স ম্পা দ কী য়
পরীমণির এই ঘটনায় আমরা অনেক কথা বলেছি। এখন মিডিয়াতে নানা ধরনের কথাবার্তা আসছে। সম্প্রতি একটি ভিডিও রিলিজের পর থেকে ইতঃপূর্বেই পরীমণির বিপক্ষে থাকা জনমত আরো ফেঁপে উঠেছে। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পরীমণি(?) ব্যবসায়ী নাসিরের সাথে ক্লাবে বসে চিৎকার করছেন। কিছু জায়গায়, এমনকি ঢাকা অ্যাপোলগের কন্টেন্টের নিচেও আমাদেরকে মেনশন করা হচ্ছে। মেনশনগুলোর মূল বার্তা এমন: “এখন তোরা কথা বলিস না কেন?”
পরীমণিকে সমর্থন জানানো কি তবে ভুল ছিল?
না, একদমই না। এমনকি পরীমণি যদি মিথ্যা বলে থাকেন, তবুও না। যারা বলছেন ভুল ছিল, তারা বোধহয় এই সমর্থনের অর্থটাই ধরতে পারেন নি।
পরীমণিকে সমর্থন জানানো মানে এই নয় যে আমরা চাই নাসিরকে ধরেই চৌদ্দ বছরের জেল দিয়ে দেওয়া হোক। পরীমণিকে সমর্থন দেওয়া মানে এ-ও নয় যে আমরা ধরেই নিচ্ছি কেবল পরীমণি-ই সত্য কথা বলছেন। পরীমণিকে সমর্থন দেওয়ার মানে এই যে, আমরা চাই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পরীমণির আনা অভিযোগের ভিত্তিতে তার যে আইনি ও রাষ্ট্রীয় অধিকারগুলো আছে, সেই প্রাপ্য অধিকারগুলো তাকে দেওয়া হোক।
পরীমণি মিথ্যা বলতে পারেন, বানিয়ে বলতে পারেন। যদি বানিয়েও বলে থাকেন, তবুও তার কিছু আইনি অধিকার আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রমাণিত হচ্ছে যে তিনি মিথ্যা বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আছে। তিনি অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে যাবেন, তার অভিযোগ গ্রহণ করা হবে, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করা হবে এবং তদন্তের ভিত্তিতে বিচার করা হবে। সেই বিচারে যতক্ষণ পর্যন্ত পরীমণি কিংবা অন্য যে কেউ মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত না হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তার এই অধিকার আছে।
এছাড়াও পরীমণির কিছু সামাজিক অধিকারও আছে।
তার অভিযোগের পরপরই যে তাকে ঘিরে তুমুল ভিক্টিম ব্লেমিং হয়েছে, এবং ধরেই নেওয়া হয়েছে যে তিনি রাত ১২টায় ক্লাবে গিয়েছিলেন বলেই তিনি মাগী, এই ধরনের সামাজিক নিপীড়ন থেকে তার পরিত্রাণ পাওয়ার অধিকার আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণিত না হচ্ছে যে তিনি আসলেই সেখানে দেহব্যবসা করতে গিয়েছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক যেকোনো জায়গায় এরকম অভিযোগ তোলাও এক ধরনের অপরাধ, আর এই অপরাধের বিচার পাওয়ারও অধিকার পরীমণির আছে।
আমাদের সমর্থন ঠিক এই অধিকারগুলোর পক্ষেই কথা বলা। পরীমণির ঘটনায় আমাদের প্রতিবাদ আসলে এই বিচারহীনতার রাষ্ট্রে মানুষের ক্ষয়িষ্ণু অধিকার পাওয়ার প্রতিবাদ। আমরা নাসিরকে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই দোষী বলে ঘোষণা করতে কথা বলি নি। আমরা শুধুই পরীমণির সুষ্ঠু তদন্ত পাওয়ার অধিকারের পক্ষে কথা বলেছি। পরীমণির অভিযোগ কেন পুলিশ নেয় নি, সেই প্রশ্ন তুলতে চেয়েছি। সুষ্ঠু তদন্তের পর যদি প্রমাণিত হয় পরীমণিই আসলে দোষী, তাহলে তার বিচার চাইবার কাজটাও আমরা করতে রাজি।
তবে সবার আগে আমাদের যেটা নিয়ে কথা বলতে হবে, এবং আমরা যেটা নিয়ে কথা বলতে চাই, সেটা এই অধিকারহীনতার অবস্থা নিয়ে, এই বিচারহীনতার অবস্থা নিয়ে। আমরা কথা বলতে চাই এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে।
তবে, পরীমণি কি আসলেই মিথ্যা বলছেন?
একটু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, পরীমণি সংবাদ সম্মেলনে এসে কান্নাকাটি করা পর্যন্ত, এবং রীতিমতো সরকারপ্রধানের কাছে বিচার ভিক্ষা চাওয়া পর্যন্ত পুলিশ তার অভিযোগ নিতে রাজি হয় নি। পরীমণি যদি মিথ্যাই বলে থাকেন, আর নাসির যদি একেবারেই নির্দোষ হয়ে থাকেন, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই প্রাথমিক পক্ষপাতিত্বের কারণ কী?
আরেকটি বিষয়ও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। পরীমণি যদি ব্যক্তিগত রেষারেষির জের ধরে একজনের বিপক্ষে মিথ্যা ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ করার মতোই ধূর্ত ব্যক্তি হন, তবে তিনি কেন বুঝবেন না যে, আমাদের মতো দেশে তার মতো একজন মিডিয়াকর্মী নারী ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ তোলা মানেই পুরো সমাজকে তার বিপক্ষে দাঁড়া করিয়ে দেওয়া? যেই পরিমাণ আঙুল তার দিকে তোলা হয়েছে, নিজে যেচে তিনি এই বিরাট ঝক্কির মধ্যে দিয়ে কেন যেতে চাইবেন, সেই ব্যাপারটা বোধগম্য নয়।
পরীমণি যেন তেন কারো বিপক্ষে অভিযোগ তুলেন নি। তিনি অভিযোগ তুলেছেন অত্যন্ত ক্ষমতাবান একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে। নাসিরের মতো ব্যবসায়ী, উত্তরা ক্লাবের একসময়ের প্রেসিডেন্ট যে ক্ষমতার বলয়ের আশেপাশেই থাকেন, সেটা না বুঝতে চাওয়া এক প্রকার নির্বুদ্ধিতার পর্যায়ে দাঁড়ায়। পরীমণি কেন যেচে এরকম ক্ষমতাবান ব্যক্তির বিরুদ্ধে যেতে চাইবেন, সেটাও এখনো বোধগম্য নয়।
মিডিয়ার অদ্ভুত অবস্থান নিয়েও আমাদের কথা বলা দরকার।
ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, জাগো মিডিয়া, ঢাকাপোস্টের মতো কিছু মিডিয়ার অবস্থানগুলো অদ্ভুত। প্রথম সংবাদ সম্মেলনের পরের দিন ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করল: তাদের হাতে ভিডিও এসেছে, যেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পরীমণিকে অচেতন অবস্থায় ক্লাব থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অচেতন পরীমণিকে বের করে নিয়ে যাওয়ার অবস্থায় নাসির এবং অমি (যে পরীমণিকে ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিল), সেই অমি হাত-পা ঝাঁকিয়ে পরীমণি এবং তার বন্ধুকে শাসাচ্ছেন, যেন হুমকি দিচ্ছেন।
কিছুদিন পরেই আবার অবস্থান পাল্টে ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের নতুন এক্সক্লুসিভ, নতুন ভিডিও: যেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে উল্টো পরীমণি-ই নাসিরকে ক্লাবের ভেতরে শাসাচ্ছেন, হুমকি দিচ্ছেন, বেরিয়ে যেতে বলছেন। সমস্যা নতুন ভিডিও বের হওয়া নিয়ে নয়। সমস্যা সেই রিপোর্টের বৈধতা নিয়ে, সত্যতার প্রশ্ন নিয়ে।
ভিডিওটার কোনোখানেই পরীমণির মুখ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি তার শরীরও দেখা যাচ্ছে না। আবছা সেই ভিডিওতে যে সেটা নিঃসন্দেহে পরীমণি-ই, সেই ভেরিফিকেশন নিয়ে কীভাবে ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন নিশ্চিত হলো, সেই প্রশ্ন থেকে যায়।
জানামতে, মিডিয়া যেনতেন কিছু চাইলেই প্রকাশ করতে পারে না। এমনকি, সত্য হলেও না। মিডিয়াকে কিছু প্রকাশ করতে হলে সেই ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের প্রমাণ প্রয়োজন হয়। আলোচিত ভিডিওতে মানুষটি যদি নিশ্চিতভাবে পরীমণি-ই হন, তবুও নিশ্চয়তার যাচাই এথিকস্ অনুযায়ী ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন করতে বাধ্য। সেই নিশ্চয়তা ভিডিওটার কোনোখানেই পাওয়া যায় নি। এমনকি সত্যিই পরীমণি হলেও উক্ত ভিডিও ন্যাশনাল টেলিভিশনে প্রকাশ করে দেওয়া মিডিয়া এথিকস্ এর বরখেলাপ।
এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনায় বেক্সিমকো গ্রুপের মিডিয়া হাউজের কথা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ আমরা দেখি না; বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে তারা তাদের উদ্দেশ্য প্রমাণ করতে এতটাই মরিয়া, যে সাংবাদিকতার এথিকস্ নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ-ই নেই।
সবমিলিয়ে, মিডিয়া, গণমানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যত-ই বলুক, যাই বলুক, আমরা উল্টো পরীমণিকে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রশ্ন দেখতে পাই; যেই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর এখনো এই তিন পক্ষের কেউই দিতে পারে নি। যারা এরপরেও কেবল সেই ভিডিও দেখেই লাফাচ্ছেন, তারা কেন লাফাচ্ছেন, সেই প্রশ্নের উত্তর-ও পাওয়া হয় নি।
পরীমণির এই ঘটনা কিংবা যেকোনো যৌন হয়রানির ঘটনাই হোক না কেন, অভিযোগ যিনি করেছেন তাকেই আগে সমর্থন দেওয়াটাই কি যৌক্তিক নয়?
আমরা ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির ভিক্টিমদের প্রাথমিকভাবে সমর্থন যোগানোই যৌক্তিক মনে করি।কারণ এদেশের সার্বিক অবস্থা, এদেশের ধর্ষণ সংস্কৃতি এবং এদেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতি। একজন নারী যখনই, যেই অবস্থাতেই এই দেশে একটি অভিযোগ নিয়ে আসে, তখনই তাকে যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, সে পরিস্থিতির কারণেই এদেশের নারীরা তাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না। তাই আগে, এই প্রেক্ষাপটের বিবেচনায়, এমনকি একজন অপবাদকারী নারীকেও সাহস যোগানো আমাদের প্রাথমিক কাজ। আর দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরে তার মিথ্যাবাদিতার বিচার চাওয়া আমাদের দ্বিতীয় কাজ।
যারা এত প্রেক্ষাপট, যুক্তি ও প্রশ্নের পাহাড় ডিঙিয়ে প্রথম সুযোগেই পরীমণিকে দোষারোপ করছেন, তাদের প্রশ্ন করতে চাই:
“নিরপেক্ষতা”র আড়ালে আপনার ভেতরের মিসোজিনিটাই প্রকাশ পাচ্ছে না তো?