নারীপক্ষ, এদেশের নারীবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত প্রবীণতম সংগঠনগুলোর মাঝে একটি। নারীপক্ষ মূলত একটি সদস্যপদভিত্তিক মহিলা কর্মী সংস্থা। ১৯৮৩ সালে যখন এ সংস্থার জন্ম, তখন নারী অধিকার কী সেটাই এদেশের মানুষ জানত না। তখন থেকেই নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রযাত্রার জন্য কাজ করে আসছে নারীপক্ষ। নানা ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে।
এই সংস্থাটির পূর্বকথা, চলমান বিভিন্ন কার্যক্রম, ভবিষ্যত লক্ষ্য ইত্যাদি নিয়ে নারীপক্ষ-এর প্রোজেক্ট ডিরেক্টর রওশন আরার সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য ঢাকা অ্যাপোলগের ডেপুটি ম্যানেজিং এডিটর ফাতিন হামামা। সেই আলোচনার কিছু নির্বাচিত অংশ দেয়া হলো এখানে।
ফাতিন: মিস রওশন, আশির দশকে যখন নারীপক্ষ-এর যাত্রা শুরু, তখন এই উপমহাদেশে নারীবাদ কিংবা এ সম্পর্কিত সাংগঠনিক কার্যক্রম বলতে গেলে দেখাই যেত না। সেই প্রতিকূল সময়ে নারীপক্ষ-এর মতো একটি দারুণ সংগঠন গড়ে তোলার পেছনের গল্পটি কী ছিল?
রওশন আরা: ১৯৮৩ সালে যখন নারীপক্ষ-এর যাত্রা শুরু হয়, তখন এর মূল প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মাঝে ছিলেন শিরীন হক, ফরিদা আক্তার এবং আরো দুজন এমন নারী, যারা তরুণ বয়স থেকেই নারী অধিকার, নারী আন্দোলন ও নারীর প্রতি বৈষম্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে খুব ভাবতেন। এই চিন্তা ও পরিবর্তন সৃষ্টির মানসিকতা থেকেই তারা একত্রিত হয়ে নিজেদের মাঝে আলোচনা শুরু করলেন এবং ক্রমান্বয়ে এই আলোচনা রূপ নিল নিয়মিত বৈঠকে।
অবশ্য প্রথমদিকে তাদের সাংগঠনিক কোন পরিকল্পনা ছিল না। প্রতিষ্ঠাতারা শুধুই চেয়েছিলেন বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থান—সকল পার্থক্যভেদে নারীদের এমন একটি জায়গা করে দিতে, যেখানে তারা নির্বিঘ্নে তাদের অব্যক্ত কথাগুলো বলতে পারবে। যেখানে তারা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারবে নিজেদের। সেই সময়ে নারীদের নিয়ে কাজ করত এমন খুব বেশি সংস্থা ছিল না। যারা ছিল তাদেরও নারী অধিকার বা ক্ষমতায়ন নিয়ে তেমন কোনো দূরদর্শী লক্ষ্য কিংবা উদ্যোগ ছিল না।
তাই নারীপক্ষ একদম শুরু থেকেই অন্যরকম একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল। আমার মনে হয়, এখনো আছে।
ফাতিন: নারীপক্ষ মূলত কোন লক্ষ্যে গড়ে উঠেছিল? সময়ের সাথে এদেশে যে বদলগুলো এসেছে, মূলত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কিংবা অবকাঠামোতে, সেই পরিবর্তনগুলোর সাথে কি আপনাদের সেই লক্ষ্যগুলোও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে?
রওশন আরা: সত্যি বলতে কী, যে মূল উদ্দেশ্যগুলো মাথায় রেখে আমাদের এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল, সেগুলো এখনও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। প্রতিটি নারীর জীবন, প্রতিদিনের বঞ্চনার প্রেক্ষাপটই নারীমুক্তি আন্দোলনে উপাত্ত হবে। নারী তার দৈনন্দিন জীবনের দাবি, নিজের অবস্থান পর্যালোচনা করে মুক্তির কৌশল নির্ধারণ করবে; এই ছিল নারীপক্ষের যাত্রার মূলমন্ত্র। নারীপক্ষ বিশ্বাস করে— নারী তার কথা বলবে, তার মত করেই বলবে, নিজের ভাষায় বলবে।
আমাদের কাছে প্রথম থেকেই নারী মুক্তি আন্দোলনে দুটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে, তা হল— নারীর উন্নয়নের ইস্যুটি তার অধিকার আদায়ের লড়াই, সুতরাং আমাদের দায়িত্ব শুধু কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছাও; এবং শিক্ষা, বিত্ত, ধর্মচর্চা, রাজনৈতিক অবস্থান বা পেশাভেদে সকল নারীর অবস্থান এক। আমরা বিশ্বাস করি, সামাজিক পরিচিতির ঊর্ধ্বে, নারী আগে মানুষ।
নারীপক্ষ পরিবার, সমাজ, ও রাষ্ট্রে অধিকার সম্পন্ন নাগরিক এবং মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। এ সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয় ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে পাঁচটি বিষয় নারীপক্ষের প্রধান কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, যথা—নারীর উপর সহিংসতা রোধ ও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর স্বাস্থ্য ও প্রজনন অধিকার, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন।
প্রথমদিকে আমরা এরকম যেসব ক্ষেত্র নির্ধারণ করে নিয়েছিলাম, সেগুলো থেকে কিন্তু এখনো সরে আসি নি। সেগুলো নিয়ে এখনো কাজ চালিয়েই যাচ্ছি। সময়ের সাথে কাজের ধারায় নানা বৈচিত্র্য এলেও, নারীপক্ষের মৌলিক উদ্দেশ্যগুলো এখনো অপরিবর্তিত।
ফাতিন: উল্লেখিত কোনো একটি ক্ষেত্রে আপনাদের কাজের ধারার যেকোনো একটি উদাহরণ দেয়া যাবে?
রওশন আরা: অবশ্যই। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা আইন, নারী নির্যাতন আইন—এমন আইনসমূহের অন্তর্ভুক্ত কিছু অবিশ্বাস্য অংশ পরিবর্তনের জন্য নারীপক্ষ কাজ করেছে।
‘৯৬-‘৯৭ সালের দিকে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে আমরা একটি গবেষণা করি, যেখানে আমরা প্রথমে নানা পত্রিকা থেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করি। সহিংসতার শিকার নারীদের প্রাপ্য বিচারের জন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে হয়। যেমন: হাসপাতাল ও আদালত। এইসব প্রতিষ্ঠানে তাদের অভিজ্ঞতা শুনে, পত্রিকা এবং মিডিয়া থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের পরে আমরা বুঝলাম যে ওই সময়ে এসব জায়গায় সাহায্যপ্রার্থী নারীদের সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হতো।
এসব নিয়ে পরে আমরা সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলি, পুলিশ এর আইজির অফিসারের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হই যে নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কিত সকল ঘটনা নিয়ে আমাদের সংগঠন প্রতি সপ্তাহে প্রতিবেদন পাবে—যেগুলো নিয়ে আমরা নিয়মিত বৈঠকে বসব। ধীরে ধীরে নারীপক্ষ যখন এই মেকানিজমটা দাঁড় করে ফেলতে সক্ষম হলো, তখন আমরা অন্যান্য সংস্থাকেও এটি জানাই, আমাদের সাথে কাজ করতে বলি এবং আস্তে আস্তে পুরো দৃশ্যটাতেই একটা বদল আসে।
ফাতিন: আমাদের দেশে, বিশেষত নারীবাদী সংগঠনগুলোকে চলার পথে অনেক সমালোচনা, বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। নারীপক্ষকেও নিশ্চয়ই এসবের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আপনারা কিভাবে এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিজেদের আজ এই অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন?
রওশন আরা:
নারীপক্ষ সংগঠন হিসেবে ফাঁসির বিপক্ষে, কেননা আমাদের মনে হয় এটি মানবাধিকারবিরোধী কাজ। ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে শারমীন রীমার হত্যাকে কেন্দ্র করে, অভিযুক্ত রীমার স্বামী, মুনীর হোসেনকে ফাঁসির দাবিতে সবাই যখন সোচ্চার, তখন নারীপক্ষ মৃত্যুদন্ড দাবির প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিল, রীমা হত্যার ন্যায্য বিচার চেয়েছিল। নারীপক্ষের বিশ্বাস, অপরাধ যতই গুরুতর হোক না কেন, মৃত্যুদন্ড রাষ্ট্র দ্বারা হত্যার শামিল। এর দ্বারা কখনো অপরাধ দমন হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। জীবনের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার, এবং মৃত্যুদন্ড এই মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক। অন্যায়ের জন্য আমরা অবশ্যই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ দাবি করি, তবে ফাঁসি নয়। এজন্য আমাদের অনেক সময়ই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
১৯৯০ সালে নারায়নগঞ্জের টানবাজার যৌনপল্লী উচ্ছেদে ক্ষতিগ্রস্ত যৌনকর্মীর পাশে দাঁড়ায় নারীপক্ষ, তাদেরকে আন্দোলনে যুক্ত করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মিছিল-সমাবেশে তারাও অংশ নেয়। পরবর্তীতে এই সংগ্রাম আরও জোরদার হয় কান্দুপট্টি, নিমতলী, ও টানবাজার যৌনপল্লী উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে। নারীপক্ষ যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ে তাদের পাশে থেকেছে, আজও আছে। এর ফলে আমাদের অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
এছাড়াও, আইনের যে ধারায় বলা হয়েছে যে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচেও বাল্যবিবাহ গ্রহণযোগ্য—তার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাই এবং নারীপক্ষের স্বাস্থ্য আন্দোলনের সময় যখন আমরা নারীর নিজের শরীরের উপর তার অধিকারের বিষয় নিয়ে কথা তুলি, তখনও আমাদের অনেক কথা শুনতে হয়েছে, অনেক বিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছে। তবুও নারীপক্ষ কখনই কোনো বিষয়ে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসে নি। আমরা সর্বদাই ছিলাম অটল, অবিচল।
ফাতিন: বর্তমানে এই মহামারী দেশের অর্থনীতির, বিশেষত শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের উপর সর্বনাশা প্রভাব ফেলেছে। এই শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ গার্মেন্টসকর্মী নারীরা, যৌনকর্মীগণ এবং ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটি। নারীপক্ষ কি এই সময়ে তাদের আর্থিক বা অন্য কোনো সাহায্য করেছে বা করার পরিকল্পনায় আছে?
রওশন আরা: যদিও এসব ব্যাপারে আমাদের মতো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা খুবই কম, তবুও নারীপক্ষ সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এই মহামারী যখন শুরু হলো, তখন নারীপক্ষের সদস্যরা নিজেরা ডোনেশন দিয়ে একটি তহবিল গড়ে তুলেন। কিছু সাহায্য অবশ্য এর বাইরেও পেয়েছি। অনেক মানুষকে সহায়তা দিতে না পারলেও, আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু মানুষকে প্রায় ৩ মাসের এইড প্যাকেজ দিতে পেরেছি।
এছাড়াও আমরা ঢাকার কিছু অঞ্চলে বসবাসরত বিহারী জনগোষ্ঠীর সাথে প্রায় ৫-৬ বছর ধরে কাজ করছি। এই দুর্যোগের সময়ে তাদের অবস্থাও বেশ করুণ, তবে আমরা আমাদের বন্ধু সংগঠন, গণস্বাস্থ্য-এর মাধ্যমে ১২০০ বিহারী পরিবারের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছি।
ফাতিন: নারীপক্ষ কি বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা, যৌন ও মাতৃস্বাস্থ্যের মতো ব্যাপারগুলো নিয়ে শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাগুলোতে কোনো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে?
রওশন আরা: পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে নারীপক্ষ তেমন কাজ আপাতত করছে না, তবে বাকি ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা শহর, গ্রামাঞ্চল সব জায়গায় কাজ করেছি।
আমরা কিশোর বয়সীদের তাদের শরীর সম্পর্কে জানানোর কাজ করি এবং সচেতন করতে চাই। কারণ এদেশে যৌনতা এবং শারীরিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট জ্ঞান পরিবার থেকে অনেকেই পায় না। এই বয়সে তারা নিজের অজান্তেই হয়রানির শিকার হতে পারে বা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করতে পারে। তাদের যাতে এই ধরনের কোনো পরিস্থিতির শিকার না হতে হয় এবং তারা যাতে সতর্ক ও নিরাপদ থাকতে পারে, সেই লক্ষ্যে আমরা তাদের সাথে কাজ করি।
ফাতিন: আপনারা ধর্ষণ, গৃহ নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার নারীদের ন্যায়বিচার আদায়ের জন্য কীভাবে সাহায্য করে থাকেন?
রওশন আরা: এমন কেউ যখনই নারীপক্ষের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন, নারীপক্ষ অবিলম্বে তাদের পাশে দাঁড়ায়। আমরা তাদের মানসিক শক্তি যোগানোর জন্য কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করি, এবং চিকিৎসামূলক বা আইনগত সহায়তার প্রয়োজন হলে তাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেই। শহর ও গ্রামাঞ্চল, দু’জায়গাতেই নারীপক্ষ এই ব্যাপারে কাজ করে।
ফাতিন: শেষ প্রশ্ন। নারীপক্ষ ভবিষ্যতে কোন লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চায়? আপনারা কি আগামীতে নতুন কোনো ক্ষেত্রে কাজ করার পরিকল্পনা করছেন?
রওশন আরা: আসলে, এতক্ষণ যা যা নিয়ে কথা বললাম, নারীপক্ষ আপাতত সেগুলো নিয়েই কাজ করতে চায়, কেননা অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো এখনো আসে নি।
আমরা সিডাও(CEDAW) এর কিছু অংশ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছি, যার ফলাফল এখনো আসে নি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার আরএমজি কনভেনশন এর ১৯০ ধারায় উক্ত কর্মক্ষেত্রে নারীদের হয়রানি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হলেও, আমাদের দেশে সেটি এখনো স্বীকৃতি পায় নি। এই স্বীকৃতি আদায়ে নারীপক্ষ কাজ করছে। এছাড়াও নানা বৈষম্যমূলক আইন বদল, রোহিঙ্গা ইস্যু, স্বাস্থ্য আন্দোলন ইত্যাদি নিয়েও আমরা কাজ করছি এবং যথাযথ পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত করে যাব।