আদনান সহিদ
১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে প্রতি বছর ৮ই মার্চ সারা বিশ্বে নারী দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। নারী অধিকারে সমতা প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে নারীদের অবদানের মূল্যায়ন করাই এই দিবস পালনের মূল লক্ষ্য। তাই শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিকভাবেই নয়, অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে নিজের জীবনের নারীদের নিয়েও দিবসটি উদযাপন করে থাকেন। সেই উদযাপনের অংশ হিসেবে গোটা বিশ্বে নারী–পুরুষ উভয়েই তাদের নিজ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নারীদের বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে থাকেন।
বহু বছর ধরে প্রচলিত এসব উপহার সামগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে বর্ণিল নানা জাতের ফুল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই নারী দিবসের সাথে ফুলের একটা ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক লক্ষ করা গেছে। সংবাদমাধ্যম এনপিআর এর তথ্যমতে, সর্বপ্রথম ৮ মার্চ, ১৯৪৬ সালে ইতালিতে ‘শক্তি, সংবেদনশীলতা বিচক্ষণতার‘ প্রতীক হিসেবে মিমোসা ফুল উপহার দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। সেই সূত্রে নারী দিবসের উপহার হিসেবে এই ফুল ব্যতিক্রমী গুরুত্ব বহন করছে। তবে অন্যান্য কিছু বিশেষ ফুলও ঐতিহ্যগতভাবে উপহার তালিকায় স্থান পেয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন দেশে উপহার হিসেবে ব্যবহৃত ফুলগুলোর কথা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো এখানে।
মিমোসা
প্রথমেই আসা যাক মিমোসা ফুলের কথায়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সাথে এ ফুলের নামটি সর্বপ্রথম জড়িয়ে যায় ইতালিতে। ১৯৪৬ সালে, রাজনৈতিক দল ‘ইউনিয়নে ডনে ইটালিয়ানে‘ (দ্য ইটালিয়ান উইমেন্স ইউনিয়ন) ‘ফেস্তা ডেলা ডোনা‘ শিরোনামে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে যাদের মূল লক্ষ্য ছিল ‘নারীর সমতা রক্ষার লড়াই‘।
‘ইউনিয়নে ডনে ইটালিয়ানে‘ দলটির সদস্যরা সর্বপ্রথম ৮ মার্চ, ১৯৪৬ সালে মিমোসা ফুলকে ‘উদযাপনের প্রতীক‘ হিসেবে ব্যবহার করেন। সে সময় আনুষ্ঠানিকভাবে মিমোসা কে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল ফুলটির প্রাচুর্য এবং ফোটার মৌসুম। এছাড়াও সম্ভবত হলুদ রঙের ফুলটির ‘আনন্দদায়ক‘ প্রতীকী তাৎপর্যের কথাও তখন বিবেচনা করা হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মিমোসা ফুল মূলত শক্তি, সংবেদনশীলতা ও বিচক্ষণতার প্রতীক। এ বিবেচনায় ইতালিসহ প্রায় সব দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সকল বয়সী নারীদের মাঝে পারস্পারিক এ ফুলের তোড়া বিনিময়ের প্রচলন রয়েছে।
এবার দেখা যাক, মিমোসা ছাড়া আর কোন বিশেষ ফুলগুলো ‘নারী দিবস‘ সাফল্যমন্ডিত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
গোলাপ
কেবল ভালোবাসা দিবস–ই নয়, আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও গোলাপের বহুল ব্যবহার প্রচলিত। বর্ণিল রঙের গোলাপ সবার জীবনে অণুপ্রেরণাদায়িনীদের জন্য এক চমৎকার উপহার হতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী দিবস উদযাপনে তাই মিমোসা ফুলের পাশাপাশি গোলাপের ব্যবহার বিশেষ লক্ষণীয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় রাশিয়ায় নারী দিবসে সবচেয়ে বেশি ফুল ও উপহার সামগ্রী বিনিময় করতে দেখা যায়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের দিনটিতেই রাশিয়াতে প্রায় ১,৫০,০০০ লাল গোলাপ বিক্রি হয়।
উদযাপনের অংশ হিসেবে এক তোড়া গোলাপ বিনিময় নিশ্চিতভাবেই বিশুদ্ধ ভালোবাসা, স্নেহ ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ। গোলাপি রঙের গোলাপ প্রেমের চিহ্ন, সাদা গোলাপ হৃদয়ের বিশুদ্ধতা এবং হলুদ গোলাপ বন্ধুতার প্রতীক হিসেবে আবহমান কাল ধরে বন্ধু ও সহকর্মীদের মাঝে বিনিময় করা হয়ে আসছে।
টিউলিপ
নারী দিবস সংশ্লিষ্ট আরেকটি চমৎকার ফুল হলো টিউলিপ। আকর্ষণীয় রঙ ও গঠনের এই চমৎকার ফুলটি নারী দিবস উদযাপন ও এর ছুটির দিনকে ব্যতিক্রমী আমেজে ভরিয়ে তোলে। চমৎকার সুঘ্রাণ এবং বর্ণ বৈচিত্র্যে টিউলিপ অনেকের কাছেই পছন্দসই এক নাম। পৃথিবীর অনেক দেশেই লাল টিউলিপ বিনিময়কে ভালোবাসার ঘোষণা স্বরূপ ধরে নেওয়া হয়। অপরদিকে, হলুদ রঙের টিউলিপ বিনিময় পুরোপুরিভাবে প্রেমে পড়াকে নির্দেশ করে।
পিওনি
পিওনিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ‘ফুলের রাণী‘ বলা হয়ে থাকে। প্রধানত এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাংশে জন্মানো এই ফুলটি লাল, সাদা, গোলাপি সহ নানা রঙের হয়ে থাকে। ভালোবাসা, সৌভাগ্য, সহানুভূতি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ফুলটির ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।
লিলি
মাতৃত্ব, আবেগ ও সৌন্দর্যের প্রতীক এবং নারী দিবসের অন্যতম পছন্দের ফুল হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে লিলি। দিবসটি উদযাপনে অনেকেই গোলাপ ও লিলির চমৎকার মিশেলে তোড়া বানিয়ে উপহার দেন। যৌথ ফুলের এ ধরনের তোড়া মূলত প্রেম ও সৌন্দর্যের নিখুঁত এক ভারসাম্য রক্ষা করে। বৈচিত্র্যভেদে লিলি ফুল ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। উদাহরণস্বরূপ, সাদা লিলি নির্মলতা ও বিশুদ্ধতার প্রতীক। আবার, কয়েক রঙের লিলির সংমিশ্রণে সুখ ও আনন্দানুভূতি প্রকাশ করা হয়।
জারবেরা
নারী দিবসের আরেকটি জনপ্রিয় ফুল জারবেরাকে শুদ্ধতা, নির্মলতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্ণিল, বৈচিত্র্যময় চমৎকার একগুচ্ছ জারবেরা উপহার হিসেবে দিলে অথবা পেলে নিঃসন্দেহে যে কারও বিশেষ দিনটি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
কারনেশন
কারনেশন মূলত স্পেন, মোনাকো, শ্লোভেনিয়ার জাতীয় ফুল। নজরকাড়া সৌন্দর্য নিয়ে জন্মানো এ ফুলটি জীবনের মূল্যবান নারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে নারী দিবসের উপহাররূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ‘মা দিবস‘ উদযাপনের অগ্রদূত অ্যানা জারভিসের প্রিয় ফুল সাদা কারনেশন। তাই নারী দিবসের পাশাপাশি মায়েদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেও অন্যতম প্রতীকের স্বীকৃতি পেয়েছে এ ফুলটি। নারী দিবসে গোলাপের পাশাপাশি এই ফুলটি তোড়া হিসেবে উপহার দেওয়ারও বেশ প্রচলন রয়েছে। গ্রীক নাম, ‘ডায়ানথাস‘ থেকে উদ্ভূত কারনেশন ‘স্বর্গীয় ফুল‘ হিসেবেও পরিচিত। বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় ফুলটি বন্ধুত্ব ও সম্মানের প্রতীক। লাল রঙের কারনেশন মূলত বিশুদ্ধ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
প্রিয় পাঠক, বর্ণিত ফুলগুলো ছিল নারী অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে প্রতিবছর পালিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অন্যতম জনপ্রিয় উপহার। করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব — প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২১–এ আপনিও নিজ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নারীকে উপহার দিতে পারেন আপনার পছন্দের যেকোনো একটি ফুল।
আর দেরি কেন? উপহার বিনিময় হোক আজ, এখনই….
আদনান সহিদ লিখতে অণব ভালোবাসেন। শব্দেরা তার অকৃত্রিম বন্ধু, তার হয়েই কথা বলে। পাঠকেরা সে কথামালায় যোগ দিলে এক ‘আনন্দমেলা’ তৈরি হয় বলে তাঁর বিশ্বাস।