আ লো চ না – ব ই
তানজিনা তাবাস্সুম নোভা
ফিকশন পড়ুয়া হিসেবে আমার দুর্নাম আছে। ফিকশন বেশি পড়ি দেখে ‘ফিকশনারী’ (যে নারী শুধু ফিকশন পড়ে) তকমাও জুটেছে। এহেন আমার জন্য নন-ফিকশনের প্রতি আগ্রহ জন্মানো সহজ ছিল না। তারপরও যে ধীরে ধীরে ব্যাপারটা ঘটছে, তার পেছনে কিছু বইয়ের ভূমিকা আছে। আজকের লেখাটি তেমন কিছু বই নিয়ে।
এখানে বলে রাখা ভালো, সেরা নন-ফিকশন ধরনের কোনো তালিকা দেওয়া কোনোভাবেই এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এই তালিকা তৈরির সময় আমার ব্যক্তিগত পছন্দই প্রাধান্য পেয়েছে। ঠিক সে কারণেই এই তালিকায় একই ধরনের একাধিক বই দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বইগুলোকে কোনো বিশেষ ক্রমানুসারেও সাজানো হয় নি।
অন্ধের স্পর্শের মতো, শঙ্খ ঘোষ
৩ এপ্রিল, ২০০৭ তারিখে কলকাতার শিশিরমঞ্চে ষষ্ঠ প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতায় শঙ্খ ঘোষ যে বক্তৃতা দেন, এই বইটি সেই বক্তৃতার লিখিত রূপ। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল “সংযোগের ভাষা”। আমরা যখন একজন আরেকজনের সাথে কথা বলি; যা বলছি, তার কতটুকু অপরজনের কাছে বোধগম্য হচ্ছে, তা নিয়ে কয়জন চিন্তা করি? আবার, বলার ভাষা আর লেখার ভাষা যে আলাদা হওয়া উচিত, সেটাও তো অনেকেই বুঝতে পারি না। নিজের মত জাহির করার জন্য গলা ফুলিয়ে চেঁচানোর দরকার হয় না, এ কথা বোঝানোর জন্য রবীন্দ্রনাথের চেঁচিয়ে বলা প্রবন্ধের কথা এসেছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের কথা, নোয়াম চমস্কির কথা, আবু সয়ীদ আইয়ুবের কথাও উঠে এসেছে।
কবিরা গদ্য লিখলে তা কবিতার মতো ছন্দময়, স্বাদু হয় — এমন একটি কথা প্রচলিত আছে। শঙ্খ ঘোষের গদ্য সেই কথার সত্যতা প্রমাণ করে। শুধু মনের ভাব প্রকাশ করা নিয়ে, অন্যের সাথে সংযোগ ঘটানো নিয়ে একটি লেখা হতে পারে এবং তা কত চমৎকার হতে পারে, সেটা বোঝার জন্য হলেও এই বইটি পড়া উচিত।
রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা, তপন রায়চৌধুরী
১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগ পর্যন্ত লেখক তপন রায়চৌধুরী এবং তাঁর পরিবার বরিশালের অধিবাসী ছিলেন। দেশভাগের পর তাঁরা ওপার বাংলায় চলে যান। এই বই তাঁর সেই “বরিশাইল্যা” জীবনের স্মৃতিচারণ। সেই সময়ের বরিশালের মানুষের সরল জীবনযাত্রা, তাদের অকপট ভাষার ব্যবহার — সবই খুব জীবন্তভাবে বইটিতে উঠে এসেছে। লেখকের সরস ও প্রাঞ্জল লেখনীর কারণে বইটি খুবই সুখপাঠ্য। এছাড়াও, বইটি পড়তে গিয়ে বাড়তি পাওনা ছিল বইয়ে অন্তর্ভুক্ত মিহির সেনগুপ্তের লেখাটি।
এই বইটি যাঁদের ভালো লাগবে, তাঁদের জন্য একই লেখকের বাঙালনামা বইটিও অবশ্যপাঠ্য।
পঞ্চতন্ত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী
এটি একটি প্রবন্ধ সংকলন। প্রবন্ধ বলেই যে গুরুগম্ভীর ভাষায় কঠিন কঠিন বিষয়ে আলোচনা হবে, তা কিন্তু নয়। মুজতবা আলীর অন্য যে কোনো লেখার মতো এই বইয়ে সংকলিত প্রবন্ধগুলোও রসে পরিপূর্ণ। তাঁর পাণ্ডিত্য, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও রসবোধ মিলে এই বইয়ের প্রতিটি পাতা দারুণ উপভোগ্য। তাই কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময়ও এক মুহূর্তের জন্যও পাঠককে বিরক্ত হওয়ার সুযোগ দেবেন না তিনি।
সুনন্দর জার্নাল, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে আমার পরিচয় টেনিদা’র মাধ্যমে। তারপর তাঁর লেখা কিছু ছোট গল্পও পড়া হয়েছে। কিন্তু সুনন্দর জার্নাল দিয়ে তাঁর সাথে যেন নতুন করে পরিচয় ঘটল। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় এই জার্নাল প্রকাশিত হতো। এগুলো ছিল সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ছোট কিছু রচনা।
টেনিদা’র গল্পগুলোর মতো অত বেশি না হলেও লেখকের স্বভাবসুলভ রসবোধের পরিচয় এই লেখাগুলোতেও বেশ ভালোমতোই পাওয়া যায়। সেই সাথে তাঁর পড়াশোনার ব্যাপকতা দেখে চমৎকৃত হতে হয়।
মসলার যুদ্ধ, সত্যেন সেন
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জেই শুধু মসলা পাওয়া যেত। মসলা রফতানি করে এই অঞ্চল বেশ সমৃদ্ধও হয়ে উঠেছিল। এই মসলার বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল পাশ্চাত্যের শক্তিশালী দেশগুলো। ঔপনিবেশিকতার সূচনাও হয় এই মসলার কারণেই। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশরা একে একে এসে এই অঞ্চলের মানুষদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার শুরু করে। ইতিহাসে বীর বা নায়ক হিসেবে দেখা যায় (যেমন ভাস্কো দা গামা), এমন অনেকের আসল চেহারাটাও এই বই পড়ে পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ইতিহাসের স্বল্প পরিচিত এই অংশ সম্পর্কে জানতে চাইলে এই ছোট, সুলিখিত বইটি পড়ে নেওয়া উচিত।
সম্পাদকের বৈঠকে, সাগরময় ঘোষ
সাগরময় ঘোষ দীর্ঘকাল ধরে দেশ পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। এই লম্বা সময়ে অনেক নামী লেখকের সাথে তিনি কাজ করেছেন। আবার প্রচুর উটকো ঝামেলাও তাঁকে পোহাতে হয়েছে। ফলে তাঁর ঝুলিতে অজস্র গল্প জমা হয়েছে। এই বইয়ের মাধ্যমে আমরা সেই গল্পের কিছুটা ভাগ পাই। তিনি লিখেছেন বৈঠকি গল্প বলার ঢংয়ে। তাই কথকের সামনে বসে গল্প শোনার একটা অনুভূতি পাঠকের মনে সৃষ্টি হয়।
একটি পেরেকের কাহিনি পড়ে সাগরময় ঘোষের লেখা খুব পছন্দ হয়েছিল, এই বই পড়ে সেই পছন্দের মাত্রা আরো বাড়ল।
রসবতী, শংকর
রসবতী শব্দের একটি অর্থ হলো রান্নাঘর। এখান থেকেই বইটি কী নিয়ে লেখা, তা বোঝা যাওয়ার কথা। তিক্ত, কটু, কষায়, লবণ, অম্ল, মধুর — এই ছয়টি রস নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এই বইয়ে বাঙালি রান্নার ইতিহাস উঠে এসেছে। এসব ইতিহাস সংগ্রহ করার জন্য লেখক, আমেরিকা প্রবাসী ব্যান্ডোদা এবং অধ্যাপক সর্বদমন রায় — এই তিনজন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন।
পুরো বইটিতে গল্পচ্ছলে আর তিন চরিত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে এসব তথ্য পাঠকের কাছে উপস্থাপিত হওয়ার কারণে পাঠক তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন না।
রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার এবং পুনরাবিষ্কার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ একাই বাংলা ভাষাকে অনেক উঁচুতে টেনে নিয়ে গেছেন। তাই রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের মধ্যে তাঁর প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। ১৯৫০ এর দশকে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখতেন, তাঁদের মধ্যে দু’টি দল ছিল। এক দল অন্ধভাবে রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করতে চাইতেন। দ্বিতীয় দল চাইতেন রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কবিতায় নতুন ধারার প্রচলন করতে। সুনীল ছিলেন এই দ্বিতীয় দলের সদস্য। তিনি সহ এই দলের অনেকেই এই প্রভাব মুক্ত হতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার মতো বাড়াবাড়িও করে ফেলেন।
এককালে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে পরবর্তীতে লেখক আবার কীভাবে তাঁকে আবিষ্কার করলেন, তাই এই বইয়ে সংকলিত রচনাগুলোর মূল আলোচ্য। এই বইকে অবশ্য পুরোপুরি নন-ফিকশন বলা যায় না, কারণ সুনীলের রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক প্রবন্ধ আর সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর লেখা ছোট গল্প আর কবিতাও এখানে স্থান পেয়েছে। সুনীলের লেখা নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। যা কিছু নিয়েই লিখতেন, তাকে সহজবোধ্য আর উপভোগ্য করে তোলার একটা দারুণ ক্ষমতা তাঁর ছিল।
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ
বাঙালি সংস্কৃতি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। এখানে অঞ্চলভেদে, ধর্মভেদে, সংস্কৃতির পার্থক্য ঘটে। বাংলা ভাষা বা বাংলা নামে দেশের জন্মকাল নিয়েও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তারপরও, এতসব পার্থক্যের মধ্যে এই সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন উপাদানটি হলো বাংলা ভাষা। লেখক বাংলা ভাষা দিয়েই বাংলা সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। চর্যাপদ, যাকে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নমুনা হিসেবে গণ্য করা হয়, সেই গ্রন্থ রচনার সময় থেকে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। আলাদা আলাদা করে সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।
বিশাল কলেবরের কারণে এই বইটি পড়ে শেষ করতে সময় লাগতে পারে, তবে প্রাঞ্জল বর্ণনার কারণে পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক হয় না।
মোগলনামা, মাহমুদুর রহমান
বইটি ভারতবর্ষে মোগল শাসনের ইতিহাস নিয়ে লেখা। এটি তরুণ লেখক মাহমুদুর রহমানের প্রথম বই। মোগলনামা দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম খণ্ডে বাবুরের সিংহাসন গ্রহণ থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। ভারতবর্ষের ঐ সময়ের জীবনযাত্রার ব্যপারেও এই বই থেকে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
লেখকের গদ্য প্রাণবন্ত ও ঝরঝরে। সে কারণে যে কারো বইটি পড়তে ভালো লাগবে। এছাড়াও প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে অন্তর্ভুক্ত ফুটনোট আর বইয়ের শেষে দেওয়া রেফারেন্সের তালিকাও আগ্রহী পাঠকের জন্য সহায়ক হবে।
এই বইগুলো আমাকে নন-ফিকশন পড়তে আগ্রহী করে তুলেছে বলেই যে অন্যদের ক্ষেত্রেও এগুলো সহায়ক হবে, এমন না-ও হতে পারে। প্রত্যেকেরই নিজের পছন্দের কিছু বিষয় থাকে, সে বিষয়গুলো নিয়ে লেখা বই পড়লে হয়তো তা আরো ভালো কাজে দেবে।
সকলের পড়া আনন্দময় হোক!
লেখক দ্য ঢাকা অ্যাপোলগ এডিটোরিয়াল টিমের সদস্য।