আমরা যা ভাবি, যৌন শিক্ষা কি তাই?

Editor
4 Min Read

যৌন শিক্ষা – বাংলাদেশ


মূল লেখক: মায়িশা তাসনিম নওমি

বঙ্গানুবাদক: জুয়াইরিয়া হক মাহী 


সমন্বিত যৌন শিক্ষা বা কম্প্রিহেনসিভ সেক্স এডুকেশন (যা মূলত যৌনশিক্ষা হিসেবেই পরিচিত) হচ্ছে যৌনতার জ্ঞানীয়, আবেগীয়, শারীরিক ও সামাজিক দিক সম্পর্কে একটি শিখন পদ্ধতি। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। আমাদের দেশের বিরাট রক্ষণশীল জনগোষ্ঠী স্কুলে যৌনশিক্ষা বাস্তবায়নের বিরোধী, আর এই বিরূপ মনোভাবের কারণই হলো সমাজে যৌনশিক্ষা কী তা নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা। এমন কিছু ভুল ধারণা এই লেখায় উপস্থাপন করা হলো।

ভুল: যৌনশিক্ষা কিশোরসমাজকে যৌনক্রিয়ায় উৎসাহিত করে

সঠিক তথ্য: বিভিন্ন অনুসন্ধান প্রমাণ করে যে, যৌনশিক্ষা বিষয়ক প্রোগ্রামগুলো যৌনক্রিয়া হতে বিরত থাকা এবং গর্ভনিরোধ (যৌন মিলনের সময় গর্ভাবস্থা রোধ করার কৃত্রিম পদ্ধতি) উভয় বিষয় সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষা দেয়। যৌনক্রিয়া পরিহার এবং গর্ভনিরোধ মানুষকে তাদের যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও সচেতন এবং দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী যৌনশিক্ষা বিষয়ক প্রোগ্রাম নিম্নোক্ত বিষয়ে সহায়তা করে।

যৌন প্রবৃত্তি বিলম্বিত করা

কিশোরী গর্ভাবস্থা হ্রাসকরণ

যৌনবাহিত রোগ হ্রাসকরণ

যৌন নির্যাতন কমিয়ে আনা

হোমোফোবিয়া ও ট্রান্সফোবিয়ার মাত্রা কমানো

ভুল: যৌনশিক্ষা শিশুকিশোরদের শেখায় কীভাবে যৌনতায় লিপ্ত হতে হয়

সঠিক তথ্য: কোনো যৌনশিক্ষা কর্মসূচি-ই কীভাবে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতে হয় সে সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে না। বরং এই কর্মসূচিগুলো শিশুদের বয়স ও বিকাশ অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করে থাকে।

যৌনশিক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও দক্ষতা কিশোরদের যৌন প্রবৃত্তি বিলম্বিত করতে এবং যৌনসক্রিয় হওয়ার পর নিজেদের সুরক্ষিত করতে সহায়তা করে। বয়ঃসন্ধি, বিকাশ, লিঙ্গ, আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক পালন, আপত্তিকর ব্যবহার শনাক্তকরণ ইত্যাদি বিষয় যা ব্যক্তিমাত্র জানার অধিকার রাখে, সেসব-ই বিস্তৃত যৌনশিক্ষা মানুষকে অবহিত করে।

ভুল: যৌনশিক্ষা কিশোর ও তরুণদের মানস বিকৃত করবে

সঠিক তথ্য: শিশুদের মনে উদ্ভূত নানান প্রশ্নের কেবল বয়স উপযোগী তথ্যটুকুই যৌনশিক্ষা প্রদান করে। পাঁচ বছর বয়সী একজন শিশু হয়তো ভাবতে পারে, “অমুকের লিঙ্গ থাকলেও আমার নেই কেন?”

স্কুলে শেখানো বিস্তৃত যৌনশিক্ষার একটি পাঠ্যক্রম সহজেই এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম, যেহেতু যৌনশিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শিশুদেরকে তাদের দেহের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলা। অল্প বয়সে একজন শিশু সম্ভাব্য আপত্তিজনক ব্যবহার শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট সচেতন না-ও হতে পারে। বিস্তৃত যৌনশিক্ষা কেবল নিপীড়ন ও মন্দ স্পর্শ সম্পর্কেই সচেতনতা তৈরি করে না, বাচ্চারা কীভাবে নিজেদের সম্ভাব্য নিপীড়কদের হাত থেকে রক্ষা করবে সেই শিক্ষা-ও দেয়।

ভুল: যৌনশিক্ষা সম্পূর্ণরূপে আমাদের সংস্কৃতি-বিরোধী এবং তা নীতি-নৈতিকতার অবজ্ঞা করে

সঠিক তথ্য: সংস্কৃতি সর্বদা পরিবর্তনশীল ও বিবর্তনশীল। ২০ বছর আগে যা আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল, তা হয়তো ৫০ বছর আগে উপস্থিত ছিল না অথবা বর্তমানে বিদ্যমান নেই; উদাহরণস্বরূপ, সতীদাহ প্রথা বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে।

যৌনশিক্ষা কার্যক্রম প্রকৃতপক্ষে মর্যাদা, গ্রহণযোগ্যতা, সহনশীলতা, সমতা, সহানুভূতি ও পারস্পরিকতার মতো গুণাবলির সমর্থন করে। এই গুণাবলিগুলো যুবকদেরকে তাদের স্বতন্ত্র মূল্যবোধগুলোর পাশাপাশি পরিবার ও সম্প্রদায়ের মাঝে বিদ্যমান মূল্যবোধ বিশ্লেষণ ও সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ করে দেয়। অর্থাৎ যৌনশিক্ষা কার্যক্রমে বরং নীতিশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা অন্তর্ভুক্ত।

ভুল: পিতা-মাতা এবং শিক্ষকদের শিশু-কিশোরদের সাথে যৌনশিক্ষা বিষয়ক কথা বলার প্রয়োজন নেই। বড় হলে সবাই যেভাবে বুঝে যায়, ঠিক সেভাবে তারাও বুঝে যাবে।

সঠিক তথ্য: শিশুকিশোররা বড় হতে হতে ঠিকই যৌনতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে বুঝতে শিখে, তবে তা প্রায়শই তাদের মতোই কমবয়সী বন্ধুদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে অথবা ইন্টারনেট অনুসন্ধান করে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে, যা মোটেই নির্ভর‍যোগ্য নয়। ইন্টারনেটে যৌনতা নিয়ে অনুসন্ধান করলে পর্নোগ্রাফিক কন্টেন্টের সংস্পর্শে আসার অধিক সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের কন্টেন্ট থেকে যৌনশিক্ষা গ্রহণ করলে যৌনতা ও মানবদেহ সম্পর্কে অবাস্তব ও ভ্রান্ত ধারণা বৃদ্ধি পায়। তাই উত্তম হবে যদি শিশুকিশোররা এই বিষয়গুলো পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের কাছ থেকে নৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর পদ্ধতিতে শিখতে পারে।

Share this Article
Leave a comment