আয়ান শামস সিদ্দিকী
মূলধারার গণমাধ্যম সবসময়ই বিভিন্ন বিষয়ে সমাজের ধারণা তৈরিতে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে কোনো বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে সমাজে কিভাবে দেখা হয়, সেই ধারণা তৈরিতে কিংবা বদলাতে গণমাধ্যমের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে। একটি সম্প্রদায়কে গণমাধ্যমে যেভাবে দেখানো হয়, তার ভিত্তিতে মানুষের মাঝে সেই সম্প্রদায়ের ব্যাপারে মতামত গঠনের একটি বিশেষ প্রবণতা দেখা যায়।
যে যুগে চলচ্চিত্র, টিভি সিরিজ, বই ও সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট তথ্যের মূল উৎস হিসেবে কাজ করে, সে যুগে কোনো কিছুর ত্রুটিপূর্ণ উপস্থাপনা ও প্রতিনিধিত্বের অভাব — দুটোই সমাজে প্রচণ্ড ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া সম্প্রদায়ের ব্যাপারেও বিষয়টা প্রায় একইরকম। মূল গণমাধ্যমে তাদের যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের ব্যাপারে মানুষের অনুভূতি ও মতামত গঠনে শুরু থেকেই বিশাল ভূমিকা রেখে আসছে।
লাইভসাইন্স-এর মতে, “ট্রান্সজেন্ডার হলো একটি সর্বজনীন টার্ম, যা এমন মানুষদের নির্দেশ করে যাদের লিঙ্গ পরিচয় বা সেই পরিচয়ের প্রকাশ তাদের জন্মের সময়ে নির্ধারিত লিঙ্গের সাথে মিলে না।”
হিজড়া বাংলাদেশের একটি স্থানীয় সম্প্রদায়, যার অধিকাংশই ট্রান্সজেন্ডার (সহজ বাংলায়, রূপান্তরিত লিঙ্গ) মানুষদের নিয়ে গঠিত। ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘বিস্মৃত শ্রেণি’ হিসেবে দেখা হয়। হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা সংবিধানমতে কিছু আইনি অধিকার স্বীকৃতি পেলেও তাদের ‘সমাজচ্যুত’ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তারা সমাজের ‘অনুমোদিত’ লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই তাদেরকে হেয় করা-ই যায়। কুসংস্কারযুক্ত সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি আমাদের দেশে এত বেশি যে ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা জনপ্রিয় মিডিয়াগুলো থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেন।
গণমাধ্যমে কোনো গোষ্ঠীকে কিভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা বোঝা যায় সেই গোষ্ঠীর প্রতি সমাজের ধারণার মধ্যে দিয়ে। ভুল কিংবা অযথাযথ উপস্থাপনার ফলে ঐ পুরো সম্প্রদায়কেই সমাজে বিদ্বেষ ও প্রচলিত নেতিবাচক সংস্কারের প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে হয়।
কিন্তু কী ঘটে, যখন তাদের একেবারেই উপস্থাপন ও চিত্রায়ণ না করা হয়?
জনপ্রিয় মিডিয়াতে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের বর্ণনা ও উপস্থাপনা চূড়ান্ত পর্যায়ে ত্রুটিপূর্ণ হয়ে আসছে। ঐতিহাসিকভাবেই পশ্চিমা কল্পসাহিত্যে ও টেলিভিশন মিডিয়ায় ট্রান্সজেন্ডার চরিত্রগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বাঁধাধরা নেতিবাচক রূপ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো কোনোভাবেই ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা কিংবা জীবনধারার সঠিক প্রতিফলন ঘটায় না।
স্থানীয় প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, হিজড়া সম্প্রদায়ের মিডিয়াতে উপযুক্ত উপস্থাপনা খুবই কম দেখা গেছে। প্রথমত, এই সম্প্রদায়ের মানুষদের যতটুকু তুলে ধরা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই যথেষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, এই স্বল্প চিত্রায়ণের বেশিরভাগই আবার ভুলভাবেই করা হয়েছে। উপস্থাপনের কথা আসলে আমাদের মাথায় রাখা দরকার যে, এই ধরনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের উপস্থাপনার ক্ষেত্রে যত্নশীল ও বিশ্লেষণধর্মী চরিত্রায়ণ প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ব্যাপারে ঠিকঠাক গবেষণা না করে যত্নবান না হলে শেষ পর্যন্ত মামুলি বাঁধাধরা চিত্রায়ণের মধ্যেই আটকা পড়তে হয়।
গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৪ অনুযায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে লিঙ্গ বৈষম্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। লিঙ্গ বলতে সাধারণত আমাদের দেশে শুধু পুং লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ-ই নির্দেশ করা হয়। জনপ্রিয় সংবাদ ও মিডিয়া পোর্টাল থেকে শুরু করে মূলধারার তথ্য প্রচার মাধ্যম — সবখানেই লিঙ্গ কেবল পুরুষ এবং স্ত্রী-তেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশী মিডিয়ায়তৃতীয় লিঙ্গের (বাইনারি লিঙ্গ ছাড়া অনান্য লিঙ্গের মানুষদের আঞ্চলিকভাবে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়) মানুষদের স্থানীয় চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক, বই ও খবরের রিপোর্ট হতে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি বরং প্রচলিত।
তাই হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপদ একটি সমাজ গঠন করতে চাইলে মিডিয়াতে তাদের অপর্যাপ্ত উপস্থাপনা কীভাবে প্রভাব ফেলে, সেটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের নিয়ে বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে কেবল দুইটি বই, একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ও হাতেগোনা কিছু ত্রুটিযুক্ত নাটক হয়েছে। যে দেশে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১০ লক্ষ ট্রান্স নারী-পুরুষ ও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস, সেখানে এই সংখ্যা তাদের প্রতি সমাজের বৈষম্যেরই যেন প্রতীক। লিঙ্গ সম্প্রদায়গুলোকে মিডিয়ায় ঠিকভাবে চিত্রায়ণ না করলে সেসব সম্প্রদায় সমাজে ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
২০১৪ সালের ২৬শে জানুয়ারি বাংলাদেশ ক্যাবিনেট হিজড়া সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু হিজড়া হিসেবে পরিচয় পাওয়ার নির্দিষ্ট যোগ্যতার একটি অস্পষ্ট নীতিমালা আসলে এই সম্প্রদায়ের প্রতি ভালো কিছু বয়ে আনে নি। বরং সম্প্রদায়টির প্রতি নিরন্তর নির্যাতনে আরো ইন্ধন জুগিয়েছে।
বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ইস্যু করার কারণে হিজড়া মানুষদের প্রতি যৌন হয়রানি ও নির্যাতন বেড়েছে। এমন অবস্থার পেছনে একটি প্রধান কারণ হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায় ট্রান্সজেন্ডার ও নন-বাইনারি মানুষদের বিবরণের অভাব। ট্রান্সজেন্ডার ও অন্যান্য নন-বাইনারি মানুষদের নিয়ে গঠিত হিজড়া সম্প্রদায় সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা কেবল তাদের ঘিরে শোচনীয় ট্যাবু ও কলঙ্ককে প্রকট করে তোলে। তাই জনসাধারণকে ট্রান্স ও নন-বাইনারি মানুষদের ব্যাপারে সচেতন করতে মিডিয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণে তাদের প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন।
বেড়ে উঠার সময় শিশুরা যখন হিজড়া সম্প্রদায়ের সাথে পরিচিত হয়, তখন তারা শিখে যে হিজড়ারা ঘৃণার যোগ্য এবং তাদের ভয় পেতে হয়। এই ধরনের শিক্ষা একপর্যায়ে শিশুদের মনে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার উৎপত্তি ঘটায়। শিশুদের উদ্দেশ্যে বানানো বহু শো এবং দেশীয় কন্টেন্টের মাঝে মধ্যে এমন একটি শো-ও নেই, যা বিবিধ লিঙ্গের মানুষদের জীবন তুলে ধরে। নিয়মিত চলে আসা ট্যাবু বদলানোর জন্য মিডিয়া আউটলেটগুলোয় এসকল সম্প্রদায়ের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব একটি দারুণ পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে।
সমগ্র হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি অমানবিক আচরণের অন্যতম কারণ হচ্ছে মিডিয়ায় তাদের প্রতিনিধিত্বের অভাব। সম্প্রদায়টি নিয়ে জনসাধারণের সঠিক জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে হিজড়া সম্প্রদায় সমাজ কর্তৃক নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হয়ে থাকে। সমাজ মেনে নিবে না, এই ভয়ে বহু হিজড়া মানুষ তাদের লিঙ্গপরিচয় প্রকাশ করে না।
তাদের অধিকাংশকেই ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। যাদের দেওয়া হয় না, তাদের নির্যাতন সহ্য করতে, নিজের প্রকৃত লিঙ্গপরিচয় লুকিয়ে রাখতে বাধ্য করা হয়। তাই এই সমাজকে হিজড়াদের জন্য নিরাপদ বানাতে, তাদের জীবনকে একটু সহজ করতে মিডিয়া কীভাবে প্রভাব ফেলে বা ফেলছে, সেটা ভাবতে গেলে চিন্তিত হতে হয়।
গবেষণাপত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, বিভিন্ন বিনোদনমূলক মিডিয়া কাল্পনিক চরিত্রগুলো বাস্তব জীবনের নিরিখে গড়ে তুলে। একটি চরিত্রকে কীভাবে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে, তা দর্শকের উপর বিশাল প্রভাব রাখে। দর্শক তার ভিত্তিতে নিজেদের মতাদর্শ গড়ে তোলে। এভাবে তারা অসাবধানতাবশত ভুলভাবে উপস্থাপিত গোষ্ঠী সম্বন্ধে অযৌক্তিক ও অসত্য অনুমান স্থাপন করে, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এই মিথ্যা অনুমানের আগুনে পরিমাণমতো ঘি ঢাললে ঠিকই তা একসময় কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে বিরাজ করবে। যেহেতু মিডিয়া আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই আমাদের জীবন এর দ্বারা এত গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে যে যেকোনো পরিবেশ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ত্রুটিপূর্ণ উপস্থাপনা আমাদের সে সম্পর্কে চরম মন্দ ধারণা পোষণের দিকে ধাবিত করতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ উইন্ডসর কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণাপত্রের বিবৃতি হতে জানা যায়, “বিষয়বস্তুর ও জটিল প্রবন্ধের বিশ্লেষণের সংযোগ ব্যবহার করে প্রদর্শনীর বিস্তীর্ণ শ্রেণিবিন্যাস বিশ্লেষণ শেষে ফলাফল দেখায় যে, ট্রান্সজেন্ডার চরিত্রগুলো প্রায়শই কৌতুকের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। আর এই কৌতুকগুলো কেবল তাদের ‘আশ্চর্যজনক’ লিঙ্গপরিচয়ের উপর নির্ভরশীল। আবার, তাদের লিঙ্গপরিচয়কে মানসিকভাবে অস্থিতিশীল ও অপ্রত্যাশিত হিসেবে প্রদর্শন করা হয়, যা প্রায়শই তাদের বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী, উন্মাদ ও অত্যাচারী হিসেবে নির্দেশ করে।”
বাংলাদেশে হিজড়া ব্যক্তিবর্গের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধানত অতিরঞ্জিত আচরণ ও কৌতুক উদ্দীপনার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়, তাদের চরিত্রের গভীরতা বলতে গেলে প্রদর্শন-ই করা হয় না। এ ধরনের নেতিবাচক রূপায়নের সমস্যা বহুবিধ।
প্রথমত, এই প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর বিষয়ে মত গঠন করার ক্ষেত্রে তাদেরকে বোঝার ও জানার ঘাটতি মিডিয়ায় প্রদর্শিত বাঁধাধরা চিত্রের প্রতি মানুষকে অধিকতর নির্ভরশীল করে তোলে। অর্থাৎ, জনপ্রিয় মিডিয়াগুলো ত্রুটিপূর্ণভাবে প্রদর্শন করলে যে ব্যক্তির এ সংক্রান্ত স্পষ্ট ধারণা নেই, সে ঠিকই ভ্রান্ত বিশ্বাসের চক্রে আবদ্ধ থাকবে। আর সে ভিত্তিতে গঠিত মত হবে অত্যন্ত পক্ষপাতী, যা সেই সম্প্রদায়ের প্রকৃত আদর্শের প্রতিফলন ঘটাবেই না, বরঞ্চ তাদের মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অধিকারে বাধা দেওয়াকেই স্বাভাবিক মনে করবে।
গবেষণায় দেখা যায়, উল্লিখিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মানুষদের মানুষ হিসেবে গণ্য না করা — নৈতিক সহিংসতায় ভূমিকা রাখে। কারণ অপরাধীরা বুঝে শুনে এমন মানুষদের ক্ষতি করতে ইচ্ছা পোষণ করে, যাদের তারা তিরস্কারের ও দুর্ভোগ পোহাবার যোগ্য বলে মনে করে। অর্থাৎ যারা সক্রিয়ভাবে হিজড়াদের শারীরিক, বাচনিক ও/কিংবা যৌন নির্যাতন করে, তাদের মাঝে কোনো নৈতিক অপরাধবোধ কাজ করে না। কারণ তারা মনে করে, হিজড়া মানুষদের এই সহিংসতা প্রাপ্য।
দ্বিতীয়ত, মিডিয়ার গোঁড়া উপস্থাপনা সম্পূর্ণ সম্প্রদায়কেই কলঙ্কিত করে। এমন কলঙ্ক সাধারণত ট্রান্স ও নন-বাইনারি মানুষদের প্রকাশ্যে লিঙ্গপরিচয় জানাতে বাধা প্রদান করে। “স্বাভাবিক” লিঙ্গপরিচয়ে অনুবর্তী না হওয়ায় ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা ভয় ও সন্দেহে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মিডিয়ায় ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের প্রচলিত চিত্রায়ণের ফলে হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের অপমান, প্রত্যাখ্যান ও লজ্জায় নিজেদের লিঙ্গপরিচয় প্রকাশ করতে ভয় পায়।
সংকীর্ণমনা সমাজ হতে প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি ট্রান্স ও নন-বাইনারি মানুষেরা কদাচিৎ তাদের পরিবারের সমর্থন পেয়ে থাকে—কিছুটা সামাজিক মর্যাদা বজায়ের ধারণার কারণে, কিছুটা কট্টর ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে। তারা নিজ গৃহেই সহিংসতা ও গোঁড়ামির মুখোমুখি হয় এবং নিজেদের প্রকৃত পরিচয় লুকোতে ও দমিয়ে রাখতে বাধ্য হয়।
সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যান হতে জানা যায়, গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের ব্যবহার শীর্ষে (৮০ শতাংশের অধিক)। ফলে বাংলাদেশে টেলিভিশন মিডিয়া যে তথ্য ও সংস্কৃতির প্রসারে অখণ্ড ভূমিকা পালন করে, এ ধারণা প্রমাণিত হয়।
এজন্যই গণমাধ্যমে ভুলভাবে হিজড়া সম্প্রদায়কে উপস্থাপন করলে জনসাধারণের নিকট ভুল তথ্য পৌঁছায়। কৌতুকপ্রদ চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে নাটকে লিঙ্গবৈচিত্র্যের নেতিবাচক চিত্রায়ণ সমাজে গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে।
তবুও অনিশ্চয়তার মেঘের ফাঁকে আশার সূক্ষ্ম কিরণ এখনও রয়েছে। কমন জেন্ডার (২০১২) (ডলি জহুর ও চিত্রলেখা গুহ কর্তৃক অভিনীত) হচ্ছে এমনই এক অগ্রণী বাংলাদেশী চলচ্চিত্র, যা হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবন ফুটিয়ে তোলে। আবার, এ চলচ্চিত্রটির অন্যতম হওয়ার কারণ হচ্ছে এতে প্রধান চরিত্র দুটিই ট্রান্সজেন্ডার মানুষ। এটি বাংলাদেশে বসবাসকারী ট্রান্সজেন্ডার মানুষের জীবনের সারভাগ—তাদের দৈনিক সংগ্রাম, তাদের প্রতি মানুষের গোঁড়া আচরণ, অবহেলা ও সহিংসতাকে প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলে।
এছাড়াও সেলিনা হোসেনের লেখা দুইটি বই হিজড়া শব্দকোষ এবং রূপান্তরিত মানুষের গল্প — একটি বিশ্লেষণী দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে বসবাসকারী ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে।
হিজড়া সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক বহিষ্করণকে বাংলাদেশের মূলধারার হেটেরো-নরম্যাটিভ সমাজে খুব স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখা হয়। হিজড়ারা জীবনের প্রতিটি পদে বৈষম্যের শিকার হয় — তা সে কর্মসংস্থানের সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি কিংবা সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ হোক না কেন। আইন সংশোধনের পাশাপাশি মূলধারার মিডিয়া আইনি-স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রচারে ও স্বাভাবিকীকরণে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতে পারবে।