ছো ট গ ল্প
ফিয়ানা ইসলাম
“আচ্ছা একজন লেখকের মৃত্যু কখন হয়?
তার দেহাবসানের সাথে সাথে নাকি পাঠকের মনে তার ক্রমাগত অনুপস্থিতির সাথে সাথে?”
– সাফাত রাহমান
বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক সাফাত রাহমান অজ্ঞাত কারণে নিখোঁজ।
আজকের সংবাদপত্রের হেডলাইন।
সকাল হওয়ার সাথে সাথেই খবরের কাগজ আমার বাসার ডাইনিং টেবিলের উপর রাখার নির্দেশ দেওয়া আছে। যে নির্দেশ দিয়েছেন সে আমার বাবা, আর যাকে নিয়ে আজকের খবরের হেডলাইন সে আমি।
আমিই সাফাত রাহমান।
আই অ্যাম দ্য ওয়ান হু ইজ মিসিং।
বাবা ব্রেকফাস্ট করতে করতে এই হেডলাইন দেখা মাত্রই প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কোনোভাবেই তাকে থামানো যাচ্ছিল না। বাবা অতি উত্তেজিত হলে ভুলভাল রেফারেন্স দিয়ে কথা বলেন। বাজখাঁই গলায় সে আমার মাকে বলতে লাগলেন, “সারাদিন বই বই বই! উনি বই লিখে ‘তানসেন’ হবে! বিশ্বজয় করবে! এদিকে বাপ-মার খবর নাই! এই তোমার আশকারা পেয়ে ছেলে এতদিন মাথায় উঠেছে এখন কান মলাও দিচ্ছে! সামলাও ঠ্যালা এখন কোর্ট-পুলিশের!”
মা “ঠ্যালা” সামলানোর কথা শুনে দরজার কাছে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
আমি “নিখোঁজ”।
কিন্তু আমার চোখের সামনে সব স্পষ্ট, স্বচ্ছ। যত সময় পার হচ্ছে, কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার সবকটি ইন্দ্রিয় যেন ততই ভয়ঙ্করভাবে সচল হয়ে উঠছে। মানবজাতির প্রত্যেকটা কথা যেন আমার মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা স্নায়ুকোষে আটকে যাচ্ছে। কেউ যেন আমার একটা অতিরিক্ত চোখ খুলে দিয়েছে।
সুন্দর বাংলায় একে বলে “ত্রিনেত্র”।
পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সবার আগে গেল হাওয়ারিনের কাছে। হাওয়ারিনের নাম আজকের আগ পর্যন্ত কেউ শোনে নি। এক কপট সত্য হলো, সে আমার রহস্যমহলের একমাত্র রাজকন্যা।
পুলিশের ক্রমাগত ঠকঠকে অতিষ্ঠ হয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় যখন হাওয়ারিন দরজা খুলল তখনও তার চুল বৈশাখের ঝড়ের মতো এলোমেলো, পরনে ফিনফিনে শ্বেতরঙা একটা কাপড়…আর দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট।
দরজার সাথে হেলান দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে প্রশ্ন করল, “ইজ হি ডেড?”
“আমরা শুধু জানতে চাচ্ছি আপনি মিসিং-এর ব্যাপারে কী জানেন?”
“আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমার কাছে লেখক আসতেন শুধু শারীরিক প্রয়োজনে। অন্য কিছু নয়।”
আমি হাওয়ারিনের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একটা মেয়ে এত সুন্দর করে মিথ্যা কথা বলে!
ব্যর্থ সৈনিকের মতো পুলিশ তবুও হাওয়ারিনের ঘর তন্নতন্ন করে ফেলল। একটা লাল মলাটের নামহীন বই ছাড়া আর তেমন কিছুই পাওয়া গেল না চোখে পড়ার মতো।
পুলিশ বইটি বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বাইরে বেরিয়ে আসলেন।
আমি নিখোঁজ। নিখোঁজই থাকলাম।
২৪ ঘন্টা পার হওয়ার আগেই আমার বাসার সামনে সাংবাদিকদের ভিড় হয়ে গেল। সাথে কিছু উৎসুক জনতা। মোড়ের চায়ের দোকানদার মামা এত পুলিশ-সাংবাদিক দেখে দোকান বন্ধ করে বসে রইল। তার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। তার দোকানে বসেই আমি সকালে, বিকালে চা খেতাম। মাঝে মাঝে লেখালেখিও করতাম তার চকিতে বসে। মামা আমার কবিতা শুনতে বায়না ধরতেন। আমি শোনাতাম।
আচ্ছা তাকে প্রশ্ন করা হলে সে-ও কি আমার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলবে? হাওয়ারিনের মতো?
আমার কাছের মানুষজনের সংখ্যা বরাবরই অনেক বেশি। সবাই-ই হাই প্রোফাইলড। এত এত মানুষকে জেরা করা তো চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু পুলিশ করল। কে জানি এক নতুন ইয়াং অফিসার এসেছে, রায়হান আজাদ, সে নাকি আমাকে খোঁজার জন্য রাত-দিন এক করে ফেলেছে।
ওইদিন দেখলাম সংবাদ সম্মেলনে বেচারা খাবি খেতে খেতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
“৭২ ঘন্টা পার হওয়ার পরেও লেখকের কোনো খোঁজ দিতে পারছেন না আপনারা, এতে কি তার জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে না?”
“আপনাদের নেক্সট স্টেপ কী সাফাত রাহমান কে খুঁজে পেতে?”
“সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আপনারা কি মনে করছেন এটা বিরোধী দলের চক্রান্ত?”
রায়হান আজাদ আবার মাছের মতো খাবি খাওয়া শুরু করল।
হা হা হা। স্টুপিড ম্যান!
যখন নিখোঁজ ছিলাম না, কারণে অকারণে মানুষকে দেখেছি আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য হামলে পড়তে। এরা বই পড়ে না। এরা লেখককে পড়ে না। এরা শুধু ভান করে।
একদিন এক বুকশো-তে রক্তজবা গাত্রবর্ণের এক বাঙালি তরুণীকে ঠান্ডা গলায় বলে বসেছি, “ইউ ডোন্ট ডিজারভ্ মাই অটোগ্রাফ বিকজ ইউ ডেফিনেটলি আর নট এ রিডার।”
তরুণী আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকশো থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। তার পেছনে পেছনে আধা সাংবাদিক ভাইগণেরা। আর বাকি আধা জড়ো হল আমার সামনে।
তরুণীর চেয়েও কয়েকশগুণ ভান করা মানুষ দিয়ে আমার জীবন এখন পরিপূর্ণ। আমি আছি এক ভানের জগতে। অনেকদিন পর সে কথা আবার মস্তিষ্ক ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে।
সেই রক্তজবা গাত্রবর্ণের তরুণীর কাছে আমি আজ ক্ষমাপ্রার্থী।
আমার নিখোঁজ হওয়ার রহস্য জানতে পুলিশ বাদে আর কাউকে তেমন বিচলিত হতে দেখা গেল না। আমার বাবা চিন্তা করতে লাগলেন কীভাবে তার মান-সম্মান রক্ষা করা যাবে, আর মা…থাক, মার কথা আর না-ই বলি।
কিন্তু শেষমেষ সবার জিজ্ঞাসাবাদে যা বের হয়ে আসল তা হলো – আমি গোড়া স্বভাবের, একগুঁয়ে, বদমেজাজি, অহংকারী আর ছন্নছাড়া একজন মানুষ, যার থাকা বা না থাকা একই কথা।
আজীবন নিজের ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করা আমার দারোয়ান রঘুও, দিনশেষে ফ্যাচফ্যাচ করতে করতে পুলিশকে জানায়, “আমারে একদিন এই মোডা একখান বই দিয়া মাইরে রক্ত বাইর করি দিছে স্যারে মাতার মধ্যি। নরকি যাইবে হামি বইলে দিলাম।”
আমার প্রকাশক মাথায় হাত দিয়ে হতাশ গলায় পুলিশকে বলেছেন, “আমি কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঝামেলাতে পড়েছি এই লোকের কারণে। এরকম ইরেস্পন্সিবল হলে চলে! আপনি কী ডাউট করছেন অফিসার? মদ-গাঁজা খেয়ে মরে টরে গেল না তো আবার?”
পুলিশ অফিসার এক ধমক দিয়ে বললেন, “এইসব আপনি কী বলছেন! সরেন এখান থেকে এক্ষুনি!”
প্রকাশক চুকচুক আওয়াজ করতে করতে বললেন, “না মানে…সামনে বইমেলা…বলেন দেখি আমার এখন কি হবে! কোনো অঘটন যদি ঘটেই যায় তাহলে তো…”
দুই কন্সটেবল এসে তাকে পাজকোলা করে বের করে দিলেন।
প্রকাশকের বেগতিক অবস্থা দেখে এবার আমি চুকচুক করতে লাগলাম।
কিন্তু শেষের ফলাফল শুন্যই।
পুলিশ বা সাংবাদিকরা জানল না আমি কোথায় আছি। আমার বাবা-মা জানল না তাদের ছেলে কোথায় আছে। আমার প্রকাশক বা রঘু জানল না তাদের এই ইরেস্পন্সিবল স্যার কোথায় আছেন। দোকানদার মামাও জানল না তার দোকানে রোজ আসা চা-পাগল ছেলেটা কোথায় আছে।
রক্তজবা গাত্রবর্ণের সেই তরুণীও জানল না আমার কথা। লেখক কোথায় আছেন। কী করছেন। কেন হারিয়ে আছেন।
লেখক নিখুঁতভাবে নিখোঁজ-ই থাকলেন।
কিন্তু আমার হাওয়ারিন তো জানত। তার কাছে আমি তো নিখোঁজ নই।
তার সাথে কাটানো বাস্তবের কিছু অলিক দৃশ্য নিখোঁজ আমার চোখের সামনে এখনও সতেজ, জীবন্ত। আবার নেহাত-ই কল্পনা।
হাওয়ারিনের উপুর হয়ে থাকা মাখনের মতো পিঠের উপর দিনের পর দিন আমি কাগজ বসিয়ে কলম হাতে যখন এক আকাশ সমান ভাবনাকে শব্দের ঠাসবুননে গাঁথার চেষ্টা করতাম, তখন সে জড়পদার্থের মতো শক্ত হয়ে নিঃশ্বাস চেপে রেখে জমে থাকত যাতে আমার হাত না কাঁপে…আমার লেখায় ব্যাঘাত না ঘটে। আমি লিখতাম আর লিখতাম। মাঝে মাঝে কাগজ ছিঁড়ে তার পিঠে কালি লেগে যেত…শরীরকে নিথর বানিয়ে দুই হাতের উপর মাথা রেখে তবুও হাওয়ারিন গুনগুন করে গান গাইত,
“ল্যাভেন্ডার ব্লু ডিলি ডিলি
ল্যাভেন্ডার গ্রীন
হোয়েন ইউ আর কিং ডিলি ডিলি
আই শ্যাল বি কুইন”
আমার মৃত শব্দেরা পরিশেষে প্রাণ পেত একমাত্র তার সম্মতিতে।
.
.
.
কাগজের পর কাগজ লেখক তার সামনে বসা নগ্ন নারীমূর্তিকে পড়ে শোনান। পড়তে পড়তে লেখকের অবাধ্য চোখ বারবার চলে যায় নগ্নিকার দেহের আঁকাবাঁকা ভাঁজে। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে কামনা নেই, আছে শুধু একটু অজানা আশ্রয় পাবার অবদমিত ইচ্ছা। কিন্তু নগ্নিকার সন্দেহজনক কুঞ্চিত ভ্রু দেখে লেখক আবার মনযোগী হন তার লেখনীতে।
এক অলৌকিক মোহে নগ্নগাত্র এই নারীমূর্তি লেখককে আচ্ছন্ন করে রাখে দিনের পর দিন। অগণিত সময় পার হয়ে যায় তাদের কত গল্প…কবিতায়…আর ভাষাহীন কথায়…
হঠাৎ এক কোমল, উষ্ণতা জড়ানো বাহুর স্পর্শে লেখকের সম্বিৎ ফেরে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে নগ্ন সেই নারীমূর্তি বলে,
“এত লিখতে লিখতে একদিন বই হয়ে যাবে।”
ফিয়ানা সাহিত্যপ্রেমী। যেকোন ধরনের বই তার প্রিয়। আর সে চেষ্টা করে কাগজে কলমে নিজের লেখার মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দিতে।
অনেক দিন পর এত সুন্দর একটা লেখা পড়লাম। লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞ।