কাজলের মুক্তি এবং মুক্তচিন্তা: শিল্পের মাধ্যমে একজন সন্তানের আকুতি

Editor
8 Min Read
বাবার মুক্তির দাবিতে শহীদ মিনারের সামনে সন্তান মনোরম পলক

যুনায়েদ মুবতাসিম ইসলাম


“তুমি আদালতে বসে বসে চুটকি লেখ
আমরা রাস্তায় আর দেয়ালে দেয়ালে ইনসাফ লিখব
এত উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকব যে কালাও শুনতে পারবে
এত পরিষ্কার করে লিখব যে কানাও পড়তে পারবে
তুমি কালো পদ্ম লেখ, আমরা লাল গোলাপ লিখব
তুমি জমিনে জুলুম লেখ, আমরা আসমানে বিপ্লব লিখে যাব
সবকিছু মনে রাখা হবে।”

 

সেদিন রাতে ফেসবুকের একটি লাইভ সেশনে ভারতের আমির আজিজের সদ্য অমরত্ব প্রাপ্ত লেখা সাব ইয়াদ রাখা জায়েগা  কবিতাটির বাংলা তর্জমার এই লাইনগুলো বজ্রকণ্ঠে পাঠ করতে শোনা যায় নাসিফ আমিনকে। ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র কিংবা প্রসঙ্গ সম্পর্কে বাংলাদেশের কোন দর্শক যদি অবগত না-ও থাকেন তারপরও বোধহয় এই লাইনগুলো শুনে যেকোনো কেউই এক মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে যেতে বাধ্য। একা একাই প্রশ্ন জাগে — “আচ্ছা, আবার কিছু ঘটে নি তো?”

এমন প্রশ্ন উঠে আসা যে খুব ব্যতিক্রম কিছু না, তার প্রধান কারণ সমাজে বর্তমানে চলতে থাকা ভয়ের সংস্কৃতি।  ভয়ের সংস্কৃতিতে মানুষ বিপ্লবকে কখনো স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া হিসেবে চিনতে শিখে না। বরং বিপ্লব দেখলেই তাকে প্রতিক্রিয়ার গণ্ডিতেই সবসময় সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়। তবে দর্শকের প্রশ্নের উত্তর রয়েছে এবং উত্তরটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খুব চিরচেনাই বটে — হ্যাঁ, কিছু একটা ঘটেছে।

কিছু একটা ঘটেছে বলেই গত তিন মাস ধরে করোনা পরিস্থিতির মাঝেও দেশের সমাজকর্ম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ তাদের শিল্প ও স্বর নিয়ে একত্রিত হচ্ছেন একটি অনলাইন মঞ্চে। উদ্দেশ্য — সাংবাদিক কাজলের মুক্তির দাবি জোর গলায় জানান দেয়া। আরো একবার দেশের মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া, এদেশে গণতন্ত্রের ক্রান্তিকালে মুক্তচিন্তা চর্চার সংকট কতটা প্রকট।

কাজলের মুক্তি মুক্তচিন্তা  শিরোনামের ফেসবুক লাইভ সিরিজের শুরু জুলাই-এর একুশ তারিখে। Where Is Kajol? নামের ফেসবুক পেইজের এই লাইভ সেশনের প্রথম পর্বে বাংলা ফাইভ ব্যান্ড-এর সদস্য সিনা খান এবং মেঘদল-এর রাশিদ শরীফ শোয়েব তাঁদের মৌলিক ও কভার গানে তুলে ধরেন দেশের চলমান রাজনৈতিক চাঞ্চল্য এবং জুলুমের সংস্কৃতিকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস।

কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে দুই দশক আগেও দেশে মুক্তচিন্তা চর্চার অকুতোভয় চিত্র। সেই জের ধরে চলে মুক্তচিন্তা চর্চার প্রদর্শন। সে কারণেই বোধহয় আলোচনার এক ফাঁকে উঠে আসে জাপানি কৃষক মাসানুবো ফুকোকার দর্শনও।

সিরিজের পরবর্তী পর্বগুলোয় একে একে শায়ান, সহজিয়া  ব্যান্ডের রাজু, বিথি ঘোষ, ব্যান্ড এফ মাইনর-এর সদস্যবৃন্দ, আরমিন মুসা, কনক আদিত্য প্রমুখ গানে গানে প্রকাশ করেন স্বাধীনতার অর্থ, মতপ্রকাশের তাৎপর্য। বিভিন্ন প্রসঙ্গে উঠে আসে সাংবাদিক কাজল, ব্যক্তি কাজল, ও বাবা কাজলের গুরুত্ব। প্রতিটি আড্ডাতেই বারবার তুলে ধরা হয় জনগণের উপর রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রয়োগ, ভয়ের সংস্কৃতি, সেলফ-সেন্সরশিপ, সাংবাদিকতা পেশার ঝুঁকি, এবং ৫৪ ধারা ডিজিটাল অ্যাক্ট নিয়ে আলোচনা। জুলাই মাসের ২৭ তারিখে শেষ হয় সিরিজের প্রথম অংশ।

উল্লেখ্য, গত ২ মে নিখোঁজের ৫৩ দিন পর শনিবার গভীর রাতে যশোরের বেনাপোলের সাদীপুর সীমান্তের একটি মাঠ থেকে ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে উদ্ধার করা হয়। পরের দিন বিজিবির দায়ের করা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা ও ফেইসবুকে একটি লেখা শেয়ার করার “অপরাধে” ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে যশোরের আদালতে সোপর্দ করা হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছেন এবং এখনো তিনি জামিন পান নি। তার ছেলে মনোরোম পলক একক প্রচেষ্টায় বাবার মুক্তি চেয়ে সামাজিক মাধ্যমে Where Is Kajol? পেইজ থেকে প্রতিবাদের শোর তুলেছেন, যার ফল-ই হলো কাজলের মুক্তি ও মুক্তচিন্তা  আন্দোলন।

সিরিজের প্রথম অংশ শেষ হওয়ার তিন সপ্তাহ পর আগস্ট মাসের আঠারো তারিখ শুরু হয় সিরিজের দ্বিতীয় অংশ কাজলের মুক্তি মুক্তচিন্তা । পুলিশের পক্ষ থেকে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের জামিন বিষয়ক অস্বচ্ছতা তখনো বহাল তবিয়তে চলমান। ঠিক এমন সময় কাজলের মুক্তি মুক্তচিন্তা  ক্যাম্পেইন তার সকল মহিমা নিয়ে হাজির হয়। নাট্যদল প্রাচ্যনাট্য  তাদের লাইভ থিয়েটার অ্যাকশন Who Is Next? পরিবেশনা করে। শাসকগোষ্ঠীর সাথে নির্যাতিতের সম্পর্ক আদতে কেমন এবং সেই সম্পর্কের নেপথ্যে কী উপাদান ব্যবহার করা হয় সেটিই এই পরিবেশনায় মুখ্য বিষয় হয়ে উঠে আসে।

ইতালীয় দার্শনিক আন্তনীয় গ্রামসির ক্ষমতা সম্পর্কের তত্ত্ব এবং ক্ষমতা সম্পর্কের দুটি বিন্দু CoercionConsent বারবার উঠে আসে ১৫ মিনিট ব্যাপী এই পরিবেশনায়। নিগ্রহকে সম্মতি হিসেবে পুনরুৎপাদিত করার কৌশলের এই চিত্রাঙ্কন বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক-ই বটে। কবিতা পাঠের পর্বে উপস্থিত ছিলেন নাজমুল আহসান, রওশান আরা মুক্তা, শশাঙ্ক কুমার সাহা এবং নাসিফ আমিন। ফ্যাসিবাদি শক্তির বিরুদ্ধে জাতির সামনে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে এক অংশ ছাড়ও দেন নি তারা।

সুকুমার রায়ের কবিতার অনুপ্রেরণায় তৈরি নাটক একুশে আইন  কিংবা পাপেট শো পাঁচে সাতে, সাতে  পাঁচে  কাজলের মুক্তি এবং বিচার নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, লুকোচুরি কিংবা মিথ্যা ও অস্পষ্টতার আশ্রয় নেয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছে বারবার। ক্যাম্পেইনের দ্বিতীয় অংশে গান পরিবেশনা করেন প্রগতা নাওহা এবং ব্যান্ড বুনোফুল । তবে রিতু সাত্তার এবং সামিনা লুতফার অভিনীত স্যামুয়েল বেকেট-এর ঐতিহাসিক নাটক Waiting For Godot এর অভূতপূর্ব পরিবেশনা যুক্তিযুক্তভাবে এই ক্যাম্পেইনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বলে ধরা যায়। অসীম অনিশ্চয়তার এই চিত্রণের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান কাঠামোগত ব্যর্থতা থেকে জন্ম নেওয়া মানুষের মনোঃস্তাত্ত্বিক অবস্থার সম্পর্ক খুব সহজেই স্থাপন করা যায়।

রাজনৈতিক প্রতিবাদে শিল্প ও শৈল্পিক অভিব্যক্তির মাঝে সাধারণত বেশ কয়েকটি ফাংশন লক্ষ্য করা যায়। নিজেদের মধ্যে সংহতি স্থাপন করা, যোগাযোগের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া এবং জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি করা — এই প্রতিটি বাক্সেই চেক দিয়েছে কাজলের মুক্তি মুক্তচিন্তা  নামের এই শিল্পের মাধ্যমে একজন সন্তানের প্রতিবাদের ক্যাম্পেইন।

শিল্পকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে দেশের নানা অঙ্গনের মানুষ প্রতিবাদ করেছেন ভয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। তারা কে, কোথা থেকে এসেছেন, কীসের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং কীসের বিরোধী — তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন দেশের মানুষের সামনে, যা অত্যন্ত জরুরি। প্রশ্ন উঠেছে, ভয়ের সংস্কৃতি আমাদের জাতিসত্তার কত গভীরে চলে গেলে আজ ঘর থেকে কেউ বের হওয়ার পর তাকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া নিয়ে আমরা উচ্ছ্বাস করি? শিল্পীরা অত্যন্ত সাহসের সাথে প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, এমন সংস্কৃতির মাঝে রাষ্ট্র তার নিজ সমালোচনা শুনবে কোন সূত্র থেকে?

সামিনা লুতফা একটি চমৎকার প্রশ্ন তুলেছেন সেদিন,

“সাইবার স্পেসে নারীদের লাঞ্ছ্বনা থামাতে তো রাষ্ট্র পদক্ষেপ নেয় নি। তাহলে কি শুধু মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশ কিংবা রাষ্ট্রের সমালোচনায় বাধা প্রদান করতেই এই ডিজিটাল অ্যাক্টের অস্তিত্ব? মুক্তচিন্তার উপর এভাবে বাধা প্রদান কি আদতে শিক্ষা এবং পরবর্তীকালে জাতীয় কাঠামোর উপর আরো বড় বিপর্যয়ের-ই ইঙ্গিত নয়?”

 

শিল্পীরা সবসময়-ই যেকোনো সমাজের সবচেয়ে বড় স্বাপ্নিক। তাদের স্বপ্ন আমাদের আশা দেখায়। আশা দেখায় একজন মনোরম পলকের তার বাবার মুক্তি চাওয়ার সংগ্রাম। হয়তো কাজল অতি শীঘ্রই ফিরে আসবেন তার পরিবারের কোলে। ভবিষ্যতে কখনো হয়তো আরেকজন বাবার মুক্তির সংগ্রাম করতে হবে না কোনো সন্তানকে। হয়তো ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারকৃত সকল মানুষ মুক্তি পাবেন, হয়তো আরেকজন মানুষের উপর এই আইনের প্রয়োগ দ্বিতীয়বার রাষ্ট্র পুনর্বিবেচনা করবে।

এই স্বপ্নই তো বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। বাঁচিয়ে রাখে শত শত মনোরম পলককে।

 


লেখক টিডিএ এডিটোরিয়াল টিমের একজন সদস্য।

Share this Article
Leave a comment