শ্রদ্ধাঞ্জলি
আদনান সহিদ
২০২০ এর ক্রান্তিকালে করোনার নির্মম আঘাত কেড়ে নিল আরেক বিশ্ববরেণ্য, মেধাবী ব্যক্তিত্ব কিম কি দুককে। গত ১১ ডিসেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই খ্যাতনামা সিনেমা পরিচালক।
১৯৬০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার উত্তর জিয়েয়ংস্যাং প্রদেশের বংহুয়া গ্রামে কিম কি দুকের জন্ম হয়। মুক্তচিন্তার অধিকারী ও সাহসী এ নির্মাতা নন্দনবোধকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যতিক্রমী কাহিনী নির্ভর সিনেমার মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পেয়েছেন গ্রহণযোগ্যতা ও তুমুল জনপ্রিয়তা। আধ্যাত্মিকতা, দর্শন, পরাবাস্তবতা, বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্মের নানা উপাদান, যৌনতা, নৃশংসতা, রাজনীতি, অবিশ্বাস ইত্যাদি তাঁর সিনেমার মুখ্য বিষয়বস্তু।
প্রায় চৌদ্দ বছর আগে, কিম কি দুকের সাথে আমার পরিচয় ঘটে স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার অ্যান্ড স্প্রিং (২০০৩) সিনেমার মাধ্যমে। জ্ঞানী বৌদ্ধ সাধুর সান্নিধ্যে এক শিক্ষানবিশ সাধু তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঋতু কীভাবে স্যুরিয়ালিজমের (পরাবাস্তববাদ) আশ্রয়ে পার করেছে, সেই আধ্যাত্মিক ভ্রমণ কাহিনীকেন্দ্রিক সিনেমাটি আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করে। এরপর থেকে প্রবল উৎসাহে এক নাগাড়ে দেখতে থাকি তাঁর অন্যান্য সিনেমাগুলি।
থ্রি আয়রন, ক্রোকোডাইল, দ্য আইল, রিয়েল ফিকশন, অ্যাড্রেস আননোন, সামারিটান গার্ল, টাইম, ব্রিদ, ড্রিম, দ্য নেট, দ্য বো, রাফ কাট, পিয়েতা, ব্যাড গাই, আরিরাং, ওয়ান ওন ওয়ান, স্টপ, মেইড ইন চায়না, “হিউম্যান, স্পেস, টাইম অ্যান্ড হিউম্যান”, বার্ডকেজ ইন সহ তাঁর পরিচালিত প্রায় ৩৩টি সিনেমার মধ্যে ২৫ টি সিনেমা দেখার সুযোগ হয়েছে। সিনেমাগুলো থেকে পাওয়া ধারণা অনুযায়ী তাঁর কাজের ধরন ও বৈশিষ্ট্যগুলো শেয়ার করছি পাঠকদের সাথে।
চরিত্রায়ণ
কোরিয়ার মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত জনমানুষের জীবনধারার চেয়ে কিম কি দুক তাঁর সিনেমায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন স্রোতের বিপরীতমুখী জীবনধারণে অভ্যস্ত প্রান্তিক ও বঞ্চিত চরিত্রগুলোর। এজন্য প্রবল সমালোচিত হয়েছেন নিজ দেশের সমালোচকদের কাছে, দর্শকদের সঙ্গেও সৃষ্টি হয়েছে সম্পর্কের ফাটল।
স্যুরিয়ালিজমের (পরাবাস্তবতার) আশ্রয়
কিম কি দুক তাঁর সিনেমার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন চরিত্র বা বস্তুর (সুর, সঙ্গীত, শব্দ, দৃশ্য, স্থান, সময় প্রভৃতি) পরাবাস্তব উপস্থাপনের মাধ্যমে কঠোর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। পরাবাস্তবতা হলো বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য বা অবাস্তব কোনো ঘটনা, যা সিনেমার সৃষ্ট চরিত্র বা দর্শক মনে এক ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে। বাস্তবতার মিশেলে এ ধরনের অবাস্তব ঘটনাকে কৃতিত্বের সাথে উপস্থাপনে কিম কি দুকের জুড়ি মেলা ভার। উদাহরণস্বরূপ, থ্রি আয়রন ও দ্য বো সিনেমার কথা বলা যায়। তাঁর ইন ড্রিম সিনেমাটি স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশেলে পরাবাস্তববাদের আরেকটি চমৎকার উদাহরণ। স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং সিনেমাতেও পরাবাস্তবতা আর ধর্মীয় দর্শনের এক চমৎকার মেলবন্ধন সৃষ্টি হতে দেখি।
স্ব–উদ্ভাবিত ভাষা
ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের (দৃশ্যমান ভাষা) সফল উপস্থিতি কিম কি–দুকের চলচ্চিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর চরিত্রগুলোর কথোপকথনে নামমাত্র বাক্যালাপ পাওয়া যায়। কখনও কখনও তা হয়ে ওঠে “প্রায় নির্বাক” উপস্থাপন, যার নেপথ্যে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত করা আছে। দ্য আইল, ব্যাড গাই, থ্রি আয়রন সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় কিমকে সংলাপ ব্যবহার করতে দেখা যায় নি বললেই চলে।
মাত্রাধিক নৃশংসতা
কিম কি দুকের সিনেমা নৃশংসতার উচ্চমাত্রাকে উপেক্ষা করে যৌনতা, অত্যাচার, হত্যা বা ধর্ষণের সরল স্বাভাবিক উপস্থাপন দর্শক চোখে শীতলতা বা সহিষ্ণুতার জন্ম দিলেও মনে দীর্ঘস্থায়ী এক পীড়াদায়ক ও বিরূপ প্রভাব রেখে যায়। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাড্রেস আননোন সিনেমায় কুকুরের উপর ভয়ঙ্কর সহিংসতা, পিয়েতা সিনেমায় প্রতিফলিত সহিংসতা কিংবা দ্য আইল সিনেমায় মাছের মৃত্যু দৃশ্যের নির্মম চিত্রায়ণের কথা উল্লেখ করা যায়। সিনেমায় তাঁর এ ধরনের প্রাণী হত্যা কিংবা খুন–ধর্ষণের স্বাভাবিক ও সাবলীল চিত্রায়ণ তাঁর পরিচালনার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলেও এর জন্য দর্শক–সমালোচক মহলে বিতর্কিত হয়েছেন বেশ কয়েকবার। এমনকি তাঁর স্বদেশী কিছু সাংবাদিক তাঁকে “মানসিক বিকারগ্রস্ত” হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন।
বর্ণনাশৈলী ও দর্শক মনে এর প্রভাব
কিম কি দুকের সিনেমার কাহিনী বর্ণনায় রয়েছে ভিন্নতা, যা দর্শকদের একঘেয়েমি দূর করতে সক্ষম। ঘটনাপ্রবাহের মোড় নির্ণয় করা দুরূহ; প্রায়শই অপ্রত্যাশিত বাঁক নিয়ে নেয়। সামারিটান গার্ল, থ্রি আয়রন সিনেমাতে এ ধরনের ভিন্নমাত্রার বর্ণনাশৈলী পাওয়া গেছে। এছাড়া কিম তাঁর সিনেমার অস্বাভাবিক ও উন্মুক্ত উপসংহারে বিশ্বাসী, যেখানে দর্শক নিজ মর্জিমাফিক সিনেমার শেষাংশের ব্যাখ্যা করতে পারেন অথবা কখনও তা অব্যাখ্যেয়ও থেকে যায়।
তাঁর চিত্রনাট্যের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে তা দর্শক মনে প্রবল আলোড়ন তুলতে সক্ষম। মাত্রাধিক নৃশংসতা বা যৌনদৃশ্যের পাশাপাশি তাঁর চিত্রনাট্যে কাহিনীর মোচড় বা উপস্থাপনা কখনও দর্শককে স্তম্ভিত করে, কখনও জাগায় বড়সড় শিহরণ। এর সাথে দার্শনিক বয়ান, নান্দনিকতা ও কাব্যময়তার সংযোগ বাড়তি পাওনা হিসেবে যোগ হয় সেলুলয়েডের ফিতায়। ব্যাড গাই, মোয়েবিয়া, ক্রোকোডাইল, অ্যাড্রেস আননোন, দ্য আইল, পিয়েতা সহ কিম কি দুকের প্রায় সব সিনেমাতেই বেশ কিছু শিহরণ জাগানিয়া, মনঃস্তাত্ত্বিক ঝামেলা সৃষ্টিকারী দৃশ্যের উপস্থিতি রয়েছে।
স্বরচিত চিত্রনাট্য
সিনেমা পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রনাট্যকার হিসেবেও কিম কি দুকের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। নিজের সব সিনেমার কাহিনী রচনা করেছেন নিজ হাতেই। এজন্যই হয়তো কথোপকথনের আধিক্য না থাকলেও নিজ সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মুখভঙ্গি ও অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে কাঙ্ক্ষিত গল্পটি পৌঁছে দিতে তাঁর এতটুকু অসুবিধা হয় নি।
যৌনতা ও যৌনকর্মীদের উপস্থাপন
যৌনকর্মীদের কাহিনী কিংবা তাদের জীবনগাথাকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্য রচনা কিম কি দুকের আরেকটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। তাঁর অধিকাংশ সিনেমায় নারীদের যৌনকর্মী হিসেবে উপস্থাপন কিংবা তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতাকে নারীবাদীরা স্বভাবতই ইতিবাচক হিসেবে দেখেন নি। দ্য আইল, বার্ডকেজ ইন, সামারিটান গার্ল সিনেমায় নারী যৌনকর্মীদের জীবননির্ভর গল্প প্রাধান্য পেয়েছে। তবে নারীর প্রতি পুরুষের আধিপত্য, সহিংসতা এবং কোরিয়ার আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভয়াবহ বৈষম্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতেই কিম কি দুক যৌনকর্মকে চিত্রনাট্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন বলে অনেক বিজ্ঞ দর্শক, সমালোচকের ধারণা।
সিনেমায় স্ব–উদ্ভাবিত ভাষা (ভিজুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ও ইমেজ), “প্রায় নির্বাক অথচ ভীষণ সবাক” বর্ণনাভঙ্গি, ব্যতিক্রমী বিষয়বস্তু এবং দর্শক হৃদয়ে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কিম কি দুকের সিনেমা সমসাময়িক কোরিয়ান সিনেমা নির্মাতাদের তুলনায় তাঁকে ‘ভিন্নধর্মী’ তকমা দান করেছে। আর তাই বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়ানোর পাশাপাশি স্বভাবতই কিমের পুরস্কার ও স্বীকৃতির ঝুলি হয়েছে বেশ সমৃদ্ধ। সামারিটান গার্ল–এর জন্য বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিলভার বিয়ার (২০০৪), কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আরিরাং এর জন্য আন সার্টেইন রিগার্ড প্রাইজ (২০১১) এবং ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে থ্রি আয়রন এর জন্য সিলভার লায়ন (২০০৪), পিয়েতা–র জন্য গোল্ডেন লায়ন (২০১২) এবং ওয়ান অন ওয়ান এর জন্য পাওয়া দ্য ভেনিস ডে‘জ বেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড (২০১৪) কিম কি দুকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং সিনেমা পরিচালনার দক্ষতা ও যথার্থতা প্রমাণ করে।
কিম কি দুক একবার বলেছিলেন, “পৃথিবী কি বাস্তব না স্বপ্নময়–তা নির্ণয় করা বেশ কঠিন।“
তবে সদ্য ওপার জগতের বাসিন্দা এ নির্মাতা তাঁর জাদুকরী সৃষ্টিকর্মের সুবাদে পৃথিবীর বাস্তবতায় দর্শক, সমালোচক হৃদয়ে প্রতিনিয়ত আছেন, থাকবেন। তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আদনান সহিদ লিখতে অণব ভালোবাসেন। শব্দেরা তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু, তাঁর হয়েই কথা বলে। পাঠকেরা সে কথামালায় যোগ দিলে এক ‘আনন্দমেলা’ তৈরি হয় বলে তাঁর বিশ্বাস।