আদনান সহিদ
অফিসে যাওয়ার আগে ব্রেকফাস্টে বসেছি। ছেলেকে ব্রেডের উপর nocilla মাখিয়ে দিলাম। ছেলেটা অন্যদিনের মত গপগপ করে খেল না।
সে বলল, “কেমন একটা গন্ধ লাগছে, বাবা!”
আমি বললাম, “তোর যত শয়তানি! না খাওয়ার যুক্তি! তাড়াতাড়ি খা।”
ছেলে খাবেই না।
“দেখো না তুমি একটু খেয়ে। দেখো, কেমন একটা গন্ধ, খাওয়া যায়?”
অগত্যা nocilla মাখানো ব্রেডটা হাতে নিলাম। নাকে শুঁকে দেখি, আশ্চর্য! কেমন একটা অদ্ভুত পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে।
ছেলের মা’কে ডাকতে গেলাম। সে সাতসকালে মেয়ের টিফিন বক্স রেডি করছে আর মেয়ের সাথে টিফিন নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে।
“প্রত্যেকদিন ম্যাকারনি টিফিন নিবি বলে আমার মাথা খেয়ে মরিস। আজকে ভোরে উঠে অসুস্থ অবস্থায় ম্যাকারনিটা করে দিলাম। এখন বলছিস-নিবি না? কী পেয়েছিস? নিবি না কেন?”
“গন্ধ লাগছে, মা! রান্না করতে গিয়ে বেশি পুড়িয়ে ফেলেছ। আমার এত প্রিয় ম্যাকারনি! এমন বাজে গন্ধ! মনে হচ্ছে আর কোনোদিন খেতে পারব না এটা!”
বুঝতে পারলাম — সামথিং ইজ রং! এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে বললাম, “দেখি, কী হয়েছে? কিসের গন্ধ পাচ্ছিস?”
টিফিন বক্সে রাখা ম্যাকারনিটা নাকের কাছে আনলাম। শুঁকতে গিয়েই দ্বিতীয়বারের মতো চমকে উঠলাম! কেমন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ! মানুষের চামড়া পোড়া টাইপ। রান্না করতে গিয়ে পোড়ানো গন্ধ এটা হতেই পারে না!
দৌঁড়ে কিচেনে গিয়ে বিনের মুখটা খুলে Colson Macaroni এর প্যাকেটটা তুলে নিলাম হাতে।
‘এক্সপায়ারি ডেট’ তো ঠিকই আছে এটার। প্যাকেটের গায়ে পরিষ্কার লেখা: জানুয়ারি ২০২২।
ঘড়ি দেখলাম। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দুটোর স্কুলেরও দেরি হচ্ছে।
ওদের মাকে তাড়াতাড়ি বললাম, “আচ্ছা, চিন্তার কিছু নেই। ওদেরকে বাইরে থেকে আজকে টিফিন কিনে দিচ্ছি। এই, তোরা দুজন এখনই বের হ, কুইক।”
বাইরে এসে বাসার নিচের স্ন্যাকসের দোকান টেস্টি ট্রিট থেকে কিছু স্ন্যাকস কিনে ছেলে-মেয়ে দুটোকে আলাদা প্যাকেট করে দিয়ে দিলাম। ছেলেটা একটা জুসের বায়না ধরলে এক প্যাকেট সেজান জুসও কিনে দিলাম। ছেলেটার আর তর সইল না। রিকশায় যেতে যেতেই জুসটা খুলে খাওয়া শুরু করল। উঁচু-নিচু রাস্তায় রিক্সার ধাক্কায় জুসের গা বেয়ে সব জুস ছেলেটার স্কুলের শার্টে পড়তে লাগল। চমকে উঠলাম। জুস ছিটকে পড়ে পুরো শার্টটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে!
দ্রুত ছেলের হাত থেকে জুসের প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে রাস্তার উপর ছুঁড়ে ফেললাম। আমার এই অদ্ভুত আচরণে ছেলে, মেয়ে এবং রিক্সাওয়ালা তিনজনই অবাক হয়ে গেল।
“কী হলো, বাবা? জুসটা ফেলে দিলে কেন? আমার তো খাওয়াই শেষ হয় নি।” ছেলে অবাক।
“চোখের মাথা খেয়েছিস? জুসের প্যাকেট থেকে রক্ত পড়ছে তো! তোর শার্টটা রক্তে লাল হয়ে গেছে, দেখছিস না? বড় হচ্ছিস, কোনো দিকে খেয়াল নেই। সারাদিন খাওয়া আর খাওয়া!” প্রচন্ড বিরক্ত আমি।
মেয়েটা বোকা বনে গিয়ে বলল, “বাবা, রক্ত কোথায় দেখলে? ওর শার্টে তো হলুদ জুসের দাগ!”
আবার চমকে উঠলাম। খেয়াল করে দেখলাম, তাই তো। ছেলের শার্টের বাম পকেটের নিচে জুসের স্পষ্ট হলদেটে দাগ! তাহলে এতক্ষণ রক্ত দেখলাম কেন? কী হলো আমার! মাথা কি পুরাই খারাপ হয়ে গেল!
তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে ছেলেকে বললাম, ”আচ্ছা বাবা, মন খারাপ করিস না। তোকে বিকালে আবার জুস কিনে দেব।”
ছেলে মুখ ফুলিয়ে আছে। মুখ নিচু করে আস্তে আস্তে বলল, “আমি আর কোনো দিন জুস খাব না, সেজান জুস-ও না।”
কোনোরকমে বেগতিক অবস্থাটা সামলে নিলাম। ওদেরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসের গেটে পৌঁছালাম। বনবন করে মাথা ঘুরছে, গা ঘামছে। প্রেশার বাড়ল কি না বুঝতে পারছি না। রিসিপশনের টিভিতে খবর চলছে। পড়ি-মরি করে সোফায় গা’টা এলিয়ে দিলাম। চোখ বন্ধ করে টিভির খবরে কান পাতলাম:
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় কাসেম ফুড লিমিটেডের ছয়তলা কারখানা ভবনে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে শুক্রবার দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর ভবনের চতুর্থ তলা থেকে নারী ও শিশু সহ মোট ৪৯ শ্রমিকের দগ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার আগুন লাগার পর ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২।
আমি রিসিপশনের রুমটায় আবার মানুষের চামড়া পোড়া গন্ধটা পেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
আদনান সহিদ লিখতে অণব ভালোবাসেন। শব্দেরা তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু, তাঁর হয়েই কথা বলে। পাঠকেরা সে কথামালায় যোগ দিলে এক ‘আনন্দমেলা’ তৈরি হয় বলে তাঁর বিশ্বাস।