ফিয়ানা ইসলাম
শেষ যেদিন আমি বাসা ছেড়ে বের হয়ে আসলাম সেদিন মা একবারের জন্যও কাঁদেন নি। বাবা একবারের জন্যও বলেন নি, “থেকে যা।”
কোনো পিছুটান যদি কাজ করে থাকে, তা একমাত্র মীরা।
মীরা আমার স্ত্রী। গত বছর বিয়ে হয়েছিল আমাদের ধুমধাম করে। প্রেমের বিয়ে। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বাবা-মা মানছিলেন না। মীরা অনাথ ছিল তো, একটা পরিবারহীন মেয়েকে কীভাবে একমাত্র ছেলের বউ করে নিয়ে আসবেন!
আমি বুঝি। বাবা-মায়েদের এরকম অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত যুক্তি থাকে। মীরাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম।
মীরা মন খারাপ করে নি। মেয়েটা বুদ্ধিমান ছিল।
“তুমি আমাকে কতটা ভালবাসো, ঋ?” প্রায়ই প্রশ্ন করত মেয়েটা।
মীরার প্রশ্নের উত্তর ছিল না আমার কাছে। মেপে মেপে আমি ভালবাসতে পারি না। যেই ভালবাসা দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায়, তার অস্তিত্ব একসময় বিলীন হতে বাধ্য।
মীরা ছিল আমার অহংকার, আমার নেশা।
দিন দিন অবিশ্বাস্য হারে নেশা বাড়তেই থাকল। পাশে থাকলে সারাক্ষণ ওর লম্বা, ঘন চুলে মুখ গুঁজে থাকতাম। আর আশেপাশে না থাকলে আলমারিতে রাখা ওর শাড়ির ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে মীরাময়ে অসাড় হয়ে যেতাম।
বাবা-মার থেকে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকল।
বউ নাকি আমাকে বশ করেছে! হা-হা! বাঙালি যুক্তি।
মীরা কষ্ট পেত। কিন্তু আমি কান দিতাম না।
আমার জগৎ মীরাতে শুরু হতে লাগল, মীরাতে শেষ হতে লাগল।
আমার সকাল-সন্ধ্যা-রাত জুড়ে ছিল শুধু মীরা।
মীরা, মীরা, মীরা।
মাত্রাতিরিক্ত নেশা একটা মানসিক ব্যাধি।
এই মানসিক ব্যাধির কারণেই কি না একদিন তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে রাগ হয়ে হাতের কাছের বিশাল ফুলদানিটা মাথা বরাবর ছুঁড়ে মারলাম। আমার চোখের সামনে মেয়েটা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে মারা গেল।
ব্যাধি থেকে আমি মুক্তি পেলাম।
মীরা এতিম ছিল তাই কেউ খোঁজ করতে আসে নি। ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতেও বেশি সময় লাগল না আমার। বাড়ির পেছনের বাগানে বাবার লাগানো একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল।
সেটার নিচে পুঁতে দিলাম।
কোনো থানা পুলিশ হয় নি। সবাই জানল বউ পালিয়েছে অন্য ছেলের হাত ধরে। ক’দিন পর সেটাও সবাই ভুলে গেল। কেন মনে রাখবে? পৃথিবীতে তো মানুষ অন্যের জন্য ব্যস্ত হতে আসে নি।
জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেল সবার।
আমি রোজ সকালে নিয়ম করে গাছটায় পানি দিতে লাগলাম।
মা খুব চিল্লাচিল্লি করলেন তার শখের ফুলদানির শতখন্ড হওয়া মৃতদেহ দেখে, “ছি-ছি! মান ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে দিল এই দুশ্চরিত্র মেয়েছেলে! ছোটলোক মেয়ে বিয়ে করবে আবার সুখেও থাকবে! এত কপাল আমার ছেলের! গেলি তো গেলি আবার আমার বাড়িঘর তছনছ করে দিয়ে গেলি…”
বাবা মায়ের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দেন।
আমি মায়ের কথায় কষ্ট পাই। মা আমাকে মেকি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। লাভ হয় না।
মীরা চলে যাওয়ার পর আমি একদম একা হয়ে গেলাম। মানসিক ভাবেও, শারীরিক ভাবেও। আমি সমস্ত শক্তি-অনুভূতি হারিয়ে ফেললাম।
আমার ঘরে আর কেউ আগের মতো সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বাতি জ্বালায় না। কারণে-অকারণে আয়নার সামনে বসে কেউ দেবীর মতো চোখে গাঢ় করে কাজল টানে না।
দুই পায়ে নূপুর পড়ে ঝমঝম শব্দ করতে করতে কেউ সারা ঘর দৌঁড়ে বেড়ায় না।
এক আকুল করা শূন্যতায় যেন চারিদিক হাহাকার করতে থাকে।
চার দেয়ালে গড়া এই মীরাহীন সংসারে ক্রমেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।
গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকা এই অমানুষিক যন্ত্রনার মুক্তি আদৌ আছে কি?
মীরাকে একা রেখেই তাই দূরে চলে আসতে হলো।
এখানে আমি ভালোই আছি। শহর থেকে দূরে, একসময়কার জমিদার দাদার বাগানবাড়িতে। একা থাকি। দ্বিতীয় কোনো মানুষ নেই বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেয়ার মতো।
সারাদিন লেখালেখি করি। খাই-দাই। ঘুমাই।
সন্ধ্যার পরে বাড়ির মধ্যের দিঘির শানবাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসে থাকি। চাঁদের আলো দিঘির পানি ভেদ করে চলে যায়…সেই আলোতে আমার জরাজীর্ণ চেহারা ভেসে ওঠে। তখন মনে হয় আমি জীবন থেকে অবসর নেওয়া একজন বৃদ্ধ৷ নিজের জন্য মায়া হয়। পাপবোধ হয়।
মাঝে মাঝে গভীর রাতে গুনগুন শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আধোঘুমে আমি দেখি ছায়ার মতো কেউ একজন আমার ঘরময় নূপুর পায়ে ঝমঝম শব্দ করতে করতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। সেই আঁচলের মুঠো মুঠো ঘ্রাণে চারিদিক মাখামাখি।
কি অদ্ভুত অদৃশ্য মোহ!
আজকাল সন্ধ্যা নামলেই আমি তার জন্য অপেক্ষা করি। দীঘিপাড়ের অবাধ্য বাতাস আমাকে ক্লান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। সন্ধ্যা শেষে রাত নামে, চাঁদ ওঠে…কিন্তু আমার অপেক্ষা শেষ হয় না।
আমাকে অবাক করে দিয়ে একসময় দমকা হাওয়ায় মতো তার আবির্ভাব হয়। টুক টুক করে সিঁড়ি ভেঙে আবছা ছায়ার মতো একটা শরীর একরাশ অচেনা বুনো ফুলের গন্ধ নিয়ে দীঘিপাড়ের দেওয়ালে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে।
আমি তার মধ্যে আমার হারানো সঙ্গিনীকে খুঁজতে থাকি।
আকাশভরা জ্যোৎস্নার আলোতে সেই ছায়ামানবী চুল বাঁধে। মৃদু সুরে গুনগুন করে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি।
ছায়ামানবী চুলে ফুল দেয়। আমি দেখি।
ছায়ার ফুল।
উৎসর্গ: খুব কাছের একজন ছায়ামানবকে।
ফিয়ানা সাহিত্যপ্রেমী। যেকোন ধরনের বই তার প্রিয়। আর সে চেষ্টা করে কাগজে কলমে নিজের লেখার মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দিতে।