আ লো চ না – ব ই
আদনান সহিদ
“কাগজ ও বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো আগুনের করালগ্রাসে নিমজ্জিত হওয়ার সময় কমলা লেলিহান শিখায় উপস্থিত জনতাকে হাত নাড়ছিল যেন! কাগজে লেখা শব্দগুলো বাক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল।”
এভাবেই দ্য বুক থিফ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মানির একটি শহরের নিত্য নৈমিত্তিক জীবন ও রূঢ় সমাজবাস্তবতা কেন্দ্রিক পটভূমি। অস্ট্রেলীয় ঔপন্যাসিক মার্কাস জুসাকের রচনায় ইতিহাসধর্মী দীর্ঘ এ উপন্যাসটি ২০০৫ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে ‘বেস্টসেলার‘ এর মর্যাদা পায়। মূলত ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় রচিত হলেও ৬৩ টি ভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রায় ১৬০ লক্ষ কপি বিক্রি হয় উপন্যাসটি।
উপন্যাসের উৎস
ঔপন্যাসিক মার্কাস জুসাকের মতে, দ্য বুক থিফ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তাঁর জার্মান পিতামাতার অভিজ্ঞতালব্ধ দুটি আলাদা ঘটনার অনুপ্রেরণায় রচিত, যার প্রথমটি মিউনিখ শহরে বোমাবর্ষণ নিয়ে এবং অপরটি এক কিশোর কর্তৃক রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে চলা রুগ্ন, বন্দি ইহুদিকে রুটি প্রদানকে কেন্দ্র করে। পরে সেই রুটি প্রদানকারী কিশোর ও রুগ্ন, কারাবন্দি উভয়েই নাৎসী সৈন্যদের দ্বারা প্রহৃত হয়।নির্মম ঘটনা দুটির মেলবন্ধন ও নাৎসি অধ্যুষিত জার্মানির নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে বিচরণকারী চরিত্রগুলোর প্রাণবন্ত উপস্থাপনই দ্য বুক থিফ উপন্যাসটিকে পাঠকনন্দিত করে তুলেছে।
কাহিনী সংক্ষেপ
১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে কিশোরী লিজেল মেমিঙ্গার ও তার ছোট ভাই ওয়ার্নার মেমিঙ্গারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের মা তাদেরকে দত্তক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে জার্মানির মিউনিখ শহরের পার্শ্ববর্তী হিমেল স্ট্রিটে বসবাসরত এক দম্পতির কাছে দুই ভাইবোনকে পৌঁছে দিতে রওনা হলে মাঝপথে প্রচন্ড শীত ও ক্ষুধায় লিজেলের ছোট ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
ভাইকে কবর দেওয়ার সময় কবর খননকারীর পকেট থেকে অজ্ঞাতে পড়ে যাওয়া দ্য গ্রেভডিগারস্ হ্যান্ডবুক নামের একটি বই চুপিসারে তুলে নেয় লিজেল। জীবনে প্রথম চুরি করা সেই বইটিকে একমাত্র স্মৃতি সঙ্গী করে অচেনা দত্তক দম্পতির পরিবারে নতুন জীবন শুরু করে লিজেল। সেখানে পালক পিতা হ্যানস হুবারম্যান হাতে–কলমে তাকে পড়াতেন, বাড়ির বেজমেন্টের দেওয়ালে ডিকশনারি এঁকে শেখাতেন নতুন নতুন শব্দ। এভাবে ধীরে ধীরে লিজেল বই পড়ায় আসক্ত হয়ে ওঠে। বই পড়ার তীব্র ঝোঁক থেকে এক পর্যায়ে শহরের রাস্তায় নাৎসি বাহিনীর পুড়িয়ে দেওয়া বইয়ের স্তুপ থেকে এবং পরবর্তীকালে মেয়রপত্নী ইলসা হারম্যানের ছেলের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থেকে বই চুরি করে এনে পড়া শুরু করে সে।
এদিকে হিমেল স্ট্রীটের স্কুল ও নতুন পরিবেশে লিজেলের সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ত বন্ধু হয় প্রতিবেশী কিশোর, রুডি স্টাইনার। ঘটনাক্রমে একদিন ম্যাক্স ভ্যান্ডেনবার্গ নামের এক ইহুদি যুবক এডলফ হিটলারের ইহুদি নিধন থেকে বাঁচতে হুবারম্যান পরিবারে গোপন আশ্রয় নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করে। লিজেলের সাথে ক্রমান্বয়ে ম্যাক্সের আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। ম্যাক্সের অনুপ্রেরণায় লিজেল দ্বিগুণ উৎসাহে বই পড়ার পাশাপাশি বিশ্বযুদ্ধ, হিটলার, নাৎসি বাহিনী, কমিউনিজম ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে জ্ঞানার্জন করতে থাকে। এভাবে ছোট-বড় আরও নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা–দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে ম্যাক্স–লিজেল–রুডি স্টাইনার ও হুবারম্যান দম্পতি তথা যুদ্ধাক্রান্ত হিমেল স্ট্রীটের জীবন সংকট নিরসনের যাত্রা।
উপন্যাসটির গুরুত্ব
দ্য বুক থিফ উপন্যাসে ‘বই‘ মানুষের আত্মিক ও দৈহিক মুক্তির এক সফল মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। বিরূপ ও স্থবির পরিস্থিতিতে বইয়ের প্রাণ সঞ্চারণশীল ভূমিকা উপন্যাসটির অন্যতম উপজীব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের প্রেক্ষাপটে ‘মুক্তি‘ ও ‘বন্দিত্ব‘ ছিল পরস্পরবিরোধী অথচ চরম উচ্চারিত দুটি শব্দ ও আলোচ্য ধারণা।যুদ্ধের নৃশংসতা, ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মনোদৈহিক মুক্তিলাভ ছিল যুদ্ধাক্রান্ত মানুষের একমাত্র আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। কিন্তু যুদ্ধ ভয়াবহতায় নিমজ্জিত মানুষের পক্ষে আদতে মুক্তি পাওয়া সহজ তো ছিলই না বরং উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ইহুদি যুবক, ম্যাক্স ভ্যানডেনবার্গের মতো যুদ্ধবিরোধী কিংবা ভিন্নমতাবলম্বীদের বরণ করতে হয়েছিল প্রাণনাশের হুমকিসহ অসহনীয় বন্দিত্ব, দণ্ডাদেশ। মুক্তি ও বন্দিত্বের এই বিপরীতমুখী খেলায় ক্ষণিক শান্তি, আত্মিক মুক্তির রেশ নিয়ে এসেছিল উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র লিজেল মেমিঙ্গারের চুরি করা বই, বইয়ের শব্দ, বাক্য ও ঘটনাগুলো। বই–ই হয়ে উঠেছিল লিজেলের অব্যক্ত, অশ্রুত প্রকাশ মাধ্যম, যা তার পালক পিতা হ্যান্সের বাজানো বাদ্যযন্ত্রের মতো হৃদয়কে আন্দোলিত করত। আর তাই হয়তো নিজ ডায়েরিতে বই, বইয়ের অন্তর্গত শব্দের ভূমিকাকে এভাবে প্রকাশ করতে দেখি ‘বইচোর‘ লিজেলকে।
শব্দকে আমি ভালোবেসেছি, করেছি ঘৃণাও। আশা করি, শব্দকে অবশেষে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছি।
বস্তুত বই পড়ার মাধ্যমে অনাথ, ভাইহারা লিজেল তার অন্তর্নিহিত শঙ্কাকে দূর করতে পেরেছিল, সঞ্চয় করতে পেরেছিল যুদ্ধাবস্থায় টিকে থাকার প্রয়োজনীয় সাহস। শুধু তাই নয়, আত্মগোপনে থাকা মৃতপ্রায় যুবক ম্যাক্সকে দিনের পর দিন বইয়ের শব্দ, কথামালা, গল্প পড়ে শুনিয়ে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সে। এমনকি যুদ্ধ শুরুর এক পর্যায়ে, বিমান থেকে প্রবল বোমাবর্ষণের মুখে লিজেলকে পাওয়া যায় বই থেকে আহরিত গল্প শুনিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত প্রতিবেশীদের ভেতর সাহস সঞ্চয় করাতে।
“বইয়ের পৃষ্ঠার ঘ্রাণ নিত সে (লিজেল)। তার চারপাশে জড়ো হয়ে থাকা শব্দগুলোর স্বাদও যেন বুঝতে চাইত।”
প্রকৃতপক্ষে বইয়ের সান্নিধ্যেই লিজেল খুঁজে পেয়েছিল নিজের এক নতুন পরিচিতি। যে পরিচিতি আবিষ্কারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন তার পালক পিতা হ্যান্স হুবারম্যান এবং বন্ধুসম ম্যাক্স। নিজের লেখা দুটি বই উপহার দেওয়া ছাড়াও লিজেলকে বইয়ের জগতে অবাধ বিচরণে অনুপ্রাণিত করেছিল ম্যাক্সই। এজন্যই হয়তো প্রায় বছর দুয়েক লিজেলের সাথে বন্দিদশা পার করার ম্যাক্স যখন বেসমেন্ট ছেড়ে মুক্তির আশায় বের হয়ে যাচ্ছিল, ঔপন্যাসিক তখন তাদের দু’জনের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিয়েছিলেন নিম্নোক্ত উক্তিটি:
“একজন ছিল বইচোর,
অপরজন চুরি করেছিল সমস্ত আকাশ।”
সত্যিই তাই! মৃতপ্রায় বন্দি ম্যাক্সকে বাঁচিয়ে রেখে একদিন মুক্ত আকাশ দেখতে সাহায্য করেছিল তো এই বই, বইচোর আর বইয়ের শব্দগুলোই।
তবে দ্য বুক থিফ–এ কেবল বইয়ের মাহাত্ম্য কিংবা ভূমিকা ফুটে উঠেছে এমন বললে ‘বড়‘ ভুল হবে। এটি বিশ্ব ইতিহাসের এক শৈল্পিক দলিলও বটে। উপন্যাসটিতে একদিকে চিত্রিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নৃশংসতা, কর্মহীনতা, যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনে অনিশ্চয়তা, নাৎসী বাহিনীর দমন–পীড়ন, বোমা বর্ষণ, প্রিয়জনের বিচ্ছেদ ও ধ্বংসযজ্ঞের করুণ আখ্যান। অন্যদিকে সম্পূর্ণ অচেনা পরিবারে অসহায় ও যুদ্ধক্রান্তকে আশ্রয়, আত্মত্যাগ, পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা, সর্বোপরি মানবিকতার মুক্তি ও বিজয়ের সফল প্রতিফলন ঘটেছে। বৈচিত্র্যময় নানা ঘটনাপ্রবাহের সংমিশ্রণ উপন্যাসটিকে করে তুলেছে উপভোগ্য।
পুরো উপন্যাসটি ‘মৃত্যুকে‘ দার্শনিকভাবে ব্যক্তি–রূপক অর্থে ব্যবহার করে বর্ণনা করা হয়েছে — যুদ্ধের ভয়াবহতা, মানুষের নৃশংসতা তুলে ধরে একপর্যায়ে ‘মৃত্যুর‘ বয়ান, “মানুষই আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।”
উপন্যাসের শেষ দিকে কিছু মর্মান্তিক ঘটনা উক্তিটির যথার্থতা প্রমাণ করে। উপন্যাসের বর্ণনাশৈলী, কথোপকথন ও চরিত্রের সজীব উপস্থাপনা পাঠকের মানসচোখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা তুলে ধরবে, তৈরি করবে সমব্যথী আবহ। একই সাথে এর বিষয়বস্তু ও ঐতিহাসিক পটভূমি স্বভাবতই পাঠক মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রাখবে। দ্য বুক থিফ তাই হয়ে উঠতে পারে কিশোর থেকে পরিণত সব বয়সী পাঠকের পছন্দসই এক বই। ঐতিহাসিক কাহিনীনির্ভর অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি কিংবা দ্য বয় ইন দি স্ট্রাইপড পাজামাস-এর পাঠকরা দ্য বুক থিফ–কে অনায়াসেই নিজ পছন্দ তালিকায় স্থান দিয়ে দেবেন।
২০১৩ সালে উপন্যাসটির অবলম্বনে একই শিরোনামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তবে চলচ্চিত্র ও উপন্যাস দুটিতেই আগ্রহীদের প্রথমে উপন্যাসটি পড়ার ও এর শব্দগুলি উপলব্ধি করার পরামর্শ থাকবে। কারণ উপন্যাসের একপর্যায়ে লেখক মার্কাস জুসাক বলেছেন,
শব্দ। কেন তাদের অস্তিত্ব টিকে আছে? শব্দ ছাড়া কোনো কিছুরই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না যে!
আর হয়তো এজন্যই পুনরায় শব্দ তথা উপন্যাসটির গুরুত্ব নিশ্চিত করেছেন:
“সে (লিজেল) একাধারে শব্দ দেখতেই থাকত।”
আদনান সহিদ লিখতে অণব ভালোবাসেন। শব্দেরা তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু,তাঁর হয়েই কথা বলে। পাঠকেরা সে কথামালায় যোগ দিলে এক ‘আনন্দমেলা’ তৈরি হয় বলে তাঁর বিশ্বাস।