পা ঠ কে র ব ই রি ভি উ
আদনান সহিদ
“শিশুরা হচ্ছে এমন এক প্রকার প্রাণী, যারা নিজেরা নিজেদের জগত তৈরি করে”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিশুদের জগতটা ঠিক কেমন?
অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, তাদের জগতটা স্বতঃস্ফূর্ত, নির্মল, নিষ্পাপ, আনন্দমুখর, নির্ভার, নির্মোহ ও নিশ্চিন্ত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটি প্রাধান্য দিয়ে শিশুদেরকেই নিজ জগত তৈরি করতে দেয়া হলেও সে জগতে তাদের সহজ ও সাবলীল বিচরণ নিশ্চিত করতে পরিবার ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। একটি শিশু তার প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা, মানসিক বিকাশ ও রক্ষণাবেক্ষণ সাধারণত পরিবারের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। আর তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিকটা মূলত পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।
শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো প্রাথমিক শিক্ষা। কারণ এ ধাপেই শিশু তার ভবিষ্যৎ জীবনের অপরিহার্য গুণাবলি যেমন: মানবিকতা, নৈতিকতা, ভালোবাসা, সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি অর্জন করে নেয় নিজ মন ও মননে। এখন আমরা যদি নিজ দেশের শিশুশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক দিকটাতে একটু নজর দেই, তাহলে কী দেখতে পাই আসলে?
আমরা দেখি যে, শিশুদের স্কুলের সিলেবাসে ১০-১৫ টি বইয়ের উপস্থিতি, মুখস্থবিদ্যায় অভ্যস্ত করানোর অসুস্থচর্চা, পোশাকের চাকচিক্য, শিক্ষকদের কঠোর শাসন, ঊর্ধ্বমুখী স্কুল-ফি এবং সামাজিক শ্রেণিভেদে সকল শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে অক্ষম ইট-কাঠ-পাথর বেষ্টিত অবাধে গড়ে ওঠা সুরম্য দালানের স্কুল! স্কুলের সামনে এক টুকরো সবুজ খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে পারছে না অনেক স্কুল-ই। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর মনোজগতে মুক্ত, স্বাধীন চিন্তার প্রতিফলন ঘটাবে কী করে?
স্বভাবতই তাই প্রশ্ন এসে যাবে এর ব্যতিক্রম কি হতে পারে না? আছে কোনো ইউটোপিয়ান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা বাস্তবেও ছিল? যা পাল্টে দিয়েছিল বা পাল্টে দিতে পারে শিশুর মনোজগত? নিশ্চিত করতে পারে তার কাঙ্ক্ষিত আপন ভূবন?
জাপানের জনপ্রিয় টেলিভিশন উপস্থাপক ও গুণী অভিনয়শিল্পী তেৎসুকো কুরোয়ানাগি তাঁর শৈশবের স্কুলকে ঘিরে ১৯৮১ সালে লিখেছিলেন এমনই এক স্মৃতিকথামূলক বই — তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি (Totto-chan: The Little Girl at the Window)। যে বইতে তোত্তোচান নামের এক শিশুর আশ্রয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন শৈশবের তোমায়ে গাকুয়েন স্কুল, স্কুলের প্রধান শিক্ষক সোশাকু কোবাইয়াশি এবং স্কুলকে ঘিরে তাঁর স্বপ্নের কথা, ব্যতিক্রমী আনন্দমুখর পরিবেশ ও মননশীল শিক্ষাব্যবস্থার চমৎকার উদাহরণের কথা। কুরোয়ানাগি নিজ স্কুল শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক সোশাকু কোবাইয়াশিকে। এই স্মৃতিকথামূলক বইটি আমাদের জানায় শিশুবান্ধব ও অভিনব এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা, যা গোটা বিশ্বের অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও সকল মানুষের জন্য অবশ্যপাঠ্য ও অনুসরণীয় হতে পারে।
বইটির মূল চরিত্র ছোট্ট জাপানি মেয়ে তোত্তোচান। আনন্দময় নিজ জগতের সুখী বাসিন্দা। চারপাশের পরিবেশকে নিয়ত সঙ্গী করে হাঁটাচলা, খেলাধুলা, ঘোরাফেরা করে সে আপনমনে। ক্লাসে পড়াশোনার চেয়ে ক্লাসরুমের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের পৃথিবীতে উঁকি দেওয়াতেই তার আগ্রহ অপার। স্বভাবতই এমন ‘অমনোযোগী ছাত্র’ কি আর স্কুলে পড়ার উপযুক্ত? তাই তো তাকে বের করে দেওয়া হলো স্কুল থেকে। কী নিষ্ঠুর! তাই না? উহু! স্কুল থেকে এই বের করে দেওয়াটাই শাপে বর হলো তোত্তোচানের। ‘স্বপ্নের মতো’ তোমায়ে গাকুয়েন স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেল সে, যে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সোশাকু কোবাইয়াশি ছিলেন একজন দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব, যুগান্তকারী চিন্তা-ভাবনার ধারক ও বাহক।
তো কেমন ছিল সেই তোমায়ে গাকুয়েন স্কুল? প্রধান শিক্ষক সোশাকু কোবাইয়াশি বা কী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন শিশুর মনোজগত গঠনে?
আগের স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তোত্তোচানের সাথে প্রথমবার দেখা হয় প্রধান শিক্ষক কোবাইয়াশির। এরপর থেকেই বার বার বলতে থাকেন, “তুমি সত্যিই খুব ভালো মেয়ে।” প্রধান শিক্ষকের এই প্রশংসা তোত্তোচানের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে আসে,তার মনে হতে থাকে আগের স্কুলে সে কোনো খারাপ কাজ করে নি। যে দুরন্তপনায় আগের স্কুলে সে থাকতে পারে নি, এখানে সেটিকে ‘শিশু স্বভাবসুলভ’ বিবেচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই আমন্ত্রণই তোত্তোচানের ভবিষ্যত জীবন গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।
একটা স্কুলের চারপাশের পরিবেশ, অবস্থান ও প্রকৃতি শিশুর মনে কেমন প্রভাব ফেলে?
তোমায়ে গাকুয়েন স্কুল গড়পরতা কারুকার্যখচিত মনোরম কোনো দালান বা কক্ষ নিয়ে গড়ে ওঠে নি, বরং পরিত্যক্ত রেলগাড়ির কামরাকে সুসজ্জিত করে শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল সেখানে। অপার আনন্দে তোত্তোচানসহ শিশুরা সেই ‘মজার স্কুলগাড়িতে’ ক্লাস করত। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর পরম প্রতীক্ষায় থাকত পরদিন আবার কখন স্কুলে যাবে! আমরা কি নিশ্চিত করতে পেরেছি শিশুদের জন্য এমন স্কুল? কিংবা এমন স্কুলের সংখ্যাও কি সন্তোষজনক যেখানে বাচ্চারা বিনা দ্বিধায় স্কুলে যেতে চাইবে? স্কুলে যাবার ভয়ে কাঁদবে না?
একটা স্কুলে ধর্ম-বর্ণ-মত নির্বিশেষে অনেক শিশুর আগমন ঘটে। তাদেরকে সমান চোখে দেখা, সমঅধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বও স্কুলের অভিভাবক তথা কর্তৃপক্ষের উপর বর্তায়। এর ব্যতিক্রম ঘটলে শিশু মনে পড়তে পারে বিরূপ প্রভাব। বিষয়টি খেয়াল করে তোমায়ে গাকুয়েন স্কুলের প্রধান শিক্ষক একদিকে যেমন গ্রহণ করেছেন তোত্তোচানের দুরন্তপনাকে, আবার তার সমান নজর ছিল পোলিও রোগে আক্রান্ত শিশু ইয়াসুয়াকির দিকেও। বামনত্বে ভোগা শিশু তাকাহাশিকেও স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো বিশেষ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
কয়েক কেজি ওজনের ‘বিদ্যেবোঝাই ব্যাগ’ পিঠে আমাদের শিশুদের চলাফেরা করতে দেখি প্রতিনিয়ত। হোমওয়ার্ক, পরীক্ষা, কয়েক ঘণ্টা ক্লাসের চাপে পিষ্ট শিশুদের দেহ ও মন! কিন্তু গাকুয়েন স্কুল শিশুদের পড়ানোর জন্য বেছে নিয়েছিল একেবারেই ভিন্ন ও অভিনব পন্থা। শিশুরা স্কুল সময়ের মধ্যে নিজেদের ইচ্ছামত বিষয় বা বই নিয়ে পড়াশোনা করতে পারত। ছিল না কোনো নির্দিষ্ট ‘ক্লাস পিরিয়ড’ বা ‘ক্লাস রুটিন’। শিশুদের বাসা থেকে টিফিন আনতে হতো ‘পাহাড়ের খাবার’ ও ‘সাগরের খাবার’, যাতে তারা পাহাড় ও সাগরে উৎপন্ন খাবার সম্পর্কে শিখতে পারে। কেউ আনতে অক্ষম হলে স্কুল থেকেই ব্যবস্থা করা হতো সেই শিশুর টিফিন। চুপ না থেকে গান গেয়ে, কথা বলে আনন্দসহ খাওয়ার চমৎকার পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলেন প্রধান শিক্ষক সোশাকু কোবাইয়াশি।
তাঁর মতে, “মানুষ দুটো চোখ নিয়ে জন্মাবে বটে, কিন্তু পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে শিখবে না। কান নিয়ে জন্মাবে কিন্তু সঙ্গীত শুনতে শিখবে না। মস্তিক নিয়ে জন্মাবে কিন্তু সত্যের চর্চা করা শিখবে না। হৃদয় নিয়ে জন্মাবে কিন্তু তাতে আপাত অপ্রয়োজনীয় সব ভালোবাসার স্ফুলিঙ্গ থাকবে না। এরকম সমাজ তৈরি হওয়া খুবই ভয়ঙ্কর হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য।”
এই দূরদর্শী চিন্তা মাথায় রেখেই তৈরি কোবাইয়াশি মশায়ের তোমায়ে গাকুয়েন স্কুল ছিল শিশুর মানসিক বিকাশের সকল প্রয়োজনীয় উপাদানে পরিপূর্ণ। গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরে ভবিষ্যৎ জীবনধারণের সকল শিক্ষাই তোত্তোচান পেয়েছিল তার প্রিয় স্কুল থেকে। খাবার ভালো করে চিবিয়ে খাওয়া, গাছগাছালির সাথে কথা বলা-খেলা, স্কুলের মাঠ ও ক্লাসরুম পরিষ্কার রাখা, অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়া, পোষা প্রাণীর প্রতি দরদ, কৃষি ক্ষেতে কাজ করা, নাটক-গানের রিহার্সেল, ধূলো মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া, পাহাড়-পর্বত-ঝর্ণায় অ্যাডভেঞ্চার ইত্যাদি কর্মকাণ্ড আমাদের শিশুদের ‘তথাকথিত সমৃদ্ধ’ সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকে কি?
আজ দেশে সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, ব্যক্তিগত সামর্থ্য ও ইচ্ছা থাকলেও শিশুর মনোজগতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী স্কুল গড়ে উঠছে না কেবল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন ‘সোশাকু কোবাইয়াশি’ মশাইয়ের অভাবে। ভেবে দেখি, কোবাইয়াশি তাঁর স্বপ্নের তোমায়ে গাকুয়েন স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে। কালের ‘ধ্বংসযজ্ঞ ও রক্তপাতের নিষ্ঠুর সাক্ষী’ বিশ্বযুদ্ধের সময়েও কোবাইয়াশি শিশুদের সৌন্দর্যবোধ ও মানবিক বিকাশকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কালের সীমানা পেরিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন শিশুর সৃজনশীল মন ও মনন গঠনেই ভবিষ্যতে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী এক জাতি গঠন সম্ভব, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে জাপান পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে আছে।
আজ তাই নিরাপদ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রধান শিক্ষক সোশাকু কোবাইয়াশির তোমায়ে গাকুয়েন স্কুলের মতো শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণের বিকল্প নেই। আর অনুসরণীয় এই শিক্ষাব্যবস্থার সফল পথপ্রদর্শক হতে পারে তেৎসুকো কুরোয়ানাগির স্মৃতিকথামূলক বই – তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি।
বইটি পড়ে আমাদের শিশুদের জন্য ভাববেন তো?
আগ্রহী পাঠকদের জন্য: মূল জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত Totto-chan: The Little Girl at the Window বইটি দুন্দুভি প্রকাশনী থেকে তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি শিরোনামে চৈতী রহমানের সরল, সাবলীল অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে।
আদনান সহিদ লিখতে অণব ভালোবাসেন। শব্দেরা তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু,তাঁর হয়েই কথা বলে। পাঠকেরা সে কথামালায় যোগ দিলে এক ‘আনন্দমেলা’ তৈরি হয় বলে তাঁর বিশ্বাস।