সালে শিকাগোর হেমার্কেট স্কয়ারে লক্ষাধিক শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে গুলিবর্ষণ হতে যে দিবস পালনের সূত্রপাত, তার কার্যকারিতা আজকের সমাজে কতটুকু?

তিক্ত সত্য হলো – পুঁজিবাদের শোষণ ও করাল গ্রাসে নিপতিত বিশাল জনগোষ্ঠীর মর্যাদা কেবল বাৎসরিক এক দিন ছুটির মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
দীর্ঘ কর্মঘণ্টা হ্রাসকরণ এবং ন্যায্য ছুটি, বেতন ও ভাতা প্রাপ্তি – এ সকল সাধারণ অধিকার নিশ্চিতকরণে অসমর্থ হওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন বৈ অন্য কিছু নয়। সাম্য ও মর্যাদা অর্জন দূরের কথা, মুষ্টিমেয় মুনাফাখোর জনতার স্বার্থ শ্রমিকগোষ্ঠীর ন্যায্য প্রাপ্তির পক্ষেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবু নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের শ্রমিকসমাজ অবদান রাখছে। কর্মসংস্থানের সংকটের ফলে সামান্য বেতনেই তুষ্ট থাকতে হচ্ছে, নতুবা অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নিম্ন মজুরির ফাঁদে পতিত কর্মী বাধ্য হয়ে অধিক সময় কাজ করছে। শ্রমিকের শ্রম ও কর্মঘণ্টা বৃদ্ধি পেলে মালিকেরই মুনাফার পরিমাণ বর্ধিত হবে। “কাজ নাই তো মজুরি নাই” – এ নীতিতে দেশে কোটি কোটি শ্রমিক বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে দেখা যায়। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবস কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রের উদযাপিত দিবস হিসেবে পরিগণিত। অথচ সারা বিশ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক মুনাফা ও মজুরির দ্বন্দ্বে শোষিত হওয়ার কারণেই এ দিবস তাদের সম্মানে ও হেমার্কেট ঘটনার প্রতীকী হিসেবে পালিত হয়।
ধনতন্ত্রের বণ্টনবৈষম্যের আগ্রাসনে নিপীড়িত শ্রমিকের চাহিদা অস্ফুটই রয়ে যায়। ফরাসি বিপ্লবের চেতনা শ্রমিকদের সেই অস্ফুটস্বরকে জোরালো করে তুলেছে। অথচ একবিংশ শতাব্দীতে এসে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকগোষ্ঠীর ‘ন্যায্য’ অধিকার আদায়ের পর্যায়েই পড়ে রয়েছে, জীবনযাত্রা উন্নয়ন ও বিভিন্ন সুবিধার ব্যবস্থা সৃষ্টিতে নয়। প্রতিবছর সরকারি হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা, আর্থিক সহায়তা কেন তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছাতে অক্ষম হয় এ বিষয়ে কাউকে জবাবদিহিতা করতে হয় না। নামেমাত্র সুবিধাদি প্রদান নজরদারির অভাবে প্রকৃত জনগোষ্ঠীর নিকট পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। আর শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামলে চাকরি থেকে ছাটাই হওয়ার হুমকি পায়।
কর্মপরিবেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্যতম এক প্রয়োজনীয়তা। তবু মালিকপক্ষের ঔদাসিন্যে নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতার ফলে রানা প্লাজা ধসের মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটার ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। করোনাকালে ঝুঁকি নিয়েই গার্মেন্টসকর্মীদের কার্যে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে। আবার, শ্রমখাতে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি বেকারত্বের সমস্যা ভয়াবহ করে তুলবে। আইএলও-এর মতে করোনা পরিস্থিতির ফলে বিশ্বজুড়ে ১৬০ কোটি শ্রমিক বেকারত্বের ঝুঁকিতে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও ঘরে ঘরে যেই গৃহকর্মীরা সাহায্য করছে তারা কি ছুটি পাচ্ছে? না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাচ্ছে না। যে বয়সে স্কুলের বইপত্র ঘাঁটার কথা সে বয়সের লাখো শিশু-কিশোর অতি অল্প মজুরিতে, পেটের দায়ে শ্রমে নিয়োজিত। আবার দারোয়ান ও ঝাড়ুদার শ্রেণি যখন বাৎসরিক ছুটি ভোগ করে, তখন আপনার পরিস্থিতি কেমন হয় ভেবে দেখুন। আপনার খাবারের প্লেটে অন্ন তোলার পেছনে যে বৃহৎ সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়োজিত, সে বিষয়ে ভেবে দেখুন। তিন দিন যাবৎ কেবল এ শ্রমিকগোষ্ঠীর সহায়তা ব্যতীত থাকুন, তাদের মর্ম টের পেতে অসুবিধা হবে না। তবে কেন মাটির মানুষ হওয়ার পরও হেয় চোখে দেখা, মর্যাদা না দেয়া?
প্রাচীন রোমের দাসপ্রথা হতে আধুনিক যুগের শ্রমিক শোষণ – উভয়ক্ষেত্রেই শ্রমিকসমাজকে হতে হয়েছে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। শ্রেণিভেদ কাটিয়ে সাম্য সৃষ্টি, শ্রমিকসমাজের প্রতি বঞ্চনার অবলুপ্তি কেবল বামপন্থী ও কমিউনিজমের দাবি নয়, বরং সর্বকালের ও সর্বস্তরের মেহনতি মানুষের “মানুষ” হিসেবে প্রাপ্য।

“সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে,/

এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে।”

কবির ভাষ্যে নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন শ্রমিকজনতার আপোষহীন সংগ্রাম একদিন পুঁজিবাদের আগ্রাসন, বণ্টনবৈষম্য, শ্রেণিবিভাজন কাটিয়ে সুদিন বয়ে আনবে।

তাই মহান মে দিবস উপলক্ষে দ্য ঢাকা অ্যাপোলোগের পক্ষ থেকে জানাই হেমার্কেট স্কয়ারের সেই শহীদদের এবং সমগ্র পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

 


লেখক টিডিএ-এর একজন সম্পাদক।  

 

Share this Article
Leave a comment