স্মরণে প্রীতিলতা: দেশপ্রেমের এক পরম দৃষ্টান্ত

Editor
5 Min Read
Designer: Artijwa Prothian Abdhi

জান্নাতুন নাঈম অর্ণব


চট্টগ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ছোটবেলা থেকেই তার মেধার প্রখরতার জন্য দৃষ্টি কাড়েন ডা: খাস্তগির বালিকা বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা ঊষা দাশগুপ্তের। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাঈয়ের ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস শোনাতেন। প্রীতিলতা তখন সবে দশম শ্রেণির ছাত্রী। লক্ষ্মী বাঈয়ের জীবনী তাঁর মননে গভীর প্রভাব ফেলে। মূলত এর মাধ্যমেই প্রীতিলতার মাঝে সর্বপ্রথম বিপ্লবী চেতনার স্ফুরণ ঘটে। এ প্রসঙ্গে প্রীতিলতার সহপাঠী ও বিপ্লবী কল্পনা দত্ত তাঁর স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে বলেন,

“কোনো কোনো সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রাণী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।”

তবে ইডেন কলেজে পড়াকালীন সময়ে প্রীতিলতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হন। সে সময় তাঁর পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লীলা নাগের সাথে, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সুভাষ চন্দ্র বোসের সক্রিয় সহযোগী ছিলেন। লীলা নাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দীপালি সংঘ’, যার মাধ্যমে নারীদের সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। দীপালী সংঘে যোগ দেয়ার মাধ্যমেই মূলত প্রীতিলতার বিপ্লবী জীবনের সূচনা হয়।

এর কিছুদিন পর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেথুন কলেজে দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা শহর। কলকাতায় এসে প্রীতিলতার পরিচয় হয় কিংবদন্তী বিপ্লবী নেতা সূর্য সেনের সাথে, যাকে সহযোগীরা শ্রদ্ধাভরে ডাকতেন ‘মাস্টারদা’ নামে। সূর্য সেনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রীতিলতা তাঁর গোপন বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। যদিও অনেক বিপ্লবী শুরুতে তাঁর অংশগ্রহণ নিয়ে জোর আপত্তি তোলেন, কিন্তু মাতৃভূমির প্রতি প্রীতিলতার গভীর নিষ্ঠা এবং পুলিশের অগোচরে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তাঁর সাহসী ভূমিকা শুরুর দিকের আপত্তিকে ক্রমেই ম্লান করে দেয়। 

১৯৩০ সালে এপ্রিল মাসে মাস্টারদা সূর্য সেন ‘চিটাগং রয়্যাল আরমারি’ লুটের পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনায় মাস্টারদা প্রায় ৬৫ জন তরুণকে নিয়ে একটি দল গঠন করেন, যার মধ্যে ২০ বছর বয়সী প্রীতিলতাও ছিলেন। যদিও পরবর্তী সময়ে তাদের এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, কিন্তু তারা বেশ কিছু টেলিগ্রাফ লাইন ধ্বংস করতে পারেন ছিল—যা ছিল প্রীতিলতার জীবনের প্রথম সশস্ত্র অভিযান। এ অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় মাস্টারদার দলের কতিপয় বিপ্লবী ব্রিটিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হন, যার ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যক্রম বেশ স্থিমিত হয়ে পড়ে। দলের এমন ক্রান্তিলগ্নে প্রীতিলতা বহু প্রতিকূলতার মাঝে দলকে পুনর্গঠন করেন, যা মাস্টারদা সূর্য সেনকে বেশ চমৎকৃত করে।

১৯৩২ সালে মাস্টারদা পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলার নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে এ অভিযানে নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবটি ছিল ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের বর্ণবাদী এবং বৈষম্যমূলক আচরনের চূড়ান্ত প্রদর্শনী। এটি ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশের অনুমতি নেই’ সাইনবোর্ডটির কারণে ইতিহাসের পাতায় আজও কুখ্যাত।

প্রীতিলতার নেতৃত্বে দশজনের একটি গেরিলা দল গঠন করা হয়। অভিযানটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে দলের প্রত্যেককেই পটাশিয়াম সায়ানাইড দেয়া হয়েছিল। তাদের দেশপ্রেম এতটাই গভীর ছিল যে ব্রিটিশদের কাছে বন্দী হওয়ার চেয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দেয়াই তাদের নিকট শ্রেয় ছিল। 

 

১৯৩৩ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর, রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে মুহুর্মুহু গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা পাহাড়তলী। আতঙ্কিত ইংরেজদের চিৎকারে যেন নরকে পরিণত হয় ইউরোপিয়ান ক্লাবটি। অভিযানটির প্রায় শেষের দিকে প্রহরীদের একটি বুলেট প্রীতিলতার বাম বাহু ভেদ করে চলে যায়। গুলিবিদ্ধ হবার কারণে প্রীতিলতা দলের অন্যদের সাথে যেতে পারেন নি। এ অবস্থায় গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান এ বীরনারী। 

 

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবাশবাদবিরোধী আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসে রয়েছে অজস্র আত্মত্যাগের ঘটনা। কিন্তু প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের এমন বীরত্ব নিঃসন্দেহে চিরগৌরবের। প্রীতিলতার মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের অবস্থা নিয়ে কল্পনা দত্ত লিখেছিলেন,

“প্রীতির বাবা শোকে দুঃখে পাগলের মতো হয়ে গেলেন, কিন্তু প্রীতির মা গর্ব করে বলতেন, “আমার মেয়ে দেশের কাজে প্রাণ দিয়েছে।” তাঁদের দুঃখের পরিসীমা ছিল না, তবু তিনি সে দুঃখেকে দুঃখ মনে করেন নি।”

ময়নাতদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না, বরং পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ। তিনি চাইলেই ধরা দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজ জীবনের বিনিময়ে হলেও ইংরেজ উপনিবাশবাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল পরতে চান নি। যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা হয়তো তিনি দেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু প্রীতিলতা আজও প্রাসঙ্গিক, তাঁর অবদান ও কৃতিত্ব সর্বদাই আমাদের দেশের স্বার্থে আত্মনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করবে। আবার, নারীদের দেশরক্ষায় আত্মনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার পথিকৃৎ-ও কিন্তু প্রীতিলতা-ই। 

আজ ২৩শে সেপ্টেম্বর এই মহান বীরের মৃত্যু দিবস। এই দিনে তাঁকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধার সাথে। 

 

Share this Article
Leave a comment