অ ণু গ ল্প
ফারিয়া রহমান
যুবক যখন তার স্ত্রী শান্তনার গলা টিপে ধরে তার নিঃশ্বাস রোধ করায় ব্যস্ত, তখন তার মস্তিষ্কের সব থেকে গভীরে একটা দৃশ্য হেসে ওঠে। দৃশ্যটি আমার জানার কথা নয়; তবুও আমি জানি, কারণ আমি এই গল্পের কথক। দৃশ্যটি এমন যে, সে আর তার বড় আপা পাশাপাশি বসে একটি সূরা মুখস্থ করছে: “আরয়াইতাল্লাযী ইয়ুকায্যিবু বিদ্দীন, ফাযা–লিকাল্লাযী ইয়াদু‘উ‘ল ইয়াতীম…”। এই দৃশ্যে যুবক বারো বছরের একজন কিশোর। আর তার বড় আপার বয়স পনেরো।
আমরা শুনতে পাই দু’জন কিশোর কিশোরী গুনগুন করে সূরা পাঠ করে। টেবিলের ওপাশে হুজুর বসা, এপাশে দুটি চেয়ারে তারা দুইজন। মুখে পবিত্র বোল থাকলেও, দুজনই হুজুরের ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখের আড়ালে কলম দিয়ে একে অন্যকে খোঁচাচ্ছে। হঠাৎ বড় আপা ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে উঠলে হুজুরের ঘুম ঘুম ভাব উধাও হয়ে যায়।
হুজুর সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করে, “কী করস তোরা?”
দুই ভাই–বোন নীরবে হুজুরের পেছনের সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“কথা কস না ক্যান?” হুজুর ধমকে ওঠে।
কিশোর নিজেকে বাঁচাতেই কিনা কে জানে, বলে ওঠে, “আপা আমাকে কলম দিয়ে খোঁচা দেয়, হুজুর।”
“হুজুর, ও–ও দেয়!” বড় আপা প্রতিবাদ করে ওঠে।
হুজুর তখন কিশোরকে কাছে ডাকে। কিশোর ভয়ে ভয়ে হুজুরের কাছে যেতেই হুজুর তাকে হাত এগিয়ে দিতে বলে। কিশোর প্রতিবাদ না করে হাত এগিয়ে দেয়।
“আপনার কথা না শুনলে ছেলেরে ইচ্ছামতো মাইর দিবেন, হুজুর” বলা বাবাকে স্মরণ করে হুজুর বেশ আনন্দের সাথে কিশোরের হাতে গুনে গুনে দশটা বাড়ি দেয়।
কিশোর দাঁতে দাঁত চেপে জিন্সের প্যান্টে হাত ডলতে ডলতে নিজের জায়গায় যেয়ে বসলে হুজুর বলে, “দশ মিনিটের মধ্যে সূরা মুখস্ত কইরা দিবি।”
কিশোর জল ভরা আহত চোখে হুজুরের দিকে তাকায়, “আপাকে মারবেন না, হুজুর?”
“মাইয়াগো মারলে অগো শইলে আর কিছু বাকি থাকব? একটু মাইর খাইয়া বিছনায় পইড়া থাকলে পাক-সাক করব কেডা?”
আমরা কিশোরের চোখের জল অদৃশ্য হতে দেখি একটু একটু করে। ছোট্ট ভ্রু–জোড়ার মধ্যকার দূরত্ব ঘুঁচতে শুরু করে।
বড় আপার মুখে যখন স্বস্তির হাসি, কিশোরের ভ্রু জোড়ার মধ্যকার দূরত্ব ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে তখন এক দৃষ্টিতে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দৃশ্যটি এখানেই শেষ হয়। তখনকার সেই কিশোর এখন যুবক। তার পুরো হাতের তালুতে শান্তনার ফর্সা (এখন লাল হয়ে যাওয়া) গলা একদম মাপ মতো এঁটে যায়। অক্সিজেনের অভাবে কোটর থেকে প্রায় বের হয়ে আসা বড় বড় চোখ ভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে শান্তনা তাকিয়ে আছে যুবকের দিকে। নিচু গলার স্বর, মুচকি হাসি, আর জগতের সমস্ত লজ্জার অধিকারী এই যুবক এককালে তার প্রেমিক ছিল। একত্রে বসে তারা যখন ফরাসি গান শুনত, যুবক তখন তার চুলের ঘ্রাণ শুঁকত বুক ভরে। শান্তনার পৃথিবী অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ঠিক তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে আমরা শুনতে পাই তার প্রিয় গান,
“ন, রিয়ান দা রিয়ান,
ন, র না রিগ্রাতে রিয়ান,
নি লা বিয়ান কো মা ফে,
নি লা মা তু সা মে বি এ ইগাল।”
“No, absolutely nothing,
No, I regret nothing
Not the good things that have happened nor the bad,
It’s all the same to me.”
“না, কোনো কিছুই না,
কোনো কিছুরই আফসোস করি না
না ভালো স্মৃতির, না বেদনার
কারণ সবটাই শেষ পর্যন্ত আমার কাছে একই।”
ফারিয়া বই পড়তে ভালোবাসে। যেকোন ভাষার সাহিত্যই তার প্যাশন। আর সে লিখে, যেন একদিন মানুষের গল্পগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে পারে।