ইটপাথরের শহরে এক বাঁশুরিয়ার দল: কার্টুন পিপল-এর চার বছর

Editor
15 Min Read
কার্টুন পিপল

রাহিন আমিন


২০১৬ সালের কথা। চ্যানেল আই-এ কার্টুনিস্ট সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়ের জীবনের উপর তার নিজের-ই বানানো একটি অ্যানিমেশন ভিডিও প্রচারিত হয় “চ্যানেল আই: প্রজন্ম আগামী” প্রোগ্রামের তৃতীয় সিজনের একটি পর্বে। ৬ মিনিটের ওই অ্যানিমেশন ভিডিওতে তন্ময় তুলে ধরেন তার কাটুর্নিস্ট হয়ে ওঠার গল্প, জানান কীভাবে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার পরেও ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন কার্টুন আঁকাকে।

সেই ভিডিও চ্যানেল আই ও ফেসবুকে প্রচারের পর যা হলো, তা বোধহয় ভিডিওটা বানানোর সময় তন্ময় ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেন নি। হাজার হাজার শেয়ারে পুরো ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওটি। মেসেজের বন্যায় ভরে যায় তার ব্যক্তিগত প্রোফাইল ও পেইজের ইনবক্স।

তন্ময়ের ভাষায়, “সেই অভিজ্ঞতাটা অদ্ভুত। ভিডিওটি পাবলিশ হওয়ার পরে আমার কাছে এত মানুষ মেসেজ পাঠায় যে দু’দিন আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেইজ হ্যাং হয়ে ছিল। দু’দিন পর যখন প্রথম ফেসবুক খুলতে পারি, দেখি যে হাজার হাজার মানুষ কমেন্ট করছে, শেয়ার করছে, মেসেজ দিচ্ছে।

আমার কাছে যারা মেসেজ পাঠাচ্ছিল, সবাই যে প্রশংসা করছিল — এমন নয়। কেউ কেউ অনেক প্রশ্ন নিয়ে হাজির। কীভাবে কার্টুনিস্ট হবে, কীভাবে কী করবে। একজন ডাক্তার মেয়ে আমাকে মেসেজ পাঠায়। সে তখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। মনে প্রাণে সে একজন শিল্পী হলেও, বাবার কথায় ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন তার আর ভালো লাগছে না, কী করবে।

এত মেসেজের, এত প্রশ্নের সামনে এসে আমি একটু থমকে গেলাম। সেই মেয়েকে বললাম, ‘সন্তানের খুশিতেই বাবা-মায়ের খুশি।’ কিন্তু ব্যাপারটা যে এতটা সহজ নয়, তা তো আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না।”

আরেকজন তন্ময়কে লিখে পাঠান, তিনি তন্ময়ের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত। পরিবার ও সমাজের একটু সাহায্য পেলে হয়তো তিনিও তন্ময়ের মতোই সফল হতে পারতেন।

ভিডিওতে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে তন্ময় যেন তার ছোটবেলায় ফিরে গেলেন। পুরো স্কুলজীবন কাটিয়েও বন্ধুবান্ধবের মাঝে এমন কাউকে পান নি যার সাথে পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে গল্প করতে পারবেন প্রাণ খুলে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় দেখতেন, ক্লাসমেটরা সব যখন কম্পিউটার ও কোডিং-এর খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যস্ত, তখন তার ভালো লাগছে ফটোশপ ও আর্ট গ্যালারি। সাথে সমাজের “শুধু কার্টুন আঁকছ?” হেয় প্রতিপন্ন তো আছেই।

তন্ময় বুঝতে পারেন, আজকে তিনি সফল কার্টুনিস্ট তন্ময় হয়ে গেলেও তার বাধা-বিপত্তিগুলো এখনো হাজার হাজার উঠতি কার্টুনিস্টকে পার করতে হচ্ছে। ক্যারিয়ারের শুরুর প্রান্তে তার মাথার উপর ছায়া হয়ে দেখা দেন উন্মাদ-এর সম্পাদক আহসান হাবীব। তিনি টের পান যে তার গুরু হিসেবে আহসান হাবীব ছিল, অন্য সবার থাকে না।

“আমার ভিডিওটাও কিন্তু আসলে এই বিষয়েই ছিল। এই একজন আর্টিস্টকে উঠে আসার সাপোর্ট দেয়ার ব্যাপারে সমাজে যে একটা বিশাল ভ্যাকিউম, একটা বিশাল ফাঁকা জায়গা আছে, সেটা আমি আমার জীবনে বহুবার টের পেয়েছি। অন্যরাও পায়।

বাংলাদেশে কিন্তু কোনো পপ আর্ট , ইলাস্ট্রেশন, কার্টুন – এগুলোর মতো কমার্শিয়াল আর্টের কোনো ডেভেলপমেন্ট স্পেইস নাই। যারা পপ আর্ট নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের শেখার কোনো জায়গা নেই। কোথাও ইলাস্ট্রেশন পর্যন্ত শেখানো হয় না। কার্টুন আঁকা তো পরের বিষয়। এমন কী আমাদের চারুকলায়-ও এসব বিষয়ে কোনো কোর্স নেই।”

ঠিক এখান থেকেই কার্টুন পিপল-এর ধারণার জন্ম। তন্ময় ঠিক করেন, তিনি একটি কমিউনিটি গড়ে তুলবেন। যেই কমিউনিটিতে উঠতি কাটুর্নিস্টরা একটি গড়ে উঠার জায়গা পাবে। নতুন কার্টুনিস্টরা একে অন্যকে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ সেই কার্টুন পিপল চার বছরে পা দিয়েছে। একজন তন্ময়কে দিয়ে যেই কমিউনিটির শুরু, সেই কমিউনিটি আজ ৫০ হাজার মানুষের একটি পরিবার। ইন্সটাগ্রামে ৫০ হাজার ফলোয়ারের পাশাপাশি এখন ফেসবুক পেইজেও তাঁদের সাথে আছে ৭৬ হাজার মানুষ।

 

কার্টুন পিপল না হয়ে নাম হতে পারত কার্টুন ফ্যাক্টরি-ও!

“ভাই, মাথায় আইডিয়া আসতেই কাজ শুরু করে দিলেন?”

প্রশ্ন করতেই তন্ময় জানালেন, তার কাছে একটা আইডিয়া মানেই অনেক কিছু। “দেখো, আমরা তো কার্টুনিস্ট। প্রতিটি আইডিয়া কতটা শক্তিশালী হতে পারে, এটা আমরা জানি। একটি ভালো আইডিয়াকে কাজে লাগাতে আসলে শুরুতে শুধু একটি নাম আর একটি ভিজুয়্যাল থাকলেই হয়। তাই, শুরু করে দিলাম।”

শুরুতে ভাবনাটি জানালেন তখনকার তন্ময় কার্টুনস্‌ পেইজের ম্যানেজার বন্ধু আতা মজলিশ। আতা মজলিশও কাজ করতে রাজি হয়ে গেলেন। শুরু করতে তেমন কোনো ঝামেলা হয় নি। ততদিনে সুপরিচিত হয়ে যাওয়ার সুবাদে এবং উন্মাদ-এ কাজ করার সুবাদে অনেক তরুণ উঠতি কার্টুনিস্ট-ই নিয়মিত ধরা দেন তন্ময়ের কাছে। বড় ভাই হিসেবে তাদের উপদেশ দেন, কাউকে কাউকে পথ দেখিয়ে দেন। সেই বড় ভাই ভূমিকাটিকেই পাল্টে একটি কমিউনিটিতে রূপান্তর করলেন।

নামটা নিয়ে অবশ্য বেশ কিছুদিন দ্বিধায় ভুগেছিলেন। আতা অনেকগুলো নামের প্রস্তাব দিলেও সেগুলো পছন্দ হচ্ছিল না তন্ময়ের। কার্টুন ফ্যাক্টরি, কার্টুন ইনক্‌.-সহ আরো অনেক নাম-ই তখন মাথায় এসেছিল। শেষ পর্যন্ত কার্টুন পিপল শব্দযুগল নাম হিসেবে মনে ধরল তন্ময়ের।

“আসলে, ওই নামগুলোও কিন্তু ভালোই ছিল। কিন্তু একটা সমস্যা ছিল যে এগুলোর নামে সারা বিশ্বে আগে কিছু না কিছু হয়েছে। আর এই নামগুলোয় এটা যে একটা কমিউনিটি, সেই ব্যাপারটা ঠিক প্রকাশ পায় না। কার্টুন পিপল শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের এমন কিছু একটাই দরকার।

ঢাকা ট্রিবিউন সে সময় আমাকে খুবই সাহায্য করেছিল। আমার অফিসে তখন আমার কাজ দেখতে অনেক মানুষ আসত, তারা কখনোই কোনো কিছুতে আমাকে ‘না’ করে নি।”

এই শুরুর গল্পের কিছু অংশ জানা গেল উন্মাদ-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর এবং কার্টুন পিপল-এর এডভাইজার অনিক খানের কাছ থেকেও।

“চার বছর আগে দেখা গেল যে, তন্ময় একদিকে উন্মাদ, অন্যদিকে জাতীয় দৈনিকে পলিটিকাল কিংবা ­এডিটোরিয়াল কার্টুনিস্ট, তার সঙ্গে আজ ব্রিটেনের সঙ্গে তো কাল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা যৌথ কাজ করছেন। এর ভেতরেই তিনি নিজ গরজে, নিজ সময়ে, নিজের গ্যাঁটের পয়সায়, বাংলা ছবির প্রযোজকরা আগে যেমন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিত ‘নতুন মুখ খুঁজছি’, তেমনি ‘নতুন কার্টুনিস্ট খুঁজছি’ টাইপ ‘কার্টুন পিপল’ নামের একটা সংগঠন খুলে বসল। ধীরে ধীরে তার কিছু সঙ্গীও জুটে গেল উন্মাদের ভেতর থেকেই, যেমন এক সময়ে আরেক দুনিয়া কাঁপানো কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশু। কার্টুনিস্ট না হয়েও ‘এডভাইজার’ হিসাবে আমিও তার ঘাড়ে চেপে বসলাম। আর মাথার উপর আমাদের সবারই ‘দি বস্’ আহসান হাবীব তো আছেনই সবসময়। বাইরে থেকেও অল্প ক’জন জুটলো।”

তন্ময় শুরুটা করলেন ‘স্কেচবুক স্যাটারডে’ নামের একটি কর্মসূচির মাধ্যমে। প্রতি শনিবারে বিভিন্ন এলাকায় একত্রিত হওয়া শুরু করেন কার্টুন পিপল-এর কার্টুনিস্টরা। রাস্তায় মানুষকে দেখে দেখে তাদের কার্টুন আঁকার চেষ্টার নামেন তারা।

স্কেচবুক স্যাটারডে

এই স্কেচওয়াক শুরু করার পিছেও অন্যরকম একটি যুক্তি ছিল তাঁর, “আসলে আমাদের দেশে কার্টুনিস্টরা বা অনেক আর্টিস্টরাই আঁকার সময়ে গুগল দেখে বা অন্যের কাজ দেখে অনুপ্রেরণা নিয়ে আঁকেন। কার্টুন বা আর্ট তৈরির পিছনে একটা অবজার্ভেশনের বিষয় আছে, এটাই হারিয়ে যায়। অনেক সময় এই কারণেই আমাদের কার্টুনিস্টদের স্বকীয়তা তৈরি হয় না। এই চিন্তা থেকেই স্কেচবুক স্যাটারডে-এর শুরু। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবজার্ভ করে আঁকতে হলে তোমাকে নিজস্ব স্বকীয়তা কাজে লাগাতে হবেই।”

স্কেচবুক স্যাটারডে এখনো কার্টুন পিপল-এর অন্যতম নিয়মিত বড় ইভেন্টগুলোর একটা। কার্টুন পিপল-এর হেড অফ এক্সিকিউটিভ কমিটি মোরশেদ মিশু জানান,

“অদ্ভুত ব্যাপার হলো, গত ৪ বছরে, করোনার আগ পর্যন্ত, খরা রোদ, ঝড় বৃষ্টি কোন কিছুই কার্টুন পিপলের ‘স্কেচবুক স্যাটারডে’ আটকাতে পারেনি। প্রতি শুক্রবার গ্রুপে লোকেশন এবং সময় দেখে যে যার মত স্কেচবুক নিয়ে হাজির হয়ে যেত ‘স্কেচবুক স্যাটারডে’ তে। আঁকা শেষে আবার সবাই সবার স্কেচবুক একজন আরেকজনকে দেখিয়ে মতামত এবং মন্তব্য নেয়া হয়, ইম্প্রুভমেন্টের জায়গা ধরিয়ে দেয়া হয়। বাসায় পৌঁছে সবাই সবার খাতার ছবি তুলে গ্রুপের এলবামে আপলোড করার মাধ্যমে শেষ হয় একেক সপ্তাহের ‘স্কেচবুক স্যাটারডে’। সব স্বাভাবিক হলে কিংবা নিউ নরমাল কোন উপায়ে হয়তো শীঘ্রই আবার শুরু হবে কার্টুন পিপলের ‘স্কেচবুক স্যাটারডে’।”
স্কেচবুক স্যাটারডে শুরু করার পরপরই দারুণ সাড়া তুলল। কিন্তু বেশ কিছুদিন চলার পর তন্ময়ের মনে হতে লাগল, যেই কমিউনিটির চিন্তা নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন, সেই কমিউনিটি যেন বেশ ধীর গতিতে তৈরি হচ্ছে। স্কেচবুক স্যাটারডে নিয়েও ছোটখাট কিছু সমস্যা দেখা গেল। যেমন এক এলাকায় গেলে তা থেকে দূরের এলাকার মানুষদের সমস্যা হয়। তাই প্রায়ই দেখা যেত, অনেকে আসতে চাইলেও যাত্রার সমস্যার কারণে যোগ দিতে পারত না তারা।

তখন তন্ময় একটি ইউটিউব চ্যানেল করার কথা ভাবলেন। ততদিনে তার সাথে যোগ দিয়েছেন আরো অনেকেই। “তখনও আমরা এগুলোর বিষয়ে তেমন কিছুই জানি না। প্রায় ৮ মাস কাজ করে ৭টি ভিডিও বানালাম, সেখান থেকে দারুণ রেসপন্স আসল। কারণ এর আগে বাংলায় এমন টিউটিরিয়াল কেউই বানায় নি।”

স্কেচবুক স্যাটারডে তো চলছিল-ই, তার সাথে ইউটিউব যোগ হওয়াতে আরো বড় হতে লাগল কার্টুন পিপল। বাংলা কার্টুন টিউটোরিয়াল তৈরির এই কাজে তখন তন্ময়ের সাথে ছিলেন কার্টুনিস্ট হাসিব কামাল, রাকিব, রায়হান-সহ আরো অনেকেই।

তবে সবচেয়ে বড় কৃতিত্বটা বোধহয় এতদিন ধরে প্রতি সপ্তাহে স্কেচবুক স্যাটারডে চালিয়ে নেয়া। শীত হোক কিংবা গ্রীষ্ম বা বর্ষা, প্রতি শনিবার বিকেল ৪টায় এই আঁকাআঁকির আড্ডা চালিয়ে নেয়ার পেছনে আছেন ডেইলি স্টার-এর কন্ট্রিবিউটর কার্টুনিস্ট ঐশিক জাওযাদ, জুনায়েদ ইকবাল ইশ্মাম, রেহ্নুমা প্রসূন-সহ আরো অনেক কালপ্রিট!

 

এত কিছু, কিন্তু কেন?

এই যে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এত কিছু, কেন করেছেন তন্ময়? আর্টিস্ট হলেও তো প্রতিটা কিছুর থেকেই সাধারণত মানুষের একটা চাওয়া পাওয়ার জিনিস থাকে, তাঁর কি এমন কিছুই ছিল না?

“আমি বিশ্বাস করি যে মানুষের কোনো প্রকারের নিঃস্বার্থ কাজ আসলে দিনশেষে তেমন ভালো কিছু বয়ে আনে না। মানুষ তখনই খুব মন দিয়ে কাজ করে, যখন সেখান থেকে সে কিছু একটা ফেরত পায়। আমার অনেক কাজ, এর মাঝে কার্টুন পিপল-এর পিছনে দেয়া সময়টা পুরোপুরি-ই নষ্ট হলে তো একসময়ে কাজ করতে আমার আর ভালো লাগবে না।”

“তাই ফেরত পাওয়ার একটা বিষয় আসলে ছিল, এবং সেটা হচ্ছে সেল্ফ ডেভেলপমেন্ট। এই কমিউনিটির মধ্যে দিয়ে আমি নতুনদের জন্য যেমন একটি গড়ে উঠার জায়গা তৈরি করতে চেয়েছি, ঠিক তেমনি নিজের ভালো হওয়ারও একটা জায়গা রাখতে চেয়েছি। স্কেচবুক স্যাটারডে-তেও কিন্তু এই ভাবনার একটা প্রভাব আছে। শুরুতে একটা ইনসিকিউরিটি কাজ করত, যে মানুষ হবে নাকি না। তখন ভেবেছি যে আচ্ছা, মানুষ না হলেও সমস্যা নেই। যেই দুই ঘণ্টা আমি মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে তাদেরকে আঁকতে সাহায্য করতাম, কেউ না আসলে সেই দুই ঘন্টায় শুধু আমি আঁকব।

শেষ পর্যন্ত অনেকে এসেছিল, কিন্তু শুরুতে এমন একটা ভাবনাও কাজ করেছে।”

কার্টুন পিপল কমিকস

সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়ের কথা শুনে বোঝা যায়, কার্টুন পিপল তৈরির পিছনে আসলে দুটি বিষয় সরাসরি কাজ করেছে। প্রথমত, কার্টুনিস্টদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, উঠতি কার্টুনিস্ট থেকে শুরু করে পেশাদার কার্টুনিস্টদেরকেও একই কমিউনিটির মধ্যে নিয়ে এসে একটি গড়ে উঠার, ভালো করার জায়গা দেয়া। যেখানে একই সাথে মোরশেদ মিশু কিংবা সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়রা সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, ঠিক সেখানেই স্কুল পড়ুয়া একজন শখের কার্টুনিস্টও দারুণভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন।

কার্টুন পিপল ঠিক এখানে এসেই অন্য সব কিছুর থেকে আলাদা হয়ে যায়।

 

হাঁটি হাঁটি পা পা করে চার বছর, এবং ৫০ হা-জা-র ফলোয়ার!

২০১৬-এর সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে শুরু। প্রথম স্কেচওয়াকে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যাটি সম্ভবত কোনোভাবেই তিন ঘরের অঙ্ক ছাড়ায় নি। তখন কী তন্ময় ভাবতে পেরেছিলেন, একদিন তাঁর হাতে গড়া এই কমিউনিটিতে ৫০ হাজার মানুষ থাকবে? বোধহয় না।

সাফল্যটা অভাবনীয়। কার্টুন পিপলের এডভাইজার অনিক খান যেমন খুব মজা করেই বললেন, আমি এখানে দুইটা বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করব। কার্টুনিস্ট তন্ময়ের দাবী কার্টুন পিপলের আজ চার বছর পূর্তি। আই স্ট্রংলি প্রোটেস্ট! গত চার বছরে দুই-চার-দশজন নিয়ে শুরু করে আজ তার সদস্য সংখ্যা ৭৬ হাজার! গত চার বছরে তাদের যত কমর্কান্ড, যত উদ্যোগ, যত নতুন তরুন-কিশোর ছেলে মেয়ে কার্টুনিস্টদের জন্ম দেয়া, যত কাজ, যত আয়োজন, এবং রীতিমতো পদ পদবী দেয়া একটি ওয়ার্কিং কমিটি-সহ সব মিলিয়ে এটা সাধারণ বর্ষপূর্তি নয় – এটা কার্টুন পিপলের চার বছরের সাফল্যপূর্তি। এই শব্দ বাংলা একাডেমি মেনে নিবে কি না জানি না। না মানলেও আমি এটাই বলবো, একজন ছড়াকার হিসাবে এটা আমার পোয়েটিক লাইসেন্স।”

তন্ময় আবার ব্যাপারটিকে খুবই সাধারণভাবেই দেখছেন। “আসলে আমরা ছোট ছোট স্টেপ নিয়ে এগিয়েছি। মানে প্রতিবছরই নতুন কিছু একটা শুরু করা। একটা নতুন ইভেন্ট, নতুন ক্যাম্পেইন। প্রতিটি ক্যাম্পেইন কিছু কিছু মানুষ আমাদের এনে দিয়েছে।”

সবমিলিয়ে এখন কার্টুন পিপল পাঁচটি ইভেন্ট নিয়মিত পরিচালনা করে। স্কেচবুক স্যাটারডে এবং ইউটিউব তো আছেই। এর সাথে যোগ হয়েছে দেশি ক্যারেক্টার ডিজাইন চ্যালেঞ্জ (ডিসিডিসি), সুপার হিরো ক্যারিকেচার, এবং ইন্স্টাগ্রামে কার্টুন পিপল কমিকস্-এর পেইজে কার্টুন স্ট্রিপ পাবলিশ করা।

চার বছরে পা দেওয়ার এই ক্রান্তিকালে এসে কার্টুন পিপল ফেরত যেতে চেয়েছে তাদের শুরুর উদ্দেশ্যে। তাদের সপ্তাহব্যাপী উদযাপনের মূল উদ্দেশ্যেই ছিল মানুষের জন্য কার্টুনকেন্দ্রিক শিক্ষাকে আরো দারুণভাবে তুলে ধরা।  তাই সাত দিনে সাতটি লাইভ সেশনের মধ্যে দিয়ে তারা উদযাপন করেছে তাদের বর্ষপূর্তিকে। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে প্রথম সেশনে গালর্স ডু কমিকস-এ কমিকস নিয়ে কথা বলেছেন ছয়জন নারী কার্টুনিস্ট। পরের পাঁচ দিনে পাঁচটি সেশনে লাইভ টিউটোরিয়াল হয়েছে কমিক, কালারিং, ক্যারেক্টার ডিজাইন, বাচ্চাদের বুক এনিমেশন ও ক্যারিকেচার নিয়ে। ১৯ সেপ্টেম্বর শনিবার ইন্স্টাগ্রাম লাইভে কার্টুন পিপল ক্রুয়ের সাথে দর্শকদের আলাপনে শেষ হয়েছে সপ্তাহব্যাপী উদযাপন। সেই লাইভে অংশগ্রহণ করেছেন প্রায় দু’হাজার মানুষ।

“এই করোনার সময়ে যে মানুষ একটা মানসিক চাপের মধ্যে আছে, সেটা কিছুটা দূর করতেই আমরা ভেবেছিলাম যে যত সমস্যাই থাকুক, আমরা দারুণভাবে উদযাপন করব। এর পাশাপাশি আমরা দেখছি যে করোনা মানুষকে আরো বেশি অনলাইন নির্ভর হতে বাধ্য করেছে, তাই আমাদের মনে হয়েছিল যে অনলাইনে এমন কিছু করার এটাই সময়,” তন্ময় জানান।

চার বছর শেষে তাদের দ্বিতীয় ফেইজে প্রবেশ করতে যাচ্ছে কার্টুন পিপল। এতদিন ধরে কার্টুন চর্চার ফলটা দেখা যাচ্ছে এখন এসে। আগামি ফেব্রুয়ারিতে তারা নিজেদের পাবলিকেশন শুরু করতে যাচ্ছে, যেখানে কাজ করবে কমিউনিটিতে গড়ে উঠা কার্টুনিস্টরাই। শখের কমিউনিটি শীঘ্রই পরিণত হচ্ছে যাচ্ছে পেশাদার প্ল্যাটফর্মে।

সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময় ও তার কার্টুন পিপল ক্রু যেন কবীর সুমনের গান থেকে উঠে আসা বাঁশুরিয়ার দল। তাদের কার্টুন ও ক্যারিকেচার এই ইটপাথরের যান্ত্রিক ধোঁয়ার শহরে বাঁশির সুরের মতোই মনে হয়। তারা আঁকেন, আর আমরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি।

 

Share this Article
Leave a comment