যেখানে কেউ খোঁজ নেয় না

Editor
5 Min Read

ছো ট গ ল্প 


সৈয়দা নুজহাত জাবীন


যখন আমরা কোনো উপন্যাসের ইতি টানতে পারি না, তখন সেই উপন্যাসকে এমনভাবেই শেষ করতে হয়, যেন শেষ হইয়াও হইল না শেষ! তবে সেটা হয়তো তখন উপন্যাস না হয়ে ছোটগল্প হয়ে রয়ে যায়। মাঝে মাঝে খুব বিষণ্ন রাতে আমার প্রত্যেকটা মানুষকে এক একটা সাহিত্যের অংশ বোধ হয়। কিছু মানুষের জীবন সেখানে হয় কবিতার মতো – তাদের জীবনে রস থাকে, ছন্দ থাকে। আবার কারো জীবন প্রবন্ধের মতো – তত্ত্ব আর তথ্যের মারপ্যাঁচে জীবন শেষ। আমার জীবনটাও হয়তো একটা সাহিত্য খণ্ডের মতো। শুধু তাকে আমি কোন কাতারের সাহিত্য বলব, তা আমার জ্ঞানের পরিসীমার বাইরে।

আমি মাঝে মাঝেই স্মৃতি হাতড়ে আমার জীবনের সুখস্মৃতিগুলো খুঁজতে বসি। আমার স্মৃতির পটে তখন ভেসে আসে সদ্য চতুর্দশে পদার্পণ করা এক মানুষের অবয়ব। সেবার দুর্গা পুজোয় আর দশটা বাঙালি মেয়ের মতো প্রথমবারের মতো আমিও যে নিজের গায়ে জড়িয়েছিলাম মায়ের লাল পেড়ে শাড়ি। গভীর আবেগে হাত রাঙিয়েছিলাম রঙিন চুড়িতে। সেদিনের পুজো-মণ্ডপে আমি পেয়েছিলাম আমার জীবনের সর্বোচ্চ সুখ, আমার নারীত্বকে আলিঙ্গন করার সুখ। তবে সেই সুখ ছিল ক্ষণস্থায়ী। সেদিন পুজো মণ্ডপ থেকেই আমায় টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এসেছিল মা। পিঠে গরম খুন্তির দাগ বসিয়ে দিয়েছিল। নিজের অপরাধ আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার যে নিজেকে মায়ের প্রতিচ্ছবি ভাবতে ভালো লাগত! সেই ভালো লাগা কেন অপরাধ জানতে চাইলে আমাকে বোঝানো হলো আমি পুরুষ। চাইলেই আমি মায়ের মতো হতে পারি না, এমন করলে সমাজ ধিক্কার দেবে আমায়। 

এক জীবন কেটে গেল আমার মুখোশের আড়ালে। আমার কোনো ভালো বন্ধু আর হয়ে ওঠে নি। আমার বয়সী ছেলেদের নাকি বন্ধু হয় খেলার মাঠে, মারামারির মাঝে। আর আমাকে ওসব কখনোই টানে নি। আমাকে টানত খুব কোমল ও মোহনীয় জিনিস। মুক্ত নীল আকাশ কিংবা বর্ষার প্রথম কদম আমাকে নির্মল আনন্দ দিত। অথচ এক জীবনে প্রাণ খুলে ফুলের সৌরভ নেওয়া হয় নি আমার। আমি আজও খুঁজে পাই নি কী অপরাধে একটা বদ্ধ কারাগারে আমার শৈশব কাটল!

চৌদ্দ পেরিয়ে আঠারো হলাম। সবার জীবনে রঙ এলো। আমার জীবন সময়ের সাথে সাথে রঙ হারাতে শুরু করল। কখনও কোনো নারী আমায় আকর্ষণ করতে পারে নি। আমার বয়স যখন বাইশ তখন এক নারী তীব্রভাবে আমায় ভালোবেসেছিল।  সেসময় আমি প্রচুর বই পড়তাম। ভালো ছাত্র হিসেবে ভালোই নাম-ডাক আমার পাড়ায়। মেয়েটির ছোট ভাইকে আমি অঙ্ক করাতাম। সে সূর্যমুখী-রঙা শাড়ি পরতো হুট-হাট। আমি তার দিকে মুগ্ধ হয়ে কতবার তাকিয়েছি। ভেতরটা ছিঁড়ে যেত আমার শুধু সেই হলদে শাড়ি ছুঁয়ে দেখার অভিলাষে। মেয়েটি আমার অভিলাষকে কামনা ভেবে ভুল করেছিল, আমায় প্রপঞ্চ করার দায় দিয়েছিল। সেই অপরাধে আমায় সে অভিশাপ দিয়েছিল আমি ভীষণ একাকীত্বে জীবনাবসান করব। অথচ, তাকেও আমি আমার ভীষণ অসহায়তার কথা বলতে পারি নি। 

তবে আজ এই সত্তরের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আমি উপলব্ধি করছি, কী ভীষণ একাকী, মিথ্যে জীবন ছিল আমার। হ্যাঁ, আমি মায়ের দেওয়া দিব্যি রেখে পুরুষ হয়েই কাটিয়ে দিয়েছি আমার জীবন। খুঁজতে যাই নি আমার নিজস্বতা। আজকের দুঃখবিলাসও আমি গেঁথেছি পুরুষবাচক শব্দে। কারণ সামাজিক স্বীকৃতি খুঁজতে গিয়ে নিজের আমিত্বকে আলিঙ্গন করার সাহস আমার কখনও হয় নি। 

সবাই খুঁজল সমাজের কথা। আমায় বোঝানো হলো পরিবারের কথা। কিন্তু যে কথা কেউ জানতে চাইল না, সেটা আমার কথা। একদম সবার শেষেও কেউ খুঁজতে আসে নি আমার সুখের কথা। তাদের কাছে সামাজিক শেকলটা এতটাই শক্ত যে সেই শেকল ভেঙে তারা আমায় মুক্ত হতে দেয় নি। সত্তর বছর কাটিয়ে দিয়েছি পুরুষ হয়ে। বিয়ে থা করি নি, সারাজীবনে শৃঙ্গার রসের ছোঁয়া পাই নি। জীবনের একমাত্র সুখ ছোঁয়া পেয়েছিলাম সেই ১৪ বছরের ক্ষণিকের নারীত্বকে আলিঙ্গনের সময়। এর পর সমাজে মিশে যাওয়ার জন্য লুঙ্গির আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছিলাম আমার সকল অভিপ্রায়কে। আমি সাহসী হয়ে আবার নিজের গায়ে লাল পেড়ে শাড়ি জড়াতে পারি নি। অনেকের সাহসে আমার মতো ক্ষণিকের সুখ ও হয়তো জোটে না। মিথ্যের মুখোশে আড়াল করে ফেলে তারা নিজেদের। সবকিছুর কথা ভাবতে গিয়ে তারা নিজেদের আত্মাকে ভাবতে, আত্মাকে খুঁজতে ভুলে যায়। পাপ-পুণ্যের মাপকাঠি খুঁজতে আমরা ধর্মের পুঁথিতে আটকে যাই। অথচ সেই হিসেব আমাদের খোঁজা দরকার ছিল বিবেকের কাঠগড়ায়। সুখ খুঁজতে গিয়ে আটকে যাই সমাজের শৃঙ্খলে। যে জিনিসটা যেখানে খোঁজা দরকার, সেই জায়গাটাই আমরা সবার শেষে খুঁজি, কখনও বা খুঁজতে ভুলে যাই। তাই হয়তো আমাদের সাহিত্য পূর্ণতা পায় না।

তার মধ্যেও কেউ সঠিক জায়গায় ঠিক জিনিসটা খোঁজা শিখে নিতে পারে। তাদের কেউ কেউ লক্ষ্মী নারায়ণের মতো নিজের সুখ, নিজের পরিচয় আদায় করতে পারে। সমাজের জন্য নিজেকে না বদলে তারা সমাজকে বদলে ফেলে। তাদের দেখে আজ এই পড়ন্ত বিকেলে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। আমি অদূর ভবিষ্যতে কিছু সুখী অবয়ব দেখতে পাই। আমি দেখতে পাই কিছু উপন্যাস যারা নিজের ইতি খুঁজে পাওয়ার দিকে এগোচ্ছে। তারা ছোটগল্প হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এই ভেবেই আমি খুব স্বস্তিতে আমার অসফল সাহিত্যখণ্ডের পাতাগুলোতে সমাপ্তি টানি।

 

Share this Article
Leave a comment