তানজিনা তাবাস্সুম নোভা
নিঃসন্দেহে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে পরিমাণ রক্ত এদেশের মানুষ ঝরিয়েছে, এতটা সম্ভবত আর কোনো জাতিকে ঝরাতে হয় নি। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনাবলী। কিন্তু এই সাহিত্যের কতটুকু শিশু-কিশোরদের পাঠ উপযোগী? তাদের জন্য এই বিষয়ে যথেষ্ট মানসম্পন্ন লেখালেখি হয়েছে, বা হচ্ছে কি?
এই লেখাটি লেখার আগে আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শিশু-কিশোর সাহিত্যের ব্যাপারে খোঁজ করার চেষ্টা করেছি। আমার নিজের যা আগে থেকেই পড়া ছিল, তার বাইরে আর কী কী বই আছে, তা জানাটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। ফলাফলে যা পেলাম, তা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এই বিষয়ে লেখা শিশু-কিশোর সাহিত্যের, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ভালো মানের শিশু-কিশোর সাহিত্যের অভাব রয়েছে। তাই বলে যে ভালো মানের লেখালেখি হয় নি, তা-ও নয়। এখানে আমি ব্যক্তিগত পছন্দের তেমন চারটি বইয়ের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আমার বন্ধু রাশেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক দিনে গল্পকথক ইবুর ক্লাসে ভর্তি হয় রাশেদ। এই রাশেদ, যে তার ‘পাগল কিসিমের’ বাবার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করে, সে ইবু, ফজলু, দিলীপ, আশরাফদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিত সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে পাকিস্তানিরা আর বাঙালিদের শোষণ করতে পারবে না, তাই তারা কখনোই ক্ষমতা তুলে দেবে না; কিংবা অসহযোগ আন্দোলন ব্যাপারটা কী—এসব তথ্য রাশেদ-ই তাদের সরবরাহ করে। পরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন রাশেদের কারণেই তার বন্ধুরা সরাসরি যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পায়।
উত্তম পুরুষে বর্ণিত হওয়ার কারণেই সম্ভবত পাঠকের পক্ষে এই গল্পের সাথে সংযোগ ঘটানো সহজ হয়। হয়তো এই কারণেই রাশেদ শুধু ইবুর বন্ধু থাকে না, পাঠকেরও বন্ধু হয়ে ওঠে।
ব্যক্তিগত মন্তব্য জানাতে গেলে বলতে হয়, “কোন ফিকশনাল চরিত্রকে নিজের বন্ধু হিসেবে পেতে চান?” এমন যে প্রশ্নটা প্রায়ই ইন্টারনেটে দেখা যায়, আমি সবসময় সে প্রশ্নের একটি উত্তর-ই দিয়ে এসেছি – রাশেদ।
সূর্যের দিন, হুমায়ূন আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুর দিকের সময়কার, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের কিছু ঘটনা এই ছোট বইটিতে উঠে এসেছে। বইয়ের মূল চরিত্র খোকন তার বন্ধুদের সাথে ‘ভয়াল ছয়’ নামে একটি দল গঠন করে পায়ে হেঁটে পৃথিবী ভ্রমণের স্বপ্ন দেখে। তার বড় চাচার কড়া নিষেধ থাকা সত্ত্বেও দেশের এই উত্তাল সময়ে সে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন মিছিলে অংশ নেয় এবং শাস্তিও পায়। বড় চাচা এক সময় পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছিলেন, তাই তাঁর মতে পাকিস্তান ভাঙা উচিত হবে না। ২৫শে মার্চের কালরাতের পর তাঁর এই বিশ্বাসে চিড় ধরে। এই একটা রাত অনেকগুলো মানুষের জীবনকে ওলটপালট করে দেয়।
হুমায়ূন আহমেদ শিশু-কিশোরদের জন্য চমৎকার সব বই লিখে গেছেন। সূর্যের দিন তাদের মধ্যে একটি। বইটিতে তিনি গল্পের ফাঁকে ফাঁকে খুব সরলভাবে ইতিহাস বলেছেন, যা পাঠকদের সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ জানতে সাহায্য করবে।
বুকের ভিতর আগুন, জাহানারা ইমাম
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শান্টু দেখতে পায়, তার সমবয়সী খালাতো ভাই মোহন গভীর রাতে তাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে। মোহনের পরিবারের সবাইকে পাকিস্তানি মিলিটারি মেরে ফেলেছে। সে নিজে লুকিয়ে থেকে কোনোমতে বেঁচে গিয়েছে। তার সাথে কথা বলে শান্টু বুঝতে পারে, পরিবারের সকলের মৃত্যু মাত্র ষোল বছর বয়সেই মোহনকে কেমন পরিণত করে তুলেছে। সে এখন যুদ্ধে যোগ দিয়ে এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। এরপর আমরা দেখতে পাই, তারা দু’জনেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছে।
কিশোরদের চোখ দিয়ে রণাঙ্গনকে দেখা বুকের ভিতর আগুন বইটিকে অনন্য করে তুলেছে। যুদ্ধ আর মৃত্যু মানুষকে কীভাবে পরিণত করে তুলতে পারে, মোহন তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে তার কুশলী নেতৃত্ব এই বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
একাত্তরের যীশু, শাহরিয়ার কবির
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গ্রামের সবাই পালিয়ে গেলেও গির্জার সেবক বুড়ো ডেসমন্ড তার গির্জাতেই রয়ে যায়। এক রাতে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা তার কাছে আশ্রয় চায়। ডেসমন্ডের মনে হয়, তারা আসলে দেবদূত। সেই দেবদূতদের সে আশ্রয় দেয়, তার সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতা করে। তারপর এক রাতে সেই দেবদূতদের খোঁজে পাকিস্তানি মিলিটারি আসে।
ডেসমন্ড এমন একটি চরিত্র, যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। তার সারল্য এবং ঈশ্বর ও মানুষের ওপর অগাধ বিশ্বাস তাকে সবার পছন্দনীয় করে তোলে। ছোট গল্পের সীমিত পরিসরের মধ্যেও হৃদয়কে নাড়া দেওয়ার মতো একটি গল্প বলার ক্ষেত্রে লেখক সফল।
আমার বন্ধু রাশেদ এর পটভূমি একটি মফস্বল শহর, সূর্যের দিন এর পটভূমি ঢাকা শহর, বুকের ভিতর আগুন এর পটভূমি যুদ্ধক্ষেত্র, আর একাত্তরের যীশু এর পটভূমি একটি গ্রাম। পটভূমিতে ভিন্নতা থাকলেও যুদ্ধের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা কিন্তু সব জায়গাতেই এক। দেশের সব মানুষই যে এই যুদ্ধের দ্বারা কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত ছিল, পুরো দেশটাই যে তখন একটা যুদ্ধক্ষেত্র ছিল – এ বইগুলো তারই সাক্ষ্য দেয়।
আবার শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা হচ্ছে বলে যে লেখকরা শুধু আনন্দময় ও সুখী জীবনের গল্প বর্ণনা করবেন, তা কিন্তু নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে গেলে সেই সময়ে মানুষ যে কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তা অনুভব করা জরুরি। এই বইগুলোতে লেখকরা সেই চেষ্টাই করেছেন।
আমার বন্ধু রাশেদ বইয়ের ট্র্যাজিক সমাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন,
“আমি বইটিতে দুটো কাজ করার চেষ্টা করেছি, সেই সময়ে যা যা ঘটেছিল সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর কথা বলার চেষ্টা করেছি এবং বইটি পড়ে যেন বুকের ভেতর একটা কষ্টের অনুভূতি থাকে তা চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের স্বপ্ন দেখার সময়, বীরত্বের সময় এবং ত্যাগের সময়। কিন্তু আমার মনে হয় সেই সময় সবচেয়ে তীব্র যে অনুভূতিটি ছিল সেটি হচ্ছে দুঃখের অনুভূতি, কষ্টের অনুভূতি। সেই সময় বাংলাদেশে একটি পরিবারও ছিল না যারা তাদের কোনো না কোনো আপনজনকে হারায় নি। তাই আমার মনে হয়েছিল আমাদের দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যদি কোনভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করতে চায়, তাহলে সেটি কষ্ট এবং দুঃখ দিয়ে অনুভব করুক।
আমাকে অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়ে এই বইটি নিয়ে অভিযোগ করেছে – আমি তাদের সবার অভিযোগ মেনে নিয়েছি, নিয়ে কিন্তু এই কথাটিই বলেছি – এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ।”
– তোমাদের প্রশ্ন আমার উত্তর, মুহম্মদ জাফর ইকবাল
এই লেখায় আলোচিত বইগুলো ছাড়াও শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরো অনেক বই আছে। তাদের মধ্যে জাহানারা ইমামের বিদায় দে মা ঘুরে আসি, সেলিনা হোসেনের কাকতাড়ুয়া, কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ছানার মুক্তিযুদ্ধ, মুহম্মদ জাফর ইকবালের গ্রামের নাম কাঁকনডুবি, রতন, শাহরিয়ার কবিরের পূর্বের সূর্য – এগুলো উল্লেখযোগ্য।
যে কোনো বাংলাদেশির জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা এবং মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করতে পারাটা খুবই প্রয়োজনীয়। সেই কাজটি যদি ছোটবেলা থেকে শুরু করা যায়, তাহলে তা সবচেয়ে ভালো হয়। আমি মনে করি, শিশু-কিশোরদের মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করার ক্ষেত্রে উল্লেখিত বইগুলো যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে।