ম তা ম ত – সা হি ত্য
তানজিনা তাবাস্সুম নোভা
আমরা কেন বই পড়ি? — এ প্রশ্নের উত্তর এক একজনের কাছে এক এক রকম। কেউ হয়তো বাস্তব পৃথিবীর সমস্যাগুলো থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য বই পড়েন, কেউ হয়তো কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য বই পড়েন, আবার কারো কাছে বই পড়া হয়তো নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা, অর্থাৎ বই পড়া তাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক… পড়ুয়াদের পছন্দের এমন বিবরণ সবার কাছে পরিচিত।
কিন্তু, গত কয়েক বছর সময়কালে অমর একুশে বইমেলা চলাকালীন বা অন্য যেকোনো সময়ে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের তালিকার দিকে তাকালে পাঠকদের পছন্দ বদলে যাওয়ার একটি চিত্র আমাদের চোখে পড়ে। এই তালিকা আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে, অনেক পাঠকই এখন বই পড়াটাকে নিজেদের জীবন উন্নত করার একটি মাধ্যম হিসেবে নিয়েছেন। কারণ, ইদানীং নিয়মিতভাবেই এই তালিকার শীর্ষস্থান দখল করে থাকে আত্মোন্নয়নমূলক বা সেলফ-ইমপ্রুভমেন্ট ঘরানার বইগুলো। এসব বইয়ের এত জনপ্রিয়তার পেছনে কারণগুলো কী, এই জনপ্রিয়তা ভালো না খারাপ—এ প্রশ্নগুলোর উত্তরই এ লেখায় খোঁজার চেষ্টা করা হবে।
আত্মোন্নয়নমূলক বই বলতে এমন বইগুলোকে বোঝানো হয়ে থাকে যেগুলো পাঠকদের কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দেশনা দিয়ে থাকে। জীবনের অনিশ্চিত সময়ে একটু আশ্বাস আর পথনির্দেশ খোঁজার আশায় অনেকে এই বইগুলো হাতে তুলে নেন। এসব বইয়ের নানবিধ উপকারিতা রয়েছে। যেমন: এই বইগুলো পাঠকের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে, নিজের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে, নিজে নিজেই কোনো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করা শেখাতে পারে।
প্রথমে আমাদের জানা দরকার, এই বইগুলোর প্রতি পাঠকেরা কেন আকৃষ্ট হচ্ছেন।
বেস্টসেলার তালিকার দিকে তাকালে দেখা যায়, যেসব লেখকের বই বেস্টসেলার হচ্ছে, তাঁদের প্রায় সবাই আগে থেকেই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয়। তাঁদের নিজস্ব ভক্ত ও অনুসরণকারী গোষ্ঠী রয়েছে। এই লেখকদের বইয়ের একটা বিরাট অংশ এই ভক্তগোষ্ঠীই কিনে থাকে।
আরো একটি বড় কারণ হচ্ছে, আত্মোন্নয়নমূলক বইগুলো সাধারণত কোনো ক্ষেত্রে সফল মানুষেরাই লিখে থাকেন। কাজেই তরুণেরা সফল হওয়ার শর্টকাট পদ্ধতি জানার জন্য এসব বইগুলো পড়তে আগ্রহী হন।
পাশাপাশি, আমাদের সমাজের প্রচুর মানুষ এখনও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, যাদের কাছে গল্প বা কবিতার বই পড়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য বই পড়া বিষয়টির সাথেও তাদের অনেকেই পরিচিত নন। কিন্তু যখন কোনো বই তাদের প্রতিশ্রুতি দেয় সহজ উপায়ে ধনী হওয়া শেখানোর বা ৩০ দিনে কোনো নতুন ভাষা শেখানোর, সেসব বইয়ের পেছনে অর্থ ব্যয় করাকে তারা একটি প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বলে মনে করে থাকেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই বইগুলো বেস্টসেলার হলে সমস্যা কোথায়?
যেহেতু লেখকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুসরণ করা ভক্তগোষ্ঠীই তাঁদের বইয়ের প্রধান ক্রেতা, এক্ষেত্রে বইয়ের বিষয়বস্তু বা মানের তুলনায় এসব মাধ্যমে লেখকের জনপ্রিয়তাই সে বইয়ের বিক্রি বাড়ার পেছনে মূল প্রভাবক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কাজেই, এসব বইয়ের মান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলে থাকেন।
এসব বইয়ের মান যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ, বইগুলো পড়ে এসব বইয়ের পাঠকেরা কী শিখছেন সে প্রশ্নটিও স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। শুধু এসব বই-ই যারা পড়ছেন, তারা কি এই বইগুলোর হাত ধরে বাংলা বা বিশ্বসাহিত্যের রত্নগুলো খুঁজে নিতে পারছেন? যারা আগে থেকেই পাঠক, তারা হয়তো এমন বই পড়লেও সাথে সাথে সাহিত্যের মণিমানিক্যগুলো পড়া থামাবেন না, কিন্তু যারা নতুন পাঠক, যারা বই বলতে ‘সেলফ-ইমপ্রুভমেন্ট’-ই বোঝেন, তারা এসব বই পড়তে পড়তে মানিক বন্দোপাধ্যায় বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই কখনও খুঁজে নিতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করাটাও অযৌক্তিক নয়।
এছাড়াও, অনেকের মতে আত্মোন্নয়নমূলক বই পাঠকদের খুব একটা উপকারে আসে না। এই মতের পেছনে কারণও আছে।
প্রথমত, এই বইগুলো সাধারণত সবাইকে এক ছাঁচে ফেলে বিবেচনা করে। একজন লেখক একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে সফলতা পেয়েছেন বলে তাঁর সব পাঠক-ই সেই একই পদ্ধতিতে সফলতা পাবেন, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু, “আমি পেরেছি, সুতরাং আপনিও পারবেন” — জাতীয় কথায় পরিপূর্ণ এই বইগুলো পাঠককে তা-ই বিশ্বাস করাতে চায়।
দ্বিতীয়ত, এই বইগুলোতে অনেক বিষয়ের অতি সরলীকরণ করা হয়ে থাকে। “এ কাজটি করলে আপনি ঐ জিনিসটি অর্জন করতে পারবেন” — বইয়ে এমন কথা লেখা দেখে একজন পাঠক হয়তো কাজটি করলেন, কিন্তু বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী তার যা অর্জন করার কথা ছিল, তা তিনি অর্জন করতে পারলেন না। এরপর দু’টি ঘটনা ঘটতে পারে। নতুন কোনো কিছু করার চেষ্টা না করে তিনি হয়তো ঐ একই পদ্ধতিতেই বারবার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। অথবা, বাস্তবে কিছু অর্জন করা সহজ নয় এ সত্য বুঝতে পেরে তিনি হয়তো চেষ্টা করাই ছেড়ে দিতে পারেন।
তৃতীয়ত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে নিজে সাহায্য করাটা যথেষ্ট নয়। কোনো কোনো সময় আমাদের অন্য কারো সাহায্য দরকার হতেই পারে, এবং সেটা লজ্জার কিছু নয়। কিন্তু এসব বইয়ে এমনভাবে “আপনার জন্য আপনি নিজেই যথেষ্ট” এই আপ্তবাক্য প্রচারিত হয়ে থাকে যে, যেসব ক্ষেত্রে অন্য কারো সাহায্য প্রয়োজনীয়, তখনও অনেকে সাহায্য না খুঁজে নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করেন। এটি তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আত্মোন্নয়নমূলক বইগুলোর জনপ্রিয়তা ও জনপ্রিয়তার কারণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তরুণ লেখক মাহমুদুর রহমান এই জনপ্রিয়তার পেছনে নানা রকম কারণের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন,
“যেহেতু এসব ‘বইয়ের’ লেখকরা অন্য কোন সেক্টরে (ইউটিউব, ফেসবুক) একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছেন, তাদের বইগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অর্থাৎ, বইগুলো বা তাদের কন্টেন্ট না বরং লেখকদের ‘ফেসভ্যালু’র কারণে বই ‘বিক্রি’ হচ্ছে। এসব বইয়ের সব ‘ক্রেতা’ পাঠক না। এসব বই পাঠক সৃষ্টিও করে না। বইগুলো বা চলমান অবস্থা নিয়ে আমার মত হলো প্রকাশকদের ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করলে এটা ভালো। কেননা অনেক গম্ভীর সাহিত্যের বই থেকে রেভেন্যু আসে না। সেখানে এই বইগুলো প্রকাশকদের সেটা দিচ্ছে। পাশাপাশি প্রকাশক এবং কিছু কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এদের প্রমোট করে জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে। খারাপ যেটা হচ্ছে তা হলো সাহিত্য যদি বাদও দিই, আলোচনা বা গঠনমূলক জ্ঞান দান করে বা চিন্তা সৃষ্টি করে এমন বইয়ের বাজারকে আরও ছোট করে দিচ্ছে কেননা ক্রেতা তৈরি হলেও পাঠক তৈরি হচ্ছে না। এসব বইয়েরও দরকার আছে। যেমন ফ্রিল্যান্সিং, স্পোকেন ইংলিশ দরকারি, কিন্তু প্রকাশিত বইগুলো আসলেও কি সুলিখিত? এই বিষয়টা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস তথা মননশীল বইয়ের ক্ষেত্রেও প্রকাশক, বিক্রেতা (যারা এখন প্রচারকও বটে) সমান মনোযোগ দেওয়া উচিত। তাহলে আর সমস্যা থাকে না।”
কয়েকজন পাঠকের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে হলে তারা তাদের মতামত প্রকাশ করেন।
একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আত্মোন্নয়নমূলক বইয়ের এই জনপ্রিয়তাকে রথি ভালো চোখে দেখছেন না। কেননা তার মতে, এতে পাঠকের চিন্তার জগত সংকীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি একে ভালোভাবে দেখছেন। কারণ একজন শিক্ষার্থী শুধু জানার জন্য অনেক ধরনের বই পড়তে পারে। এসব বইয়ের কতটুকু সত্য বা কতটুকু সত্যিই কাজের তা নিয়েও তিনি সন্দেহ পোষণ করেন। তিনি মনে করেন এই বইগুলোর জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে বিজ্ঞাপন।
“দেখা যাচ্ছে এসব বইয়ের যারা লেখক তারাই কোনো না কোনোভাবে বইগুলোকে অনলাইন বা অফলাইনে প্রচার করে যাচ্ছে। আবার এসব বইয়ের লেখকদের বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার বা সেরকমই কেউ। যার কারণে জনপ্রিয়তার খাতিরে হলেও বইগুলোর বিক্রি বেশি,” রথি’র অভিমত।
দীপ্ত’র মতে, বর্তমান প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সাথে এর সম্পর্ক আছে। নব্বইয়ের দশকের শিশু-কিশোরদের মাঠে গিয়ে খেলার সুযোগ ছিল। আর একটি পাড়া সংস্কৃতির মাঝে বেড়ে ওঠার কারণে অনেকের সাথে মেশার, অনেকগুলো সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যাওয়ার, অনেক কিছু দেখার সুযোগ তাদের ছিল, এবং এ থেকে একটি উপলব্ধির জায়গাও তাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যেত। একজন কিশোর ঘরে কোনো ঝামেলার সম্মুখীন হলে তার আশ্রয়স্থল হতো তার বন্ধুরা বা পাড়ার অন্যরা। কিন্তু, এই ব্যাপারটি প্রতিনিয়তই পাল্টে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। দীপ্ত বলেন,
“শিক্ষাব্যবস্থার একটা বিষয় তো আছেই, সেই সাথে ঐ যে ঠেকতে ঠেকতে শেখা, একজনের সাথে অন্যজনের সম্পর্কের জায়গা—এসব কিছুতে একটা বিশাল খামতি থেকে যাচ্ছে। তো, এরকম একটা প্রজন্ম যখন বেড়ে উঠতে থাকবে, তারা আর আরণ্যক পড়বে না। তাদের কাছে বইয়ে পড়া জীবনানন্দের হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি এসব কোনো ম্যাটারই করবে না। কারণ তারা এটার কাছে যায় নি একেবারেই। এভাবে বড় হতে হতে তাদের নিজেদের অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি হয় কিন্তু সেসব শেয়ারিং এর কোনো জায়গা থাকে না, কারণ তার সমবয়সী যে বন্ধু সে ও তো একইভাবে বড় হয়ে উঠেছে, কাজেই সমস্যার সমাধান করা তার পক্ষেও সম্ভব নয়। তখন সে কোথায় যাবে? সে তখন সমাধান চায়, এ ধরনের সেলফ হেল্প বইয়ের সাথে পরিচিত হয়।”
সেলফ হেল্প-এর বই খারাপ বা পড়া যাবে না এমনটাও তিনি মনে করেন না। সেগুলো পড়তে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়, সেটাও তার মতে ভালো। কিন্তু, যেহেতু একজন কিশোর সাহিত্যের ব্যাপকতা সম্পর্কে জানে না বা সে পথ তাকে কেউ দেখিয়ে দেয় না, সেহেতু সে শুধু এ ধরনের বইয়ের পেছনেই সময় ব্যয় করতে থাকে। এর সূত্র ধরে সে যেসব বইয়ের কাছে যায় সেগুলোও খুব মধ্যম বা নিম্ন মানের হয়ে যায়। এবং এখানেই সমস্যাটা হয়।
সাদেকা অবশ্য এসব বইয়ের বেস্টসেলার হওয়াতে তেমন সমস্যা দেখছেন না। তার মতে, “কেউ যদি নিজের জীবনকে বা অবস্থানকে উন্নত করতে চায়, তাতে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সমস্যা তখনই হবে, যখন কেউ এই বইগুলোর বাইরে আর এগোবে না।” পাশাপাশি বইগুলোর মান বজায় রাখার ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
সবশেষে, আত্মোন্নয়নমূলক বইয়ের প্রতি উন্নাসিক ভাব দেখাতে হবে, বা এসব বই পড়া যাবে না, এমন নয়। তবে, বই কেনা বা পড়ার গণ্ডিটা শুধু এসব বইয়েই সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়াটা আমাদের সাহিত্যের জন্য বা পাঠকদের জন্য ভালো কিছু হবে না। সুতরাং, পাঠকদের বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। চটকদার নাম, বিজ্ঞাপন আর লেখকের জনপ্রিয়তায় না ভুলে বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে সে বইয়ের লেখক আসলেই কতটুকু ধারণা রাখেন তা নিশ্চিত হয়েই এ ধরনের বইগুলো পড়া উচিত। লেখকদেরও কোনো বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করার পরই সে বিষয় নিয়ে বই লিখতে যাওয়া উচিত। এবং, প্রকাশকদেরও যে বইগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে শুধু সেগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে সব ধরনের বইকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা এবং বইয়ের প্রচারণা চালানো উচিত।
লেখক টিডিএ এডিটোরিয়াল টিমের একজন সদস্য।