রাহিন আমিন
সাল ১৯১৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর প্রমথনাথ চৌধুরীর মাঝে প্রবল চিঠি চালাচালি চলছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
“সেই কাগজটার কথা চিন্তা করো। যদি সেটা চিন্তা করাই স্থির হয় তবে শুধু চিন্তা করলে হবে না – কিছু লিখ্তে শুরু করো। কাগজটার নাম যদি ‘কনিষ্ঠ’ হয় ত কি রকম হয়। আকারে ছোট – বয়সেও। শুধু কালের হিসাবে নয়, ভারের হিসাবে।”
কাগজটা মানে এক সাহিত্য পত্রিকার কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ। যেই পত্রিকা অকপটে বলে যাবে অপ্রিয় সত্য, যেই কাগজ দিয়ে যুগ যুগ ধরে চলা প্রথাগত বিশ্বাসে এবং চিন্তায় আঘাত হানতে পারবেন তিনি – উদ্দেশ্যে বোঝা গেল, একেবারে ‘ফ্রম দ্য হর্সেস মাউথ’।
নাম হিসেবে অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর ‘কনিষ্ঠ’ গ্রাহ্য হয় নি। ১৯১৪ সালের এপ্রিলে, ২৫ বৈশাখে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে প্রথমবারের মতো বেরিয়েছে ‘সবুজ পত্র’। সবুজ রঙটা যতটা না পাতার সবুজ, তাঁর থেকেও বেশি তারুণ্যের।
৭ই আগস্ট প্রমথ চৌধুরীর জন্মবার্ষিকী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকীও। অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হলো, প্রমথ চৌধুরী এবং তাঁর সবুজ পত্র পত্রিকা নিয়ে কিছু লিখতে হবে। কিন্তু কী নিয়ে লেখব? সবুজ পত্রের ইতিহাস কিংবা প্রভাব, সাহিত্যিক হিসেবে বাংলা গদ্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদান নাকি রবি-প্রমথ মানিকজোড়ের গল্প?
বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে, প্রমথ চৌধুরীর কাছে লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রায় ২০০ পৃষ্টার চিঠির সংকলন পড়ে, সাহিত্য বিশারদদের নানা কথা শুনে বোঝা গেল, প্রমথ, সবুজ পত্র এবং রবীন্দ্রনাথকে একে অন্যের থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। তাহলে অপর দুটির দাম বেশ খানিকটা কমে যায়। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া তো সবুজ পত্রের অস্তিত্ব-ই স্বীকার করা কঠিন। সবুজ পত্রেরও বেশ খানিকটা প্রভাব আছে আমাদের কবিগুরুর উপর। সবুজ পত্র ছাড়া তাঁর শেষ জীবনের সাহিত্যিক সৃষ্টিগুলো কেমন হতো, তা কল্পনা করা বেশ দুষ্কর।
০১.
প্রমথ চৌধুরীকে নিয়ে একটু ঘেঁটে দেখতে গিয়ে ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি সামনে এলো বিসিএসের গাইড। এক ফেসবুক পেইজে দেখা গেল প্রমথ চৌধুরীকে নিয়ে এক বাক্যে প্রশ্ন-উত্তরের লিস্ট পোস্ট করা হয়েছে।
একটি প্রশ্ন এমন: “জীবনে জ্যাঠামি এবং সাহিত্যে ন্যাকামি কে সহ্য করতে পারতেন না?”
বিসিএসের গাইড হতে পারে। কিন্তু অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও প্রমথ চৌধুরীকে ওমন দারুণভাবে এক বাক্যে প্রকাশ করেছে, এমন কিছু আর পাওয়া গেল না। প্রমথ চৌধুরী তো আসলে এটাই ছিলেন, এমনই ছিলেন। স্পষ্ট। নির্মোহভাবে বলে যেতে পারতেন অপ্রিয় সত্য। ভাবতেনও একইভাবে। তাঁর চিন্তা-চেতনায়, কথাবার্তায় কখনো কোনো মেদ দেখা যায় নি। আড়ম্বরবিহীন তাঁর এই জীবনের মতাদর্শ আসলে তাঁর সাহিত্য থেকে নিজস্ব জীবনের সব জায়গায় বিস্তৃত। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, সাধু ভাষাকে বাদ দিয়ে চলিত ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দেয়ার তাঁর যেই আন্দোলন, সেই আন্দোলনও আসলে একই আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত।
প্রমথ চৌধুরী যখন সরকারি চাকরি বাদ দিয়ে প্রথম লেখালেখি শুরু করেন, তখন বাংলা সাহিত্যের চিন্তাধারা আজকের বাংলা সাহিত্যের রূপের থেকে অনেক ভিন্ন ছিল। কতটা ভিন্ন সেটা ঠিক কয়েক বাক্যে বুঝিয়ে বলা কঠিন। তবে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তখনকার অন্যতম প্রচলিত বিশ্বাস ছিল এই যে, যৌবন কিংবা তারুণ্যকে আসলে শাসনে রাখতে হয়। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।
প্রমথ চৌধুরী প্রথমবারের মতো লেখলেন, যৌবনকে শাসন নয়, রাজতিলক দিয়ে রাজার আসনে বসিয়ে রাখতে হবে। তিনি দেখালেন, আমাদের প্রাচীন সাহিত্য এবং বিশ্বাস যৌবনের ভোগবিলাসী রূপ সামনে এনে তাঁকে দমিয়ে রাখতে চায়, কারণ যৌবনকে আমরা ভয় পাই। যৌবনকে আমরা ভয় পাই, কারণ তাঁর ভেতরে সবকিছু উল্টেপাল্টে দেয়ার ক্ষমতা আছে।

সম্ভবত ঠিক এই উল্টেপাল্টে দেয়ার ক্ষমতার জন্যেই তিনি যৌবনকে এতটা পূজা করতেন। প্রমথ নিজেও কি তাই যৌবনের জলজ্যান্ত প্রতিমা ছিলেন না? বাংলা সাহিত্যে তিনি এসেছিলেন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া বানের জলের মতো এবং ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেনও। কোনো কিছুই তাঁকে আটকাতে পারে নি। যা মনে এসেছে, যা মনে করেছেন বলা দরকার, মানুষের চোখের দিকে চোখ রেখে অকপটে ঠিক তা-ই বলে গেছেন। একেবারে ‘ফিল্টারলেস’।
সবকিছু বাদ দিয়ে হলেও প্রমথ ঠিক এই জায়গায় এসে তাঁর মতাদর্শের কারণে একেবারেই আলাদা হয়ে যান। প্রমথ সেই ধূমকেতুর নাম, যার ঔজ্জ্বল্য চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করে। কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিলেও মনের মাঝে তাঁর প্রভাব থেকে যায় অনেক, অনেক দিন।
প্রমথ চৌধুরীর এই মেদহীন লেখার ধরন, কিংবা আপাদমস্তক ভাবাদর্শের সর্বপ্রথম এবং বোধহয় সর্ববৃহৎ ভক্তদের একজন ছিলেন আমাদের রবি ঠাকুর। তাঁর চিঠিতে প্রমথের গদ্য এবং সাহিত্যের পরিষ্কার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। ১৮৯৩ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রমথকে লিখছেন,
“তোমার গদ্য প্রবন্ধ সবগুলিই পড়েছি। তোমার কবিতাঁর যে গুণ তোমার গদ্যেও তাই দেখি- কোথাও ফাঁক নেই এবং শৈথিল্য নেই, একেবারে ঠাসবুনানি। এ গুণটি কিন্তু প্রাচ্য নয়। আমাদের বেশে ভুষায় বাক্যে এবং চিন্তাতেও অনেকটা বাহুল্য থাকে- গরম দেশে অত্যন্ত নিরেটভাবে মনঃসংযোগ করাটা দুঃখকর। কেননা এখানে কাজের তুলনায় অবকাশটা একটু প্রচুর না হলে আমরা বাঁচিনে।”
আরেক চিঠিতে তিনি প্রমথের সনেট পঞ্চশৎ-কে ইস্পাতের ছুরির সাথে তুলনা করছেন। বলছেন, বাংলার সরস্বতীর বীণায় প্রমথ যেন ইস্পাতের তাঁর চড়িয়ে দিয়েছেন। কখনো তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছেন প্রমথ বাংলার সাহিত্য-সিংহাসনে রাজদন্ড গ্রহণ করে শাসনভার নিবে, আবার একই সাথে বলছেন, এ দেশের পাঠক এখনো তাঁর লেখা নিতে প্রস্তুত নয়।
০২.
প্রমথ চৌধুরীর এই ফিল্টারবিহীন জীবনযাপনের মতাদর্শ থেকেই খুব সম্ভবত সবুজপত্রের জন্ম। বলা যেতে পারে, প্রমথের বিশ্বাসের ফুল বসন্তের ছোঁয়া পায় সবুজপত্রের মাধ্যমে। তবে সবুজপত্রের মতো একটি পত্রিকা তৈরির চিন্তাটা খুব সম্ভবত প্রথম এসেছিল মণিলাল বন্দোপাধ্যায়ের মাথায়। ত্রৈমাসিক ‘পরিচয়’ পত্রিকার ১৩৩৮ সালের (১৯৩১ ইং) কার্তিক সংখ্যায় রবি ঠাকুর জানান, মণিলাল তাঁর কাছে এসেছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্য নির্ভর একটি পত্রিকার ব্যাপারে কথা বলতে। চিন্তাটা তাঁর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল, কিন্তু নিজে সেই দায়িত্ব নিতে পারবেন না বলে প্রমথকে সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যে পত্রিকার কথা চিন্তা করেছিলেন, সেই পত্রিকার উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের মর্মে আঘাত দেয়া। সেটা করতে প্রমথের থেকে ভালো আর কে হতে পারবেন? রবীন্দ্রনাথ প্রমথকে দায়িত্ব নিতে বলার পর প্রমথ যে নিজের ভাবাদর্শ মতেই তাঁর পত্রিকা গড়ে পিটে নিয়েছিলেন, সেটার প্রমাণ তো আসলে সবুজ পত্র নিজেই। সহ-সম্পাদকের দায়িত্বটা পান আরেক সাহিত্যিক সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী।
‘সবুজ পত্র’ শুরুতে রীতিমত বিপ্লবী হিসেবে দেখা দেয়। সব প্রাচীন মরচে ধরা বিশ্বাস এবং জঙ পড়া নিয়মকে মুখের উপর না বলে দিয়ে সবুজপত্রের যাত্রা শুরু। প্রথম পদক্ষেপ, সাধু ভাষাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাংলা কথ্যভাষাকে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যে স্থান দেয়া। তখন এটা রীতিমত ব্লাসফেমির সামিল।
কেন, সেই গল্পটা একটু বুঝিয়ে বলা যাক।
তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে সাধু ভাষার গোড়াপত্তনটা অনেক শক্ত ছিল। দিনের পর দিন সেই ভাষায় গদ্য সাহিত্য রচনা হয়েছে। গদ্য বাংলা ভাষায় এসেছে বিদেশীদের হাত ধরে। ফোর্ট উইলিয়ামস কলেজের অধ্যাপকরা বাংলায় গদ্য সাহিত্যের প্রথম প্রচলন ঘটান, এবং তার পুরোটাই সাধু ভাষায়। বাংলা সাহিত্যের ভাষা কেমন হবে, তার তাত্ত্বিক দিকটাও তখন পুরোপুরি-ই ফোর্ট উইলিয়ামসের উপর নির্ভরশীল।
সাধু ভাষায় সাহিত্য রচনার পিছে যেই আদর্শ কাজ করত, তা মূলত আভিজাত্য। তখন মনে করা হতো, সাহিত্যের কাজ মূলত সৌন্দর্য সৃষ্টি। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন নতুন লেখকদের প্রতি লিখেছেন,
“যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গলসাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারেন, তবেই লিখিবেন।”
তার মানে এই — সাহিত্য মানেই অভিজাত সৌন্দর্য সৃষ্টি কিংবা মঙ্গলসাধনের জন্য। যারা ওই দুটি উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবেন না, তাদের সাহিত্য রচনার কোনো অধিকার নেই। সাহিত্যে তাই গণমানুষের কোনো জায়গা নেই। এবং সে কারণেই তখন সাধু ভাষার এত প্রচলন, কারণ তা অভিজাত। যাদের জীবনজুড়ে কথ্য ভাষা-ই একমাত্র অবলম্বন, তাদের সাহিত্যে কোনো স্থান নেই।
সাহিত্য তখন কোনো আলাদা গ্রহের নাম, এবং কবিরা গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন সেই গ্রহের বসবাসকারী।
কিন্তু আস্তে আস্তে সাধু ভাষার সাহিত্য রচনা নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন উঠতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেখা যায়, অত্যন্ত কৃত্তিম এই ভাষায় সাহিত্য রচনা কতটা যৌক্তিক কিংবা সাহিত্যকে কোনো নিয়মের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা উচিত কি না — এসব প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অনেকেই।
১৯০১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এক সেমিনারে প্রথমবারে মতো দাবি উঠল কথ্যভাষাকে সাহিত্যে স্থান দেয়ার। দাবিটা উঠালেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। সেই সভায় বাঙলা কৃৎ এবং তদ্ধিত প্রত্যয় নামক এক প্রবন্ধ পাঠ করেন তিনি। সাধু ভাষা-চলিত ভাষার বিপুল তর্ক বিতর্কটার শুরু সম্ভবত ওইদিন থেকেই। এরপর একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্র শঙ্কর ত্রিবেদীর মতো সাহিত্য বিশারদরা, আরেক দিকে শরৎচন্দ্র শাস্ত্রী, বীরেশ্বর পাঁড়ে এবং সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণের মতো কট্টর সাধুভাষা পন্থীদের মধ্যে তর্ক চলেছে অনেকদিন।
এর প্রায় দেড় দশক পড়ে সবুজ পত্রের শুরুটা ঠিক সাহিত্যের এই আভিজাত্যের সংজ্ঞাকেই ঢাক্কা দেয়। তখন সাহিত্য অঙ্গনে সাহিত্য সাময়িকীগুলো দারুণ প্রভাবশালী। এবং সাধারণত বড় বড় সাহিত্যিকরাই এই সাময়িকীগুলোর সাথে জড়িত থাকতেন। অন্য সব সাহিত্য সাময়িকী যখন সাধু ভাষায় কাজ করছে, সবুজ পত্রে কথ্যভাষাকে স্থান দেয়া তখন হয়ে দাঁড়ায় কথ্যভাষার প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির মতো।
শুধু কথ্যভাষা নয়। সবুজ পত্র এসেছিল সাহিত্যে আপামর বদল আনতেই। প্রথম সংখ্যার মুখবন্ধেই প্রমথ চৌধুরী সাহিত্য নিয়ে তাঁর আদর্শ মানুষের কাছে প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সাহিত্যের কাজ সমাজ বদল কিংবা সৌন্দর্য সৃষ্টি নয়। সাহিত্যের কাজ বরং মানুষের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের প্রকাশ এবং বিকাশ।
শুরুতেই তিনি অকপটে স্বীকার করে নেন, আমাদের সাহিত্যে নতুন স্বাদ আনার কৃতিত্বটা ইউরোপের। যা সে সময়ের তুলনায় দারুণ সাহসী বক্তব্য। তিনি এ-ও জানিয়ে দেন, এখন যদি আমরা সেই ইউরোপের ভাবনার বীজ আমাদের দেশীয় মাটিতে রোপন না করতে পারি, তাহলে আমাদের সাহিত্য এগোবে না কখনোই।
বর্তমান শিক্ষার গুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে, মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্যকে ‘পরগাছার ফুল’ অ্যাখা দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দেন, সবুজ পত্র এক নতুন যুগের সূচনা করতে এসেছে।
০৩.
একই উদ্যোগ অবশ্য শুধুই সবুজ পত্র নিয়েছিল, এমনটা বলা যাবে না। সুকুমার রায়ের ‘সন্দেশ’-ও উদ্যোগ নিয়েছিল কথ্যভাষায় সাহিত্য প্রকাশের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলা গদ্যে চলিত ভাষার প্রচলন ঘটানোর কৃতিত্বটা যে সবুজ পত্রের, তাঁর কারণ মূলত দুটি।
প্রথমত, চলিত ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দেয়ার জন্যে যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা এই ভাষার একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি। যেটা সবুজপত্রের আগে এতটা জোরেশোরে আর দেখা যায় নি। রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন, কিন্ত সবুজ পত্র তাঁকে গতি এনে দিয়েছে।
বাংলার একটি আলাদা ব্যকরণ গড়ে তোলার জন্য প্রমথ তাঁর সবুজ পত্র দিয়ে ক্রিয়া, প্রত্যয় এবং পরিভাষা নিয়ে কাজ করাসহ আরো অনেক কিছুই করেছেন। এই তাত্ত্বিক ভিত্তি বাংলা ব্যকরণ কে তাঁর সংস্কৃত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। বাংলা সাহিত্যে এবং কথ্যভাষায় তৎকালীন যেই ভাষার ব্যবহার দেখা যেত, সেই ভাষার একটা ব্যকরণভিত্তিক রূপরেখা তৈরি করার পিছে অসাধারণ অবদান আছে সবুজপত্রের। এখানে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ পরে বাংলা ব্যকরণের রূপরেখা তৈরিতে কাজে এসেছে। সে কারণেই বোধহয় সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে ভাষাবিজ্ঞানী বলেছিলেন।
সবুজ পত্রের সেই উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় প্রায় ১০০ বছর পরে, ১৯১২ সালে। যখন সংস্কৃত ব্যকরণ থেকে আলাদা হয়ে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যকরণ বইয়ে চলিত বাংলা ভাষার ব্যকরণকে স্বীকৃতি দেয় দুই বাংলা।

দ্বিতীয় কারণটা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অকপটে স্বীকার করে নিতেই হয়, রবীন্দ্রনাথের সাহায্য ব্যতিত শুধু প্রমথ যদি সবুজ পত্রের হাল ধরতেন, তবে মাত্র ১৩ বছরের জীবদ্দশায় সবুজ পত্র কখনোই বাংলা সাহিত্যকে এতটা নাড়া দিয়ে যেতে পারত না। প্রমথ তাঁর নিজের কাজ যথাযথ যোগ্যভাবে পালন করেছেন সেটা যেমন সত্যি, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তাঁর কাজের স্বীকৃতি তিনি সম্ভবত কখনোই পেতেন না, সেটাও সত্যি।
কেন পেতেন না, সেই বিশ্লেষণ করতে হলে একটু সেই সময়ে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। প্রমথের সবুজ পত্রের হাল ধরার আগে খুব বেশি সাহিত্য রচনার অভিজ্ঞতা নেই। যতটুকু করেছেন, তাও মানুষ নিতে পারে নি। কেন পারে নি, তা রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতে স্পষ্ঠ।
“তোমার এসব লেখা যে লোকে সত্যই পছন্দ করচে না এ আমি বিশ্বাস করতে পারিনে। একরকম জাতের ভালো লেখা যা আছে পড়তে পড়তে পদে পদে এই কথাটা মনে আসে যে এ আমি ভাবিনি, এ আমার মাথায় আসত না, এ আমার কলমে আসা সম্ভব নয় – সেইরকম ঐশ্বর্য্যশালী লেখাকে পাঠক অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত অস্বীকার করতে চেষ্টা করে – এইরকম লেখার কাছে পাঠকদের মন পরাভব মানতে কষ্ট এবং লজ্জা বোধ করে। আমি বেশ দেখতে পাচ্চি তোমার লেখাগুলিতে একটা ঈর্ষ্যা জাড়িয়ে তুলেছে – সেটা প্রশংসাফলেরই কাঁচা এবং টেকো অবস্থা – ঐটে নিশ্চয়ই ক্রমে আলোয় বাতাসে পাক্বে এবং মিষ্টতায় ভরে উঠবে।”
মূল কথা হলো, প্রমথ যেভাবে লিখতেন, সেটাকে ঠোঁটকাটা বললেও কম বলা হয়। আড়ম্বর-অলঙ্কারের পিছে না লুকিয়ে তাঁর এই স্পষ্ট কথা বলার অভ্যসটাই মানুষের মনের দরবারে তাঁকে স্থান করে নিতে দেয় নি। পাঠক তাঁর প্রবন্ধসমূহে অকপটে বলে যাওয়া অপ্রিয় সহজে সত্য হজম করতে পারে নি।
তাই সে সময়ের ভাষা বিশারদরা শুধুমাত্র প্রমথ থাকলে সবুজ পত্রের কথা যে আমলে নিতেন না, সে কথা আসলে সহজেই বোঝা যায়। সবুজ পত্রকে পাত্তা দিতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন, তার কারণটা রবীন্দ্রনাথ। তিনি তখন তাঁর সাহিত্য ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। মাত্রই নোবেল পেয়ে সারা বিশ্বে তুমুল তিনি জনপ্রিয়। লেখক সমাজে প্রমথের গ্রাহ্যতার অভাব নিজের নাম দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
০৪.
সমালোচনাও কম হয় নি। যেকোনো পুরাতনের বিরুদ্ধে নতুনের লড়াইয়ে যা যা দেখা যায়, তাঁর সব-ই দেখা গিয়েছে এখানেও। বাংলা ভাষার ‘শুদ্ধতা’ নষ্ট করছেন, এই অভিযোগে সবুজপত্রের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত জনতাঁর সংখ্যা কম ছিল না। শুধু সবুজ পত্রকে ছাড়িয়ে প্রমথ নিজেও হয়েছেন হাসি-ঠাট্টা-সমালোচনার শিকার।
সবুজ পত্রে কথ্যভাষাকে স্থান দেয়া মেনে নিতে পারে নি অনান্য সাহিত্য পত্রিকা। মানসী পত্রিকা দারুণ বিরোধিতা শুরু করে সবুজ পত্রের আদর্শের। সবুজ পত্র বের হওয়ার কিছুদিন পরেই বের হওয়া শুরু করে চিত্তরঞ্জণ দাস সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ পত্রিকা, যারা শুরু থেকেই সবুজ পত্রের আধুনিকতার বিরোধীতা করে গেছে। ‘নারায়ণ’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক, প্রাবন্ধিক এবং রাজনীতিবিদ বিপিনচন্দ্র সেনের সাথে সে সময় এক ধরণের পরোক্ষ বিরোধও শুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, মূলত সবুজ পত্রকে ঘিরেই।
কথ্যভাষার ব্যবহার ছাড়াও সবুজ পত্রের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে বোধহয় রবীন্দ্র নির্ভরতা নিয়ে। সবুজ পত্রের প্রথম বর্ষের চতুর্থ সংখ্যা যখন শুধু রবীন্দ্রনাথের লেখা দিয়ে সাজানো হলো, তখন মানসী পত্রিকার মন্তব্য:
“এবারের সবুজ পত্রের নূতনত্ব আছে – লেখক একা রবীন্দ্রনাথ, সম্পাদক মুখপত্রে নামাবশেষ হইয়াই আছেন। সেদিন একজন বন্ধু বলিতেছিলেন, সবুজ পত্রের এমন সম্পাদক আমিও হইতে পারি , কিন্তু মুখপত্রে নামটি ছাপিতে রাজী নই।”
রবীন্দ্রনাথ শুধু লিখে নয়, সবুজ পত্রকে আরো নানাভাবে সাহায্য করতেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখার সম্পাদনা করেছেন তিনি। দেশে বিদেশের নানা সাহিত্য অঙ্গনে সবুজ পত্রের সংখ্যা পাঠিয়ে, সবুজ পত্রের জন্য বিভিন্ন সমমনা লেখকদের লিখতে অনুরোধ করে, লেখক খুঁজে দিয়ে সবুজ পত্রকে সফল বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বিশ্বকবি।
ঠিক এই কারণেই অনেক সাহিত্য বিশারদরা মনে করেন, সবুজ পত্র আদতে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি, প্রমথ তাঁর হাতের পুতুল হিসেবে ছিলেন শুধু। পবিত্র বন্দোপাধ্যায় যেমন মন্তব্য করেছিলেন, “সবুজপত্রের রাজা রবীন্দ্রনাথ, সামন্ত প্রমথ চৌধুরী।”
তবে রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথের চিঠিপত্র ঘেঁটে এই কথার সাথে একমত হওয়া একটু মুশকিল। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের উপর নির্ভরশীলতা ছিল বটে, কিন্তু তাতে প্রমথের অবদান কোথাও ছোট হয়ে গেছে, এমনটাও বোধহয় নয়। রবীন্দ্রনাথ সবুজ পত্রকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন, কিন্তু দিন শেষে এই সাময়িকীর জাজ, জুরি এবং এক্সিকিউশনার প্রমথকেই বলতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ সবুজ পত্রে নানা লেখা পাঠানোর পর আবার চিঠিতে লিখেছেন, প্রমথের ভালো না লাগলে সেই লেখা বাদ দিয়ে দিতে। অনেক জায়গায় লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের ভুলগুলো যাতে প্রমথ সম্পাদনার সময় নিজের মতো করে শুধরে নেন।
বরং এই রবীন্দ্র নির্ভরতাকে সবুজ পত্রের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আলাদা মমতার নির্দশন হিসেবে দেখা যেতে পারে। প্রমথ এবং সবুজ পত্রের সম্পাদনার সাথে জড়িত মানুষেরা যখনই কিছুর কমতি বোধ করেছেন, দু’হাত ভরে দিয়ে তা মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন রবি ঠাকুর। গ্রাহ্যতার বিষয়টা তো আগেই বললাম, এছাড়াও, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখক স্বল্পতায় ভুগেছে সবুজ পত্র। সেই কারণেই বোধহয় যতটুকু পেরেছেন, লিখে সবুজ পত্রকে আরো সবুজ বানানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ যে অন্যসব পত্রিকায় লেখালেখি প্রায় বাদ দিয়ে সবুজ পত্রে নিজেকে এক অর্থে সমর্পন করে দেন তাঁর কারণ তিনি মনে করতেন, সবুজ পত্র একটি উদ্দেশ্য সাধনে জন্ম নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই অনেক জায়গায় বলেছেন, তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে প্রয়োজনীয় বদল আনার জন্যে সবুজ পত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কথ্যভাষার ব্যবহার এবং রবীন্দ্র নির্ভরতা ছাড়াও সবুজপত্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল বানান ভুল নিয়ে। প্রচুর ছাপার ভুল দেখা যেত, যা নিয়ে প্রমথনাথ একেবারেই চিন্তিত ছিলেন না। তাঁর মতে, কিছু বানান ভুল পাঠক নিজেই ঠিক করে নিতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বরাবরই বলে গেছেন, বানান ভুল ঠিক না করলে কাগজের শ্রী বৃদ্ধি হবে না।
০৫.
রবীন্দ্র নির্ভরতার কারণ হিসেবে যেই লেখক স্বল্পতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, শেষ পর্যন্ত যে সবুজ পত্র মাত্র ১৩ বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে গেল, তার অন্যতম কারণও সেই লেখক স্বল্পতা।
প্রমথ এবং রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সবুজ পত্র শুরু করেছিল সত্যন্দ্রনাথ দত্ত, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের হাত ধরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্য ছিল, সবুজ পত্রের মাধ্যমে প্রমথ ঘরানার একটি আধুনিক লেখক গোষ্ঠী তৈরি করবেন তিনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বহুদিন চেষ্টা করেও সবুজ পত্র কখনোই এই শুরুর পাঁচ-ছয় জনের বাইরে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো লেখক পায় নি। এবং এই লেখকের অভাবেই অনেক সময় এক-দুই মাস করে বন্ধ থেকেছে সবুজ পত্র, মাঝে বের হয় নি প্রায় তিন মাস।
ঠিক এই কারণেই অনেক অনেক দিন একা হাতে লগি ঠেলতে হয়েছে প্রমথকে, সঙ্গ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। মাঝে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় প্রমথ এবং রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক অবস্থা। দুজনেই তখন ক্ষয়িষ্ণু ঠাকুরবাড়ির জমিদারির বড় অংশ। দিনে দিনে ঠাকুরবাড়ির জমিদারির অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এবং সবুজ পত্র যেহেতু কমার্শিয়াল পত্রিকা ছিল না, তাই সেখান থেকেও তেমন কোনো টাকা আসে নি।
একটা সময় গিয়ে দেখা গেল, লেখকহীন সবুজ পত্র সামলানোর অবস্থা আর্থিকভাবে ভঙ্গুর প্রমথ চৌধুরীর আর নেই। যেই বাড়িতে সবুজ পত্রের আড্ডা বসত, প্রমথের বাইট স্ট্রিটের সেই বাড়িটা বিক্রি করে দেয়ার পরই নটে গাছটি মুরোয় সবুজ পত্রের। কিন্তু তাতে কী? সবুজ পত্র তো তত দিনে তার উদ্দেশ্যে সফল।
সমালোচনা আরো একটি ছিল। তবে এটিকে সমালোচনা বলা যায় না কি সন্দেহ। বরং ইংরেজিতে ‘আইরনি’ বলা যেতে পারে। বাংলায় পরিহাসের পাশাপাশি অনেকটা প্রহসনও বলা যায়।
প্রমথ চৌধুরীর চিন্তাভাবনা আজীবন গণমানুষ কেন্দ্রিক ছিল, আভিজাত্যের বিরুদ্ধে ছিল। সাধু ভাষা বর্জিত তাঁর সাহিত্যিক আদর্শের কেন্দ্রেই ছিল সব ধরনের মানুষের নিজস্ব মানসিক বিকাশ। কিন্তু যেই গণমানুষের জন্য তিনি ভেবেছিলেন, সেই গণমানুষের ‘গণ’ অংশটি-ই তাঁর চিন্তাভাবনা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই সমাজের সব ধরণের মানুষের সাথে সাহিত্যকে মিশিয়ে দিতে চাইলেও তাঁকে সবসময়ই নতুন দিনের অভিজাত চিন্তাধারার অধিকারী মনে করা হয়েছে। ‘নতুন দিনের’ প্রমথ চৌধুরী সেই যুগে কখনোই গণমানুষের হয়ে উঠতে পারেন নি। সেই দোষটা বোধহয় যত না প্রমথের, তাঁর থেকে বেশি আমাদের সমাজের।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, তাঁর মৃত্যুর পরে ৭০ বছরের বেশি সময় কেটে গেছে, প্রমথ চৌধুরী কিন্তু এখনও ‘নতুন দিনের’-ই আছেন।