বিসর্জন

Editor
7 Min Read

ফিয়ানা ইসলাম


প্রায় ১২ বছর পর নিরুপমাকে হঠাৎ চোখের সামনে এভাবে দেখে বুকের মধ্যে থেকে একটা শব্দহীন চাপা গোঙানি বের হতে চায় মেহুলের। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাতে সামলাতেই নিরুপমা সামনে এসে হাজির।

“ভালো আছিস?”

সেই চেনা হাসি। কিন্তু কেমন যেন মিইয়ে যাওয়া গলা। 

“আছি নিরুদি। তুমি ভালো? অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে,” মেহুলের গলা কাঁপছে। 

“আছি রে…স্বামী-সংসার নিয়ে বেশ আছি,” বলতে বলতে নিরুপমা যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। 

মেহুল হাসে। আটপৌরে বাঙালি গৃহিণী যাকে বলে নিরুপমাকে তাই লাগছে। আগের মতো নেই আর। আগে কেমন একটা সতেজ ভাব থাকত তার মুখে…সংসারের কঠিন এই বেড়াজালে সেই পুরোনো সতেজতা কি এভাবেই উবে গেল? নাকি তার-ই এমন লাগছে শুধু? 

“কী রে তুই মেহুল! বিয়ে করলি একটা খবরও দিলি না, তোর বর নাকি অনেক সুন্দর দেখতে!”

নিরুপমা থামে না, বলতেই থাকে, “হ্যাঁ রে, মাসিমা কেমন আছেন? কতদিন দেখি না তোদের সবাইকে। কলকাতায় একদমই মন টেকে না জানিস তো, অরুণ মানে আমার বর, সেই যে সকালে বেরোয় আর রাত্তিরে বাসায় আসে। ডাক্তার মানুষের অনেক কাজ বুঝলি! আমার তো সময়ই কাটে না বাসায়। পুজো দেখে আসতে পারলাম দেশে এবার। খুব করে বললাম ওকে যে এবার আমার দেশে থাকা চাই-ই চাই। একদম ধরে বেঁধে নিয়ে আসলাম। আজ অষ্টমী দেখে একা বেরুলাম সকাল সকাল, তুই তো জানিস আমার সব মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে দেখতে কত ভালো লাগে!”

মেহুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকে। বলতে ইচ্ছা করে, “নিরুদি আমার কথা তোমার মনে পড়ত এতগুলো বছরে?” কিন্তু বলা হয় না। মনের কথা গুলো যেন মুখের দীর্ঘশ্বাসে আটকে থাকে।

“কী রে, বল কিছু!” নিরুপমার কথায় সম্বিৎ ফেরে মেহুলের। 

“আছি তো নিরুদি। ভালো আছি। সংসার করছি। চাকরি করছি। মাও ভাল আছে। সবাই ভালো আছে। এই তো।” 

নিরুপমা হাসে, “আমার ছেলেকে দেখাব তোকে একদিন মেহুল। নাম রেখেছি কি শুনবি? নীল। তুই বলতি না তোর নীল নামটা অনেক পছন্দ? নিয়েই নিলাম তোর থেকে।” 

মেহুলের বুকের ভেতরটা আবার মোচড় দিয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, “নিরুদি এমনটা কেন হলো আমার সাথে! আমি তো বেশি কিছু চাই নি। একসাথে বাঁচতে চাওয়াটা কি অপরাধ?” কিন্তু মুখ থেকে কথা বের হতে চায় না। বরং মনের মধ্যে অনেকদিনের একটা দুমড়ানো মোচড়ানো অনুভূতি নিয়ে যায় কয়েক বছর আগের দিনগুলোতে। 

সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা মেহুলকে কোনো কাজে বাধা দেওয়া মানে ছিল সারা পাড়া এক করা। কারোর কোনো জো-ই ছিল না তাকে থামানোর। একমাত্র নিরুপমা পারত তাকে শান্ত করতে। প্রতিবেশী, কিন্তু যেন বাড়ির লোক। কোন এক দূর্গাপূজায় যেন দেখা হলো মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে গিয়ে। 

“তুই মেহুল না? শোন, আমাকে নিরুদি ডাকবি। তোদের পাশের বাসাতেই এসেছি নতুন। কাল ঠাকুর দেখতে কিন্তু আমাকে রেখে যাস নে আবার…” 

বলতে বলতে পূজোমণ্ডপের অজস্র মানুষের সেই ভিড়ে নিরুদি মিলিয়ে গেল। তার সেই লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে চলে যাওয়ার দৃশ্য মেহুলের আজও মনে আছে। 

একটা কাজও তো নিরুদিকে ছাড়া করত না সে। আম চুরি হোক, পুতুল খেলা হোক, পুজো দেওয়া হোক, এমনকি চুলের বেণীটা পর্যন্ত দু’জনের একসাথেই করা চাই। পাড়ার কোনো ছেলেও নিরুদিকে কিছু বলতে পারত না মেহুলের জন্য। খুব রাগ করত মেহুল।

একদিন কী হলো, পুতুল খেলার একপর্যায়ে ভুলবশত নিরুদির হাত মেহুলের বুকে এসে লাগল। মুহূর্তেই মেহুলের শরীর কেঁপে উঠল, যেন পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ থেকে মাথার আগা অবধি কেউ বৈদ্যুতিক একটা শক দিয়েছে। দৌঁড়ে মেহুল ঐদিন ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। সারাদিন সে কিচ্ছু খায় নি। এমনকি দরজাও খোলে নি। মা, কাকিমা, সবাই এত ধাক্কাধাক্কি করল কিন্তু তাও সে খুলল না। একসময় নিরুদিও আসল। নাম ধরে অনেকক্ষণ চেঁচালো। কোনো লাভ হলো না। মেহুলের মনে হচ্ছিল তার ভয়ে জ্বর উঠে যাবে।

এরপর থেকে তো প্রায়ই এরকম হওয়া শুরু হলো। নিরুদি সামনে আসলেই মেহুলের কেমন যেন লাগতে থাকে। বুক ধড়ফড় করা শুরু করে। নিরুদির যেই জিনিস তার আগে স্বাভাবিক লাগত, সেই সব জিনিসই তার হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে ভালো লাগা শুরু হলো। নিরুদির হাসি, তার শরীরে মাখা চন্দনের ঘ্রাণ, তার এক প্যাঁচে পরা শাড়ির ভাঁজ—সব কেমন যেন একটা তীব্রতার জন্ম দিতে শুরু করে মেহুলের মনে। ক্রমেই যেন নিজের কাছেই সে অচেনা হতে শুরু করল। 

মাকে একদিন জিজ্ঞেস করল, “মা আমি কি অসুস্থ?” মা হেসে উড়িয়ে দেন।

নিরুদিকে শেষ পর্যন্ত সব বলে দিয়েছিল মেহুল। প্রথমে বিকট স্বরে হেসে উঠলেও মেহুলের চাপা কান্না দেখে পরক্ষণেই সে গম্ভীর হয়ে যায়। 

“ছিঃ মেহুল! তুই কি অসুস্থ? এসব হয় নাকি কখনো! তোর মাথায় এসব অলুক্ষণে চিন্তা  কীভাবে আসে বল দেখি! ছেলেমানুষির একটা সীমা আছে। মানুষ শুনলে কী বলবে ভেবেছিস! ছিঃ! লজ্জা হয় না তোর? আমাকে কি একটুও শান্তি দিবি না নাকি?”

নিরুদির কথা শুনে মেহুল সেদিন লজ্জায় অপমানে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। মাথা নিচু করে সে ভাবছিল এত অপমান নিরুদি কীভাবে করল তাকে! কোথায় তার ভুল? নিরুদি বুঝিয়ে দিচ্ছে না কেন তাকে? এই লজ্জা, অপমানের পর কীভাবে সে নিরুদির সামনে গিয়ে আবার দাঁড়াবে! 

কিন্তু এই লজ্জা বেশিদিন সহ্য করতে হলো না তার।

এরপরের পুজোয় নিরুদির বিয়ে হয়ে গেল, অনেকটা ধুমধাম করেই। পাড়ার সবাই গিয়েছিল। মেহুলও গিয়েছিল।

গায়ে লাল বেনারসি, দুহাতে শ্বেতবর্ণের শাখা, সিঁথিতে লাল সিঁদুর…নিরুদিকে দেবী বললেও কম হতো যেন। চারিদিকে হৈচৈ, বিয়ের মণ্ডপের লাকড়িপোড়া গন্ধ আর শাঁখ-উলুর শব্দে মেহুলের মাথা টনটন করতে থাকে।

পালকিতে ওঠার আগে একবার শুধু নিরুদি মেহুলের দিকে তাকাল। ওই অতটুকুই। 

মনের সমস্ত অনুভূতিকে এক নিমিষে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে অপমানের ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে তার নিরুদি চলে গেল। 

আর আজ এতবছর পরে আবার সেই দেবীর দেখা। 

“মেহুল! কী রে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?” নিরুপমার কথায় মেহুল অতীত থেকে বেরিয়ে আসে। 

“শোন না, দশমীর দিন বিসর্জন দিয়েই আমার বাড়িতে আয় না তোর বরকে নিয়ে। দেখাও হয়ে যাবে ওদের। আর আমরা একসাথে সময়ও কাটাতে পারব। বেশ হবে বল! আসবি তো মেহুল?” 

নিরুপমা উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার কথা ছাপিয়ে মেহুলের কানে আসে অদূরে সমানতালে বাজানো কোনো ঢাকের আওয়াজ। মণ্ডপের উলুধ্বনির শব্দের সাথে সাথে ধূপের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে চারপাশটা কেমন যেন ভারি হয়ে ওঠে। পরিবেশটা তার বড্ড চেনা লাগতে থাকে। 

“কী রে বল!” নিরুপমা আবার প্রশ্ন করে। 

“কী বলব, নিরুদি?” মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসে, “আমার মন্দিরের দেবীর বিসর্জন তো আমি সেই বারো বছর আগেই দিয়ে দিয়েছি।” 

 

প্রতিত্তরে নিরুপমা যেন একটা ধাক্কা খায়। সে কিছু বলতে পারে না। গলা আটকে যায়। অবাক বিস্ময়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে নিরুপমা হঠাৎ আবিষ্কার করে মেহুল নেই। এদিক ওদিক খুঁজে সে দেখতে পায় মন্ডপের সেই শত শত মানুষের ভিড়ে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা অভিমানী মেয়েটা যেন দ্রুত মিশে যাচ্ছে।

Share this Article
4 Comments