জাফর ইকবালের জন্মদিনে তাঁর বই নিয়ে আলোচনা
তানজিনা তাবাস্সুম নোভা
আমার মতো নব্বই দশকে জন্ম নেওয়া/বেড়ে ওঠা অনেকের শৈশব-কৈশোরের সাথেই মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম খুব গভীরভাবে জড়িত। তাঁর লেখা কিশোর উপন্যাস আর সায়েন্স ফিকশন ছিল আমাদের অনেকের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। কিন্তু সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর অবদান শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। সংখ্যায় কম হলেও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা তাঁর কিছু উপন্যাস আর গল্পগ্রন্থ আছে, যেগুলো তেমন একটা আলোচনায় উঠে আসে না। তাঁর জন্মদিনে সেরকম কয়েকটি বই নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।
আকাশ বাড়িয়ে দাও
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক পরের সময়টা নিয়ে এই গল্প। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আমিন আর আগের জীবনে খাপ খাওয়াতে পারে না। কাছের বন্ধুদের প্রায় সবার মৃত্যু, নিজের ও অন্য বন্ধুদের পরিবর্তন, নিঃসঙ্গতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব — আমিনের জীবনের এ সবদিকই এখানে উঠে এসেছে।
অনেক সময়ই যুদ্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে একটা ফ্যান্টাসি কাজ করে। নিজের চোখে যুদ্ধ দেখলেই যুদ্ধের প্রকৃত রূপ বুঝতে পারা যায়, আমিন যেমন পেরেছিল। আবার, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অনেকের হয়তো আশা ছিল যে, দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেই রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবে তার উল্টোটাই বরং সত্য ছিল। আকাশ বাড়িয়ে দাও এই আশাভঙ্গেরও গল্প।
লেখকের গতানুগতিক খুশি খুশি ধরনের বইয়ের তুলনায় এই বইটি একদমই আলাদা। ছোট এই বইটি পাঠকের চিন্তাভাবনাকে নাড়া দিয়ে যেতে সক্ষম।
ছেলেমানুষী
এই গল্প সংকলনে ৭টি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের ছোট গল্প স্থান পেয়েছে। যে ধরনের গল্পকে ইংরেজিতে আমরা ‘dark’ বলে থাকি, এই বইয়ের প্রায় সবগুলো গল্পই তা-ই। এই ধরনের লেখা পড়তে যাদের ভালো লাগে, তাদের এই গল্পগুলোও ভালো লাগবে। গল্পের ধরনের কারণেই সম্ভবত লেখকের লেখার ধরনও এই গল্পগুলোতে কিছুটা অন্যরকম।
শিরোনাম গল্পটি, যেটি লেখকের লেখা প্রথম গল্প, বিষয়বস্তুর কারণে অনেক পাঠক এটিকে পছন্দ করেন না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এটি মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা আমার প্রিয় গল্পগুলোর একটি।
কাচ সমুদ্র
আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রিয়াজের সামার ভ্যাকেশনে একটি চাকরিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে গল্পের শুরু। অফিসের কাজ, আমেরিকান ক্রিস্টিনার সাথে বন্ধুত্ব, তার সাথে মিলে নতুন বাসা খোঁজা, সামার শেষে আবার আগের কাজে ফেরত যাওয়া — এসব কিছু মিলিয়ে রিয়াজের দিন খারাপ কাটছিল না। হঠাৎ একদিন গভীর রাতে তার কাছ থেকে দেশ থেকে একটা ফোন কল আসে। তারপর…
আমার মতে, এটি লেখকের সবচেয়ে পরিণত লেখাগুলোর একটি। আর একটি বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমি বইটির যে বর্ণনা দিয়েছি তাতে মুক্তিযুদ্ধের কথা উল্লেখ না করলেও, এই বইটি পড়লে পাঠক মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতাকে আর একটু বেশি অনুভব করতে পারবেন। বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা মাত্র ৭৯, পড়ে শেষ করতেও সময় লাগবে না।
প্রেত
রুমী নামের এক অতি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ এই গল্পের মূল চরিত্র। তার জীবনে একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো সে বিদেশে যাবে, তার ক্লাসের ফিটফাট ছেলেদের মতো ইংরেজিতে কথা বলবে। ঘটনাচক্রে কিবরিয়া নামে একজনের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তার সেই ধারণায় পরিবর্তন আসে। এর মধ্যেই একদিন শুধু কৌতূহলের বশে একজন জ্যোতিষীকে হাত দেখাতে গিয়ে তার জীবন পুরো ওলটপালট হয়ে যায়।
ভৌতিক/আধিভৌতিক ধরনের গল্পও মুহম্মদ জাফর ইকবাল কিছু লিখেছেন, তার মধ্যে প্রেত অন্যতম। ব্ল্যাক ম্যাজিক বা শয়তানের উপাসনার সাথে আমার পরিচয় খুব সম্ভবত এই বই দিয়েই হয়েছিল। তাই বইটি পড়ে বেশ ধাক্কা খেয়েছিলাম, মনে আছে। এই বইয়ের সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো দিক হলো রুমী চরিত্রের পরিবর্তন। তার একদম সহজসরল এক তরুণ থেকে একজন দৃঢ় মানসিকতার তরুণে পরিণত হওয়ার যাত্রাটি এক কথায় চমৎকার।
এই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার ২৬ বছর পর একই ধরনের কাহিনী নিয়ে লেখক দানব উপন্যাসটি লিখেছিলেন। অনেকের কাছে দানব বইটি বেশি ভালো লাগলেও আমি প্রেত-কেই এগিয়ে রাখব।
একজন দুর্বল মানুষ
৭টি গল্পের এই সংকলনটির সবগুলো গল্পের বিষয়বস্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। কখনও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্র, কখনও ঘরে ফিরতে থাকা এক মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতা, কখনও যুদ্ধে স্বজন হারানো কারো গল্প, কখনও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে চাওয়া এক তরুণের গল্প — বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে এই গল্পগুলোতে।
বইয়ের কিছু গল্প পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলেও প্রতিটি গল্পই সুখপাঠ্য। এর মধ্যে একটি গল্প আত্মজৈবনিক, লেখকের নিজের জীবনের ঘটনা। সত্য ঘটনা বলেই হয়তো গল্পটি একটু বেশিই মন খারাপ করিয়ে দেয়।
ক্যাম্প
মুক্তিযুদ্ধ চলছে। গল্পের শুরুতেই আমরা জানতে পারি, কুসুমখালি গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি ফজল নামের কাউকে মেরে ফেলেছে। মাস্টারবাড়ির ছোট ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ফজল মা আর বোনদের সাথে দেখা করতে বাড়িতে এসেছিল। খবর পেয়ে এলাকার রাজাকার কমান্ডার মতিউর রহমান ওরফে মোতি রাজাকার তাকে ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ফজলের মৃত্যুদৃশ্যের মধ্য দিয়ে গল্প শেষ হয়।
মূল গল্পটা এতটুকুই। কিন্তু আপাতদৃষ্টে সাধারণ এই গল্প বিশিষ্টতা অর্জন করেছে এর বর্ণনাভঙ্গির কারণে। এই ছোট একটি ঘটনাই আমরা জানতে পারি পাঁচজনের জবানিতে: জালু পাগলা, মোতি রাজাকার, পাকিস্তানি মেজর সামশেদ ও ফজল। এক একজনের বর্ণনার সাথে সাথে গল্পকে আমরা নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পাই।
উল্লেখিত বইগুলো ছাড়াও মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা উপন্যাসের মধ্যে বিবর্ণ তুষার, দুঃস্বপ্নের দ্বিতীয় প্রহর ও সবুজ ভেলভেট, আর গল্পগ্রন্থের মধ্যে মধ্যরাত্রিতে তিনজন দুর্ভাগা তরুণ উল্লেখযোগ্য।
এই তালিকায় উল্লেখিত বইগুলো পড়লে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, কিশোর উপন্যাস আর সায়েন্স ফিকশনের বাইরে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লিখতেও মুহম্মদ জাফর ইকবাল সিদ্ধহস্ত। তিনি হয়তো মনে করেছেন, সায়েন্স ফিকশন আর শিশু-কিশোরদের জন্য যেহেতু খুব বেশি মানুষ লেখে না, সেহেতু তাঁর সেগুলো নিয়েই বেশি কাজ করা উচিত। হয়তো শিক্ষকতা ও গবেষণার দায়িত্ব সামলে এর বেশি তিনি লিখতে পারেন নি। সেটা তিনিই ভালো জানেন। তবু আমার এবং হয়তো আমার মতো আরো অনেক পাঠকের মনে তাঁর কাছ থেকে এমন লেখা আরো বেশি না পাওয়ার একটা আক্ষেপ থেকে যাবে।
লেখক দ্য ঢাকা অ্যাপোলগের এডিটোরিয়াল টিমের সদস্য।