ম তা ম ত – সা হি ত্য
সৈয়দ নাফিস কামাল
আমার পড়া হুমায়ূনের প্রথম বই আঙ্গুল কাটা জগলু । পড়ে ভালো লাগল। মনে পড়ল বাসায় একটা বই দেখেছিলাম, সেটার নামে হিমু আছে। পড়ে ফেললাম হিমুর দ্বিতীয় প্রহর । বাচ্চা ছিলাম, প্রচণ্ড ভয় পেলাম।
হিমু আমার অপছন্দের চরিত্র। তার মানে এই না যে হিমু পড়তে ভালো লাগত না। পড়তাম – এক ধরনের গিল্টি প্লেজার নিয়ে পড়তাম। দ্বিতীয় প্রহর-ই আমার সবচেয়ে পছন্দের হিমু-বই৷ এর পেছনে একটা বড় কারণ সম্ভবত বইটিতে মিসির আলীর উপস্থিতি।
হিমুর নিহিলিস্ট/এনার্কিস্ট(?) চরিত্র নিয়ে কিছু ইতিবাচক সমালোচনা আছে। এর কোনোটাই বুঝি নাই, বা মনে ধরে নাই।
✪ ত্রিমূর্তির মধ্যে আমার একমাত্র পছন্দের – যথেষ্ট পছন্দের চরিত্র মিসির আলী। মূলত মিস্ট্রি জানরার হলেও আমি মিসির আলীকে জানরা-ব্রেকিং সাহিত্যই বলব।
আমার সবচেয়ে পছন্দের মিসির আলীর বই হলো মিসির আলীর অমীমাংসিত রহস্য ৷ অনারেবল মেনশন বৃহন্নলা । তন্দ্রাবিলাস পড়ে ব্যাপক ভয় পেয়েছিলাম।
✪ হুমায়ূনের লেখা আমার প্রিয় উপন্যাস (নাকি উপন্যাসিকা?) ফিহা সমীকরণ । আমার পড়া সেরা সায়েন্স ফিকশনের তালিকায় একদম সামনের দিকে থাকবে।
বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন তার লেখা, যতদূর জানি (“যতদূর জানি” কথাটা লেখার গ্রহণযোগ্যতা দুর্বল করে দেয়। তারপরেও ফ্যাক্টচেকের ঝামেলায় যেতে চাচ্ছি না।) তোমাদের জন্য ভালোবাসা । এর প্রধান চরিত্রও মহামতি ফিহা।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা: হুমায়ূন আহমেদকে সাহিত্যগুণে টিকিয়ে রাখতে পারত তার সায়েন্স ফিকশনসমূহ, ছোটগল্প ও উপন্যাস। পারত বলছি, কারণ অন্যান্য বইয়ের তুলনায় তার সায়েন্স ফিকশনগুলো কম পঠিত। মুহম্মদ জাফর ইকবালের জায়গায় হুমায়ূন সায়েন্স ফিকশন লেখা কন্টিনিউ করলে দুই পক্ষ থেকেই কিছু থোড়-বড়ি-খাড়া-খাড়া-বড়ি-থোড় লেখা কম আসত।
✪ প্রিয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে অনারেবল মেনশন: বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, দূরে কোথাও, গৌড়িপুর জংশন, মেঘ বলেছে যাব যাব, জোছনা ও জননীর গল্প ।
✪ হুমায়ূন আহমেদের শিশুসাহিত্য এক কথায় দুর্দান্ত। আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা শিশুসাহিত্যিক হুমায়ূন। শিশুসাহিত্যের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ভেঙ্গে ডার্ক-ইশ একটা ঘরানা তৈরি করেছেন, ফলে শিশু-কিশোর-পরিণত সবাই উপভোগ করতে পারেন – ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। এই মুহূর্তে আলাদীনের জাদুর চেরাগ, বোতল ভূত ইত্যাদি গল্পের কথা মনে পড়ছে। একটা ছেলের সাথে যে কাক কথা বলত, বইটার নাম কী?
✪ হুমায়ূন আহমেদের দুইটা চমৎকার উপন্যাস হচ্ছে নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার । শঙ্খনীল কারাগার তার প্রথম লেখা ও দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস, এবং নন্দিত নরকে হলো ভাইস ভার্সা। এর মধ্যে নন্দিত নরকে আমার খুবই পছন্দের। সমস্যা হলো, এদের যত উঁচায় তুলে ধরা হয়, এরা তত উঁচু মানের না। ব্যাপারটা ভেগ হয়ে গেল: লেটস্ জাস্ট সে, বাংলাদেশের প্রথম সারির উপন্যাস না। হুমায়ূনের সাহিত্যমান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেই এই বই দুটো ঢালের মতো বাড়িয়ে দেওয়া হয় বলে এদের খ্যাতি তুঙ্গস্পর্শী হয়ে গেছে।
আমার কাছে তার সবচেয়ে ওভাররেটেড উপন্যাস মনে হয় মধ্যাহ্ন । মারবেন না, ওভাররেটেড ফতোয়া দিচ্ছি না, “মনে হয়” বলেছি।
তবে মধ্যাহ্ন-কে নিয়ে নতুন করে ভাবছি। হিরোশিমায় বোমা পড়ল আর বাংলাদেশে লাবুর (নাকি লাবুস?) শরীর গেল ঝলসে — এর মধ্যে কি জাদুবাস্তবতার ব্যাপার আছে? উপন্যাসটিতো জাদুবাস্তব ধাঁচের না, এটা কি কোন ধরনের ফিউশন? এক্সপেরিমেন্ট? আল্লাহ মালুম।
✪ হুমায়ূন বাজারী লেখক – এই আলোচনার বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা যুক্তিগুলোর একটা হচ্ছে, সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় লিখলেই যদি বাজারী লেখক হয়ে যায়, তবে বাজারী লেখকই ভালো। সমস্যা হচ্ছে, সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় লেখার জন্য তারে কেউ বাজারী লেখক বলেছে – এই কথা আমি কস্মিনকালেও শুনি নাই। খামাখা একটা ফালতু কথা তৈরি করে সেটার বিপরীতে যুক্তি দেয়ার কারণ কী?
আরও কিছু যুক্তি হলো, হুমায়ূন একটি প্রজন্মকে বই পড়তে শিখিয়েছেন।
যদি তা-ই হয়, তবু তা নিজেই একটি কনক্লুসিভ স্টেটমেন্ট, এর থেকে নন-বাজারী কনক্লুশনে আসা যায় না। তিনি একটি প্রজন্মকে বই পড়তে শেখালে বই পড়তে শেখানোর কৃতিত্বই পাবেন, বাজারী লেখক হওয়ার দায় থেকে মুক্তি পাবেন না। সে দায়মুক্তি দিতে হলে এইসব ফ্যালাসির জগৎ থেকে বেড়িয়ে ক্রিটিকালি এপ্রোচ করতে হবে।
✪ হুমায়ূনের প্রতি একটি অভিযোগ হলো তার লেখায় সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব। আমি এই অভিযোগ তোলা পছন্দ করি না – শিল্পীর ওপর কোনো ধরনের দায় চাপিয়ে দেয়াই আমি পছন্দ করি না।
একইভাবে পছন্দ করি না এই অভিযোগ খণ্ডন করতে — হলুদ হিমু, কালো র্যাব কিংবা বহুব্রীহি-র ‘তুই রাজাকার’ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াকে। সহস্র বইয়ের মধ্য থেকে একটা বই আর একটা ডায়ালগ তুলে আনা আমার কাছে চেরি-পিকিং বলে মনে হয়।
✪ আমি যে টুকটাক লেখালেখি করি, এর মাঝে হুমায়ূনের লেখনীর প্রভাব আছে৷ ব্যাপারটা কেউ ধরিয়ে দিলে আমার খারাপ লাগে। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য খারাপ লাগে না, প্রভাবটা ধরিয়ে দেয়ার মতো স্পষ্ট তাই খারাপ লাগে। প্রভাব কাটিয়ে উঠার চেষ্টাও করছি না অবশ্য আলসেমির কারণে।
নটে গাছটি মুড়ালো, আমার কথা ফুরালো। তবে আমার কথাকে গুরুত্ব দেবেন না। যে ব্যক্তি হুমায়ূনের ফ্যান ফিকশন লিখে কিন্তু নিজেকে ফ্যান হিসেবে স্বীকার করে না, তার কথায় গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।