সৌগত দেবনাথ
ধর্ষণ রোধে আসলে মানবসভ্যতাকে বিলুপ্ত করার বিকল্প মনে হয় নেই। একে অপররে নিউক করে মরে যাওয়াই একমাত্র সমাধান। কারণ এই সভ্যতার শুরুটাই হয়েছে একদম ভুল জায়গা থেকে। আর এই ভুলটাকে আমরা ডিফল্ট সেটিং হিসেবে ধরে নিয়েছি দীর্ঘদিন ধরে।
আপনারা আদিকালের ইতিহাস পড়েছেন, ইশকুলে থাকতে সেই মুখস্থ পড়া সমাজ পরীক্ষা দিতে গিয়ে খাতায় বমি করে এসেছেন। আপনাকে বিদ্যালয় শিখিয়েছে নারীরা কৃষিকাজ আবিষ্কার করেছে, আপনার পূর্ব’পুরুষের’ সাথে শিকারে গেছে বনবাদাড়ে। অথচ আপনাকে কেউ বলে নি বিবর্তনে মানবসভ্যতার খালি পুরুষতান্ত্রিক অভিযোজনই হয়েছে। বলে নি, এই যে বনবাদাড়ে আপনার সমান স্ট্যামিনা নিয়ে জীবজন্তু মারতে পারদর্শী নারী, তাকে ঘরে ঢুকিয়ে কেবলমাত্র একটা ডমেস্টিক ব্রোথেল বানিয়েছে পুরুষই। পুরুষতন্ত্রকে না চাইলেও আপনার বাহবা দিতে হবে, কেননা তা এত সিস্টেম্যাটিকালি শুরু থেকে নারীদের ম্যানিপুলেট করেছে, ব্রেইনওয়াশ করেছে, আর ভাবতে বাধ্য করেছে যে, তারা কোন ঐশীশক্তির নির্দেশে ডাল ভাত বানাতেই তৈরি হয়েছে। আর এতগুলো সভ্যতা তৈরি হলো, ভাঙল, এখন মাত্র কয়েকশো বছর ধরে সবার মনে হওয়া শুরু করেছে আদতে পুরো সভ্যতাই পুরুষতান্ত্রিক আমাশার জন্য তৈরি করা গুহ্যদ্বার।
এদিকে নারীমুক্তির জন্য আপনি প্রস্টিটিউশনের পক্ষে যত-ই কথা বলেন না কেন, এটা এড়ানোর উপায় নেই যে প্রস্টিটিউশনকে ক্যাপিটালাইজ করা হয়েছে কেবলমাত্র একটা গোটা পুরুষতান্ত্রিক খামারের শিশ্নকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য। অর্থাৎ নারীর নিজস্ব দেহের স্বাধীনতার কথা বলেও আসলে এখানে লাভ নেই। কেননা নারীরা স্বাধীনভাবে প্রস্টিটিউশন করলেও তারা দিনশেষে হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক কনস্পিরেসির কাছে ইমপ্রিসনড্। সুতরাং প্রস্টিটিউশনের পুরো খেলাটাই একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উইলের ওপর তৈরি হয়েছে; এটা লৈঙ্গিক রাজনীতির ভয়াবহ উদাহরণ ও ম্যানিপুলেশন ট্র্যাপ ছাড়া আদতে কিছুই না।
তার উপর আপনার ভাষা তৈরি হয়েছে লৈঙ্গিক সুবিধার উপর ভিত্তি করে। ভাষার বিশেষণ তৈরি হয়েছে মেয়েদের কোমলমতি হিসেবে দাঁড় করাতে, যেন তাদের বীরত্বের প্রশ্নে সকলেই যথেষ্ট অনাস্থা রাখতে পারে। এই ঘটনার সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন হুমায়ূন আজাদ। একজন পুরুষকে ‘জানোয়ার’ বলে গালি দিলেও সে যতটা না অপমান বোধ করে, তার থেকে বেশি অপমান বোধ করে তারে ‘মেয়ে’ বলে গালি দিলে। নারীকে ভাষায় তুলনা করা হয় চাঁদের সাথে, ফুলের সাথে, ঝর্ণার সাথে; যেগুলো স্বভাবতই মানুষ ধরে নেয় কোমল-নন হস্টাইল-ভালনারেবল বিশেষণ হিসেবে। আর পুরুষ হতে হলে লাগবে সূর্যের মতো তেজ, অশ্বশক্তি, পাহাড়ের মতো ছড়িয়ে থাকা ছাতি। ভাষার ব্যাখ্যায় নারীরা আজীবন থেকেছে ম্যারিনেটেড মাংস হিসেবে। তাদের বলা হয়েছে রমণী, অর্থাৎ যাকে রমণ করা যায়। বলা হয়েছে কামিনী, অর্থাৎ কামের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কোনো এক বহুকোষী পণ্য। আর শুধু বাংলা না, স্বঘোষিত সকল এলিট ল্যাংগুয়েজেই এই ঘটনা ঘটেছে একাধারে।
আর নারীর জন্য সতীত্বর যেই মহত্ত্ব তৈরি করা হয়েছে, সেটা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত ভাওতাবাজি। এই ব্যাপারকেই কেন্দ্র করে যে ধর্ষণকে সোসাইটি অথোরাইজ করতে সাহায্য করেছে, একথা আহাম্মকদের মাথায় কোনোকালেই আসেনি। ভার্জিনিটিকে নারী চরিত্রের উৎকৃষ্ট গুণ মনে করার মানেই হলো ওটা তার জন্য সবচেয়ে দুর্বল ডিফেন্সের জায়গা হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ লিঙ্গের ভারে কাবু কোনো পুরুষ যদি তারে একবার অন্ধকারে ধরে ফেলতে পারে, তার সোসাইটিতে মুখ দেখানোর উপায় নেই। সুতরাং নারীবিদ্বেষীর জন্য এইটা বেস্ট অফেন্সিভ ট্যাকটিকস।
যেই মেয়েকে পছন্দ করবেন না, রেইপ করেন। তাহলেই আর সে মুখ উঁচু করে চলতে পারবে না। মেয়েটা মুডি? রেইপ করেন। মেয়েটা প্রেমের প্রস্তাব নেয় নি? রেইপ করেন। এই পুরো ভার্জিনিটির দোহাই দিয়ে একটা দৈহিক ভিন্নতার গোষ্ঠীকে আজীবন নাগরদোলার প্যাঁচ দেওয়া হয়েছে।
ধর্ষণকে দিনশেষে আপনি যতোই এদেশীয় সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশনের ফসল মনে করেন না কেন, সমস্যার মূল আসলে একদম আলাদা। কারণ এইদেশে সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড একমাত্র পুরুষ না, নারীরাও। সুতরাং আপনি যদি বলেন সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশনের মূলা খেয়েই পুরুষ ধর্ষণ করে, আপনি ভুল। কেননা এটাকে সত্যি ধরতে হলে আপনাকে এটাও সত্যি ধরতে হবে যে নারীরাও তাহলে রেইপ করতে পারে। অথচ বাস্তব ঘটনা পুরো উল্টো। নারীরা যদি এত ফ্রাস্ট্রেশন নিয়ে ধর্ষণ না করে, পুরুষ কেন করে? এটার ক্লিয়ারকাট উত্তর—পুরুষতন্ত্র। বন্ধুমহলে পুরুষত্ব জাহির করতে কার কয় মিনিট স্থায়ীত্ব এসব আলোচনা আপনারা করেন, আপনারা পুরুষত্বের জাহির করা বলতে “স্কোর আ গার্ল” ব্যাপারটাকে ‘বাণী চিরন্তনী’ ধরে নেন। পর্ন দেখে ভাবেন মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই সারাক্ষণ সেক্স ক্রেইভ করে, মেয়ে বলতে বোঝেন একটা লালায়িত প্রাণীকে যে সবসময় আপনার লিঙ্গের প্রতি তৃষ্ণার্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে এবং আপনি চাইলেই সে অর্গাজমে ফেটে পড়বে। পুরো পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার ওপর ভিত্তি করে আপনারা নারীকে বানিয়েছেন দেহসুখের টোটকা।
এবং পুরুষতন্ত্রের সফলতার সবচেয়ে লিথ্যাল রিয়েকশন কি জানেন? আপনি যদি নিরানব্বই ভাগ নারীস্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে সক্ষম হন, সেটা থেকেও পুরুষতন্ত্র বেনেফিটেড হবে। অর্থাৎ প্রস্টিটিউশনকে লিগ্যালাইজ করলেও পুরুষের যৌন দাসত্বই স্বীকার করতে হবে, আপনার ফ্রিডম অফ থট ও স্পিচ নিশ্চিত করা হলেও ভাষাগত জায়গায় আপনাকে রমণের সমীকরণ হিসেবেই ভাববে এই কামুক যন্ত্রগুলো। “এক্সটিংকশনের ওপরে ওষুধ নেই” বলাটা তাই র্যাডিকাল শোনালেও অতি সত্য।