বাংলা সাহিত্যের প্রভাব বিস্তারকারী নারী চরিত্ররা

Editor
16 Min Read

আ লো চ না – সা হি ত্য


তানজিনা তাবাস্‌সুম নোভা


বাংলা সাহিত্যের রয়েছে সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। অনেক কালজয়ী সাহিত্যকর্মের সাথে সাথে এই সাহিত্য আমাদের স্মরণীয় অনেক চরিত্রও উপহার দিয়েছে। বাংলায় রচিত নারী চরিত্র-প্রধান গল্প, উপন্যাস বা নাটকের পরিমাণ সংখ্যায় কিছুটা কম হলেও বেশ কিছু স্মরণীয় নারী চরিত্রের সাথেও আমাদের পরিচয় ঘটেছে। নারী দিবসকে উপলক্ষ করে, বাংলা সাহিত্যের তেমন কিছু নারী চরিত্র নিয়ে এই লেখাটি সাজানো হয়েছে, যাদের প্রভাব বই পড়ে শেষ করার দীর্ঘকাল পরেও পাঠকের মনে থেকে যায়।

নন্দিনী (রক্তকরবী, রবীন্দ্রনাথ) 

যক্ষপুরীর মাটির তলায় প্রচুর স্বর্ণ মজুদ রয়েছে। একদল শ্রমিক মাটির নিচে সুড়ঙ্গ কেটে দিনরাত সেই স্বর্ণ তোলায় ব্যস্ত। এই প্রক্রিয়ার ফলে পুরো যক্ষপুরীই হয়ে পড়েছে প্রাণহীন। এই রাজ্যের রাজাও সবসময় থাকেন এক রহস্যময় জালের আড়ালে। এমন সময় সেখানে প্রাণের সুবাতাস নিয়ে হাজির হয় নন্দিনী। 

নন্দিনী প্রকৃতির প্রতীক, প্রাণশক্তির প্রতীক। তার সংস্পর্শে যক্ষপুরীর আধমরা মানুষগুলো আবার জেগে ওঠে, বিশুপাগল আবার গান গায়। এমনকি রাজাও চান নিজের জাল ভেদ করে নন্দিনীর কাছে আসতেসবাই নন্দিনীকে নিজের করে পেতে চাইলেও নন্দিনী ভালোবাসে রঞ্জনকে, তার জন্যই সে অপেক্ষা করে। তার জন্যই সে রক্তকরবী ফুলের মালাকে নিজের অলঙ্কার করে। অবশেষে রঞ্জন আসে, কিন্তু ততক্ষণে সে মৃত। তার মৃত্যুই যক্ষপুরীতে এক বিপ্লবের সূচনা করে। এই মৃত্যুর সাথে সাথেই রাজা সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে পথে নেমে আসেন। সব যান্ত্রিক নিয়মের অবসান ঘটে যক্ষপুরীতে মানবতার জয়গান ঘোষিত হয়। আর এ সবকিছুই সম্ভব হয় শুধু একজনের জন্য: নন্দিনী।

সত্যবতী (প্রথম প্রতিশ্রুতি, আশাপূর্ণা দেবী) 

*স্পয়লার অ্যালার্ট* 

মাত্র আট বছর বয়সেই কন্যার বিয়ে দিয়ে গৌরীদান করেন রামকালী কবিরাজকন্যা সত্যবতীর জীবনে পিতা রামকালীর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি যে পুরোপুরি সংস্কারমুক্ত ছিলেন তা নয়, কিন্তু তাঁর প্রশ্রয়েই সত্যবতীর প্রাথমিক বিদ্যা অর্জনটুকু হয়। বিয়ের পর সেই সত্যবতী গিয়ে পড়ল প্রতাপশালী শাশুড়ি এলোকেশী আর লালসাগ্রস্ত শ্বশুর নীলাম্বরের সংসারে। তার স্বামী নবকুমার মোটামুটি ভালো মানুষ হওয়ায় সে সত্যবতীর জন্য খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে নি। 

ছোটবেলা থেকেই সত্যবতী ছিল বুদ্ধিমতী, সত্যবাদী, ন্যায়নিষ্ঠ ও দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী। বিয়ের পর একটু বয়স বাড়লে সে শাশুড়ির বিভিন্ন অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতে শুরু করে। একসময় পুরোপুরি শাশুড়ির অমতে সে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমায়। তার আশা ছিল ছেলেদের ভালো পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করে তুলবে। এমনকি সে নিজে নবকুমারের মাস্টারের কাছে পড়ে এবং অন্য মেয়েদের পড়তে সাহায্য করে। অধিক বয়সে একমাত্র মেয়ের জন্মের পর সে মেয়েকেও পড়াশোনা শেখানোর সংকল্প নেয়। গল্পের শেষ পর্যন্ত সত্যবতী তার ন্যায়নিষ্ঠার প্রতি অবিচল থাকে। তার শাশুড়ি আর স্বামী মিলে যখন তার আট বছর বয়সী কন্যা সুবর্ণলতাকে বিয়ে দিয়ে দেয়, স্বামীর এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রত্যুত্তরে সত্যবতী একবারের জন্যও পেছনে না ফিরে তাকিয়ে চিরকালের মতো সংসার ত্যাগ করে। এই উপন্যাসটি এমন এক সময়ের গল্প বলে, যখন সমাজে নারীদের কোনো মর্যাদা ছিল না। তার মধ্যেই সত্যবতীর আপোসহীন চরিত্র পাঠককে অনুপ্রাণিত করে।   

সুবর্ণলতা (সুবর্ণলতা, আশাপূর্ণা দেবী) 

আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতী ট্রিলজি- দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে সুবর্ণলতা এই গল্পটা সত্যবতীর মেয়ে সুবর্ণলতার আট বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার জায়গা হয় এক বিরাট যৌথ পরিবারের শ্বশুরবাড়িতে এত বড় সংসারের সব দায় যেন কিশোরী সুবর্ণর ওপরেই এসে পড়ে তার সংসারত্যাগী মায়ের কথা তুলে সারাজীবন তাকে খোঁটা দেওয়া হয় স্পষ্টভাষী হওয়ার কারণে শাশুড়ি ও ভাজদের সাথে তার নিয়মিত ঠোকাঠুকি হয় তারপরেও হাজার চেষ্টা করে তার অতি ডাকাবুকো শাশুড়ি মুক্তকেশী সুবর্ণকে দমাতে পারেন নি মায়ের অতি বাধ্য ছেলে, সুবর্ণর স্বামী প্রবোধও তাকে কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করে নি, তাই তার হাতে মার খাওয়াও ছিল সুবর্ণর জন্য নিয়মিত ঘটনা 

এতভাবে তাকে আটকে রাখার পরও সুবর্ণ ঠিকই ডানা মেলতে চায় বাড়ির অন্যরা যখন বিকেলে বিশ্রামে ব্যস্ত, সে তখন বই পড়ত ওটুকুই ছিল তার মুক্তির জানালা শেষ পর্যন্ত সে তার পরিবারে কিছু পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়; কিন্তু সারাটা জীবন যে কষ্টের মধ্য দিয়ে সে গেছে, তার তুলনায় এই পরিবর্তনকে আসলে যথেষ্ট মনে হয় না এত কিছুর মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও যে সে কখনও হাল ছেড়ে দেয় নি — এটাই আমার সুবর্ণলতার চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক বলে মনে হয়। 

দীপাবলি (সাতকাহন, সমরেশ মজুমদার) 

চা বাগানে বেড়ে উঠেছিল দীপাবলি নামের দুরন্ত মেয়েটি দশ বছর বয়সে যার বিয়ে হয়ে যায় এক গুরুতর অসুস্থ তরুণের সাথে বিয়ের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বরের মৃত্যুর পর বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকে তাকে বৈধব্যজীবন পালন করতে হয় ছোট মেয়েটি এক নিমেষেই অনেক বড় হয়ে যায় এর মধ্যেই সে তার পড়াশোনা চালিয়ে যায়, মাধ্যমিকে দারুণ ফলাফল করে জলপাইগুড়ির কলেজে ভর্তি হয় এরপর কলকাতায় উচ্চশিক্ষা, চাকরি… বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতে তার জীবন এগিয়ে চলে    

সাতকাহন এক সাধারণ মেয়ের নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার গল্প নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোকেও বাহুল্য মনে করেছে অন্যভাবে বললে বলা যায়, দীপাবলি জীবনে এতরকম খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, যে কারণে সে কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পায় বর্তমানে দাঁড়িয়ে দীপাবলিকে কারো অতিরিক্ত কঠোর বলে মনে হতে পারে, কিন্তু যে সময়ের প্রেক্ষাপটে গল্পটি লেখা হয়েছে, আর যেসব কিছু দীপাবলির সাথে হয়েছে—এগুলো বিবেচনা করলে দীপাবলির আচরণ অনেকাংশেই যৌক্তিক বলে মনে হয় আমার।             

সুজাতা (হাজার চুরাশির মা, মহাশ্বেতা দেবী)   

সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার তরুণ আদর্শের টানে পথে নেমে এসেছিল। সেই আন্দোলনে যোগ দেওয়া তরুণদের একজন ছিল ব্রতী। দলের কোনো কোনো সদস্যের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ধরা পড়ার পর পুলিশি নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়। 

এই ছোট উপন্যাসটি বর্ণিত হয়েছে ব্রতীর মা, সুজাতার দৃষ্টিকোণ থেকে। ব্রতী যে নিজের বাবার মতো অর্থলোভী, ভোগসর্বস্ব না হয়ে, আদর্শের কারণে ঘর ছেড়েছিল, তার পেছনে সুজাতার অবদান অনেকখানি। তিনি নিজে কখনও মুখ ফুটে তাঁর স্বামী ও অন্য সন্তানদের এসব আচরণের বিরোধিতা করেন নি। কিন্তু তিনি যা পারেন নি, তা-ই ব্রতী করে দেখিয়েছে। রাতে একা ঘুমোতে ভয় পাওয়া তাঁর ছেলেটা কবে এত বড় হয়ে গেল, সুজাতা বুঝতে পারেন না। ছেলের মৃত্যুর পর তিনি যতই ছেলের বন্ধু, রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে কথা বলেন, ততই তিনি ছেলেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। ব্রতীর মৃত্যুর পর পরিবারের বাকিরা বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে নিজেদের মানসম্মান বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তার জন্য শোক করার সময়টুকুও কারো হয় না। তা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। এখান থেকেই তাঁর সরব প্রতিবাদের শুরু। ব্রতীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর দিনই তাঁর এক মেয়ের এনগেজমেন্টের দিন ধার্য করা হয়, তিনি এই সিদ্ধান্তের কোনো বিরোধিতা না করলেও অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি, আয়োজন থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখেন। 

ব্রতীর লাশ শুধু একটা সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত ছিল: ১০৮৪, তাই সুজাতা হাজার চুরশির মা। কিন্তু গল্প যত এগিয়ে যায়, সুজাতা শুধু একজন হাজার চুরাশির মা থাকেন না, তিনি এমন শত শত হাজার চুরাশির মা-তে পরিণত হন। মাতৃত্বের এমন চিত্রায়ণ বাংলা সাহিত্যে বিরল।   

অপালা (গান্ধর্বী, বাণী বসু)   

তানপুরাটা হাতে নিয়ে গাইতে শুরু করলেই অপালা আর মনুষ্যলোকে থাকে না, সে হয়ে যায় গন্ধর্বলোকের (বা সুরলোক) বাসিন্দা—তাই সে গান্ধর্বী। বাবা মারা যাওয়ার পর জেঠুর কড়া শাসনের মধ্যে বড় হয়েও গান গাওয়া সে ছাড়তে পারে নি। এক প্রতিযোগিতায় গাইতে গিয়ে সে বিখ্যাত গায়িকা নাজনীন বেগমের নজরে পড়ে, যিনি তাকে লখনৌতে নিজের কাছে রেখে তালিম দিতে চান। কিন্তু জেঠুর প্রবল আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয় না, উল্টো সেই একই অনুষ্ঠানে তার গান শুনে মুগ্ধ হওয়া একজনের সাথে তার বিয়ে হয়ে যায়। সারাজীবন শুধু গানকেই ভালোবেসে যাওয়া অপালার জীবনে এরপর শুধু হেঁসেল ঠেলা আর বছর বছর সন্তান উৎপাদন করা। গানের স্থান আর সেখানে কই!

অপালা খুব নির্মল, অপাপবিদ্ধ; হয়তো একটু বেশিইঅতটা সরল না হলে হয়তো তার জীবনটা আর একটু সহজ হতো। তারপরেও গানের প্রতি তার টান, সোহমের সাথে তার বন্ধুত্ব, শ্বশুরবাড়ির এত ঝামেলার পরেও তার গানের চর্চাটা ধরে রাখার চেষ্টা—এসব কিছুর জন্য অপালাকে যেকোনো পাঠকের ভালো লাগতে বাধ্য। বইয়ে ধ্রুপদী সংগীতের অনেক পরিভাষার উল্লেখ আছে, সেসবের সাথে পরিচিতি না থাকলে গল্পের সাথে সংযোগ ঘটাতে পাঠকের সামান্য সমস্যা হতে পারে, কিন্তু অপালার সাথে সংযোগ ঘটাতে পাঠকের কোনো সমস্যা হয় না।       

অঙ্গনা (অনাম্নী অঙ্গনা, বুদ্ধদেব বসু) 

রাজা বিচিত্রবীর্য অকালপ্রয়াত বংশ রক্ষার জন্য ব্যাসদেবের ঔরসে তাঁর স্ত্রী অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম হলেও তিনি জন্মান্ধ হওয়ার কারণে সিংহাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত তাই রাজমাতা সত্যবতী অম্বিকাকে আবার ব্যাসদেবের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্য প্ররোচিত করেন। প্রথমে রাজি না হলেও রাজমাতার বারবার অনুরোধে অম্বিকা রাজি হন কিন্তু তিনি তাঁর দাসী অঙ্গনাকে তাঁর মতো সাজিয়ে ব্যাসদেবের শয্যায় পাঠান

মহাভারত-আশ্রিত এই কাব্যনাট্যের মূল চরিত্র অঙ্গনা গল্পের শুরুতে আমরা তাকে দেখতে পাই ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর; নিজের পছন্দের সেই তন্তুজীবী যুবার সাথে সংসার পাতার জন্য সে অম্বিকার কাছে মুক্তি প্রার্থনা করে। এই প্রার্থনায় অম্বিকা প্রথমে সম্মত না হলেও পরে ব্যাসদেবের সাথে শয্যায় যাওয়ার জন্য অঙ্গনাকে প্ররোচিত করার সময় তিনি জানান যে, এক রাতের এই রাজেন্দ্রাণী হওয়ার বিনিময়ে সে তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পাবে। কিন্তু দাসী হলেও অঙ্গনা লোভী নয়, তাই এই প্রতারণার প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দেয়। অনেক চেষ্টা করে অম্বিকা তাকে রাজি করান। সেই এক রাতের পর অঙ্গনা যেন পাল্টে যায়। ঋষি তাকে বর দিয়েছেন যে তার পুত্র হবে ধীমান, প্রাজ্ঞ আর মৃদুভাষী। তাই সে আর মুক্তি চায় না, নিজের সন্তানের বেড়ে ওঠা দেখতে সে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে দাসী হয়েই থেকে যেতে চায়। এই প্রথম আমরা তাকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখি, সরাসরি অম্বিকার কথার বিরুদ্ধাচরণ করতে দেখি। এভাবেই নাটকের প্রথমাংশের স্বপ্ন দেখতে থাকা অঙ্গনা শেষে এসে বলিষ্ঠ, স্বাবলম্বী ও অনন্য এক চরিত্রে পরিণত হয়।

ইন্দ্রাণী (কাছের মানুষ, সুচিত্রা ভট্টাচার্য)         

*স্পয়লার অ্যালার্ট* 

আমাদের কাছের মানুষেরা হয়তো আমাদের ততটা কাছের নয়, যতটা আমরা মনে করি আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে একা এই বিশাল কলেবরের উপন্যাসটির গল্প এমন কিছু কাছের মানুষদের নিয়ে, যে গল্পের কেন্দ্রে আছে মা-মেয়ে ইন্দ্রাণী ও তিতির 

গল্পের যৌথ পরিবারটির হাল ধরে আছে বাড়ির বড় বউ ইন্দ্রাণী স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি এই পরিবারের দীর্ঘদিনের ব্যবসা, ছোট প্রেসটির দেখাশোনাও সে-ই করে ছেলে বাপ্পা আর মেয়ে তিতির তো আছেই, সেই সাথে অসুস্থ শ্বশুর জয়মোহন আর বিভিন্ন ব্যবসায় অকৃতকার্য হয়ে ভগ্ন মানুষ, মদ্যপ বর আদিত্যকে সামলানোর ভারও তার ওপর।  

ইন্দ্রাণী সাহসী, বুদ্ধিমতী, স্পষ্টভাষী কলেজের বন্ধু শুভাশিসের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে নানা সময় নানা কথা উঠেছে, কিন্তু ইন্দ্রাণী যেভাবে সেসব কথাকে পাত্তা না দিয়ে সম্পর্কটা বজায় রেখেছে, তা থেকে আমরা তার দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় পাই এছাড়াও, তার শেষ পরিণতির কথা যদি চিন্তা করি, তাতেও তার আত্মসম্মানবোধ ফুটে ওঠে আজীবন ছোট হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে সে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছে 

মাধবীলতা (কালবেলা, কালপুরুষ, সমরেশ মজুমদার) 

স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তির উদ্দেশ্য নিয়ে যেদিন অনিমেষ জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা শহরে পা রাখলো, সেদিন কলকাতা ছিল উত্তাল। কারফিউর মধ্যে তাকে রাস্তায় দেখে সন্দেহবশত পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। ফলাফল: গুরুতর আহত হয়ে সে তিন মাস হাসপাতালে শয্যাশায়ী, আর শিক্ষাজীবনের এক বছর নষ্ট। এরই মাঝে সে বামপন্থী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সে আকর্ষণ কেটেও যায়। ধীরে ধীরে অনিমেষ যুক্ত হয়ে পড়ে নকশাল আন্দোলনের সাথে। তারপর তার জীবনে আসে মাধবীলতা। সে রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত নয়, কিন্তু তার রাজনীতি-সচেতনতা প্রখর। রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সে অনিমেষের সাথে তর্ক করে, কিন্তু অনিমেষের কর্মকাণ্ডে সে কখনও বাধা দেয় না, তার ওপর কখনও বিশ্বাস হারায় না। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে যাওয়া অনিমেষের জন্য সে অপেক্ষা করে গেছে, এমনকি তার বাবা-মা এ সম্পর্ক মানতে রাজি না হওয়ায় তাদের সাথেও সম্পর্কচ্ছেদ করেছে

কালপুরুষ-এ এসে দেখা যায়, অনিমেষ আর ছেলে অর্ক-কে নিয়ে মাধবীলতা এক বস্তিতে থাকে। শিক্ষকতা আর প্রাইভেট টিউশন করে একা হাতে কোনোমতে সংসারকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বস্তির পরিবেশে ছেলে বখে যেতে পারে, মাধবীলতার এই ভয় একসময় সত্যি হয়েই দেখা দেয়। পরে অবশ্য অর্কর ভুল ভাঙে। এই ভুল ভাঙার পেছনেও মাধবীলতারই ভূমিকা রয়েছে, কারণ অর্কর কাছে তো তার মা-ই সব, ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটা বাবা অনিমেষকে সে হয়তো কিছুটা করুণাই করে। 

মাধবীলতার চারিত্রিক দৃঢ়তা, অনিমেষের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা, বিশ্বাস—সবই খুব প্রশংসনীয়। অর্ক পুলিশের হাতে আটক হলে ছেলের ওপর তার অগাধ আস্থারও পরিচয় পাওয়া যায় কিন্তু, অনেক ক্ষেত্রে তার চরিত্রটিকে পাঠকের কাছে কিছুটা অতিমানবীয় বলেও মনে হতে পারে, কারণ নিজেকে এতটা বিলিয়ে দেওয়া, এতটা নিঃস্বার্থ হওয়া কি কারো পক্ষে সম্ভব? অথবা এমনটা কি আদৌ কারো হওয়া উচিত? — একজন পাঠক হিসেবে আমার মনে অন্তত এ প্রশ্ন এসেছে।      

মৃণাল (স্ত্রীর পত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)  

কলকাতার এক তীব্র পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের মেজ বউ মৃণাল তার শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে পুরী থেকে সে তার স্বামীকে চিঠি লেখে তার এই চিঠিতে তার স্বামীর নামের কোনো উল্লেখ নেই, বরং মনে হয় যেন সমগ্র পুরুষ জাতিকে উদ্দেশ করেই এই চিঠি লেখা হয়েছে 

উদারমনা মৃণাল তার শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সকলের চাইতে আলাদা সে কবিতা লেখে, প্রাণীদের প্রতি তার মমতা অসীম তার বড় জায়ের ছোট বোন বিন্দু আত্মীয়দের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিল মৃণালকে সে খুব ভালোবাসত তাকে এক পাগলের সাথে বিয়ে দেওয়া হলে সে আবার পালিয়ে চলে আসে মৃণালের সমস্ত আপত্তি অগ্রাহ্য করে বিন্দুকে আবার জোর করে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো হলে সে আত্মহত্যা করে 

এই যে সে কিছুই করতে পারল না, এটাই মৃণালের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল সে শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করল তার লেখা চিঠির প্রতিটি বাক্যের মধ্য দিয়ে তার আত্মমর্যাদাবোধ ঠিকরে বেরোয় শুধু কারো স্ত্রী, কোনো ঘরের বউ হওয়ার জন্যই যে নারীদের জন্ম হয় না—এই কথাটি তার চিঠির সমাপনীতে সে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়: 

তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন—

 মৃণাল।  

       


লেখক টিডিএ এডিটোরিয়াল টিমের একজন সদস্য।

 

Share this Article
Leave a comment