স ম্পা দ কী য়
কে কী বলল, কেন বলল, কী ভেবে বলল — তাতে কিছুই যায় আসে না। যৌন ও লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষের অধিকার সংক্রান্ত কোনো কথা সোশাল মিডিয়ার কোথাও দেখলেই সেখানে কিছু না ভেবেই এদেশের একদল মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত থাকেন। তাদের অনুভূতি রক্ষার স্বার্থে অপরপক্ষের মানুষটিকে গালিগালাজ কিংবা জীবনের হুমকি কোনোটি দিতেই তারা দ্বিধাবোধ করেন না।
প্রায়ই দেখা যায়, কেউ লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষদের অধিকারের পক্ষে কথা বললেই কিছু মানুষ কমেন্ট সেকশনে এসে মনে করিয়ে দেন, এই “জঘন্য কার্যকলাপ” আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী বেআইনি। তারা বোধহয় ভুলে যান যে মনে করিয়ে দেওয়ার তেমন প্রয়োজন নেই, কুইয়ার মানুষেরা প্রতিনিয়তই জানেন যে তাদের যৌন ও লিঙ্গ পরিচয় এই রাষ্ট্র এখনো নিষিদ্ধ করে রেখেছে। দুঃখজনক, তবু সত্যি, ২০২১ সালে এসেও আমাদেরকে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত পরিচয়ের আইনত বৈধতা নিয়ে তর্ক ও লড়াই করতে হয়। এই দুঃখ, এই ট্রমা নিশ্চিতভাবেই তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
এই স্বাধীনতা আদায়ের লড়াইয়ে এখনো বহু পথ এদেশের মানুষের পাড়ি দেওয়া বাকি। যতদিন না সেটা হচ্ছে, আমরা ধরে নিতে পারি ততদিন কুইয়ার মানুষ এবং তাদের অধিকারের লড়াইয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা সোশাল অ্যাক্টিভিস্টদের থামিয়ে রাখার তর্জন-গর্জনের অস্ত্র হিসেবে সেকশন ৩৭৭ নামের এই আইনকে ব্যবহার করা হবে। গত কয়েক বছরে এদেশের দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকা ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া ক্ষমতাগুলোর সাথে রাষ্ট্রের আপোষ দেখলেই বোঝা যায়, সেকশন ৩৭৭ আরো বহু বছর এদেশে টিকে থাকতে বাধ্য। আর এই আপোষ আমাদেরকে এটাও বলে যে, এই রাষ্ট্র এদেশের বৈচিত্র্যময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের ব্যাপারে শুধু ভুলেই গিয়েই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাদের উপর প্রতিনিয়ত চলতে থাকা নিপীড়নে সরাসরি অবদানও রেখেছে।
ভুলে গেলে চলবে না, এদেশের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর অবস্থানের প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় যদি আমরা লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষের লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন নাও তুলি, তাও এই মানুষগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের অনেকগুলো দায়িত্ব আছে। আমাদের দায়িত্ব প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রকে সেই দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেওয়া। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কুইয়ার মানুষেরা যদি আইনের চোখে অপরাধীও হয়ে থাকেন, তারপরেও তাদের জীবনের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। তাদের “অপরাধ”-এর বিচার করার ক্ষমতা স্রেফ আইনের-ই। এই আইন যাতে এদেশের গোঁড়া জনগোষ্ঠী নিজেদের হাতে তুলে না নেন, সেই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এমনকি, “অপরাধী” হলেও এই মানুষগুলোর ট্রায়াল পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রের।
গত কয়েক বছরের বিবেচনায় আমরা ধরে নিতে পারি, এই নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র শুধু ব্যর্থই নয়, বরং রীতিমতো অপারগ। ২০১২ সালের পর থেকে এদেশে চলতে থাকা ব্লগার হত্যার কোনোটিরই বিচার এখনো আলোর মুখ দেখে নি। ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া কুইয়ার অ্যাক্টিভিস্ট মাহবুব তনয় এবং জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডের বিচারও অসম্ভব মন্থর, গত দু’বছর ধরে যা একেবারেই থেমে আছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি এদেশে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকা গোঁড়ামিকে সাহস দেয়, পেছন থেকে নীরব সম্মতি দেওয়ার ভূমিকা পালন করে।
এবং এখন সেটাই হচ্ছে। রাষ্ট্রের নীরব সম্মতি এখন এই গোঁড়ামিকে ডালাপালা মেলতে সরাসরি সাহায্য করছে। তাই প্রতিনিয়ত যখন কমেন্ট সেকশনে ও ইনবক্সে হত্যার হুমকি জমা পড়ে, তখন লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষেরা জানেন, এই হুমকির কোনো প্রতিকার পাওয়ার উপায় তাদের কাছে নেই। যারা হুমকি দেন, তারাও জানেন, বিচারবিহীন এই অবকাঠামোয় তাদের বিচার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমাদের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট অন্যসব ক্ষেত্রে প্রচণ্ড সক্রিয় হলেও, এই হুমকিকে তারা বোধহয় টেরোরিজম বলে গণনাতেই ধরেন না। তাই এই হুমকিওয়ালারা অনায়াসে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যান।
রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিলে চলবে না। প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিতে হবে, এদেশের যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর উপর যেই মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ন চলে, সেই নিপীড়ন এবং নিপীড়নের হুমকি থেকে এই জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার দায়িত্বও তাদের। যারা হুমকি দেন, তাদের বিচারের মু্খোমুখি করার দায়িত্বের ব্যাপারেও আমাদের রাষ্ট্রকে সচেতন করতে হবে।
সেকশন ৩৭৭ থাকুক বা না থাকুক, সব মানুষের জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা দায়িত্ব রাষ্ট্রের।