জংশন: সঙ্গীত, শিল্প, উদ্যোগ সহ নানা কিছুর সমন্বয়ে যে আন্দোলন

Editor
7 Min Read

ফিচার – সংগঠন


২০১৯ সালে জংশন প্রতিষ্ঠিত হয়। শিল্পীদের এই সম্মিলিত কেন্দ্রটি দেশের উদীয়মান একক ও দলগত শিল্পীদের উন্নতিতে নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। সঙ্গীত, দৃশ্যশিল্প, চলচ্চিত্র, কমেডি ইত্যাদি ক্ষেত্রে জড়িত শিল্পীদের সহায়তা করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নতির জন্য তাদের ৭টি ভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে।

তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নাম ‘অ্যাকুস্টিকা’। এই প্ল্যাটফর্মটি স্থানীয় তরুণ সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য লাইভ সেশনের আয়োজন, তাদের অ্যালবাম ও পণ্য বিক্রি করে তাদের প্রচারে সাহায্য করে। তাদের অন্যান্য আয়োজনের মধ্যে আছে দৃশ্যশিল্পের জন্য ‘নন্দন’, পরিবেশবান্ধব ব্যবসা ও পণ্যের প্রচারের জন্য ‘গ্রিনভেঞ্চারস’, চলচ্চিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য ‘সিন-এ-নাইট’, স্ট্যান্ড-আপ কমেডির জন্য ‘ফান-এ-খান’, সাহিত্যিক উদ্যোগের জন্য ‘শব্দ-কল্প-বৃক্ষ’ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, আর তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রদর্শনীর জন্য ‘উদ্যোগ’।

প্রতিটি উদ্যোগের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য সরাসরি দর্শকের উপস্থিতিতে করা অনুষ্ঠানের ওপর জংশন অনেক বেশি নির্ভর করত। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী তাদের সব কার্যক্রম এখন অনলাইনভিত্তিক করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে তাদের বিশ্বাস, এ কারণে তাদের বৃদ্ধি স্বল্প সময়ের জন্য কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  

জংশনের প্রতিষ্ঠাতা পূজন বিপ্রতীপ বলেন,

“অনলাইনে অনুষ্ঠান করাটা আমাদের মতো আয়োজক আর শিল্পীদের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। দর্শকদের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাওয়া, তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে পারা আমাদের দক্ষতা ও পারফরম্যান্সের মান বাড়াতে সাহায্য করে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ অনলাইন অনুষ্ঠানের সাথে তেমন পরিচিত নন, তাই আমরা তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট সাড়া পাই না। আমাদের ওপর এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ছে।” 

যাত্রা শুরুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, স্টুডিও জেন, স্টুডিও ৬/৬ সহ বিভিন্ন জায়গায় জংশন মোট ৮টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সম্প্রতি, ইএমকে সেন্টারের সাথে মিলিতভাবে ‘অ্যাকুস্টিকা’-র আওতায় তারা দু’টি অনুষ্ঠান করেছে। অবান্তর এবং ব্লু পেরিস্কোপের মতো ব্যান্ডগুলো এই অনুষ্ঠানগুলোতে সঙ্গীত পরিবেশন করে। এই অনুষ্ঠানগুলো ফেসবুক ও ইউটিউব লাইভের মাধ্যমে সরাসরি প্রচারিত হয়। খুব দ্রুতই এরকম  আরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।          

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানান,

“যতদিন পর্যন্ত লকডাউন শেষ হচ্ছে না, আমরা অনলাইন অনুষ্ঠানের ওপরই গুরুত্ব দেব। ব্যাপক মাত্রায় টিকাদান হয়ে গেলে আমরা অফলাইন অনুষ্ঠানের দিকে যাব। এর মধ্যে অনলাইন অনুষ্ঠান পুরোদমে চলতে থাকবে, যদিও তা আমাদের জন্য খুব কষ্টকর হবে।”   

বর্তমান যুগে সঙ্গীতশিল্পীরা এবং স্বাধীন শিল্পীরা যেসব বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হন, সেগুলোর কথাও জংশন স্বীকার করে। তারা বিশ্বাস করে, ক্রমশ কমতে থাকা সরাসরি অনুষ্ঠানের সংখ্যা এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও শিল্পীবান্ধব মাধ্যমের স্বল্পতার কারণে শিল্পীদের পক্ষে এখন চেষ্টা করা তো দূরের কথা, টিকে থাকাই কঠিন।   

“এই ব্যাপারগুলো উল্টে দেওয়া, ব্যাপক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিল্পী ও দর্শকদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা, এবং নানা ধরনের উদ্ভাবন নিয়ে আসার মতো ব্যাপারগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”

এছাড়াও, উদীয়মান শিল্পী, প্রতিষ্ঠান বা ব্যাবসাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের অর্গানিক রিচ বাড়ানো নিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হয়। অ্যালগরিদমের সমর্থন না পাওয়ায় অনেক প্রকল্পই সাধারণ মানুষের কাছে 

পরিচিতি পায় না, ফলে তাদের পায়ের তলার মাটিও থাকে নড়বড়ে। এক্ষেত্রে জংশন শিল্পীদের সাহায্য করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। 

“প্রযুক্তিই এখন ভবিষ্যৎ। তাই আমাদের মনে রাখা উচিত, সাধারণ মানুষের মনে প্রভাব ফেলতে হলে অনলাইন উপস্থিতির ক্ষেত্রে সমর্থন থাকাটা বর্তমানে খুব বেশি জরুরি। শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া এই ইকোসিস্টেমের মূল অংশ। আমাদের আয়োজনগুলোর মাধ্যমে আমরা এ ব্যপারে জোর দিয়ে থাকি।”     

তাছাড়া, জংশনের সরাসরি অনুষ্ঠানগুলোর একটি আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে একটি নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র, গয়না ও হাতে তৈরি করা নানা উপাদান দিয়ে এই অনুষ্ঠানগুলোর মঞ্চ সাজানো হয়। এসবের মধ্য দিয়ে তারা দর্শকদের একটি চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা উপহার দিতে চায়।   

‘নন্দন’-এর একজন শিল্পী শাফকাত আমিন ইনান জানান,

“জংশনের আয়োজনে আমার শিল্পকর্ম প্রদর্শন করাটা একটা দারুণ ব্যাপার ছিল। আয়োজকরা খুবই সহযোগিতাপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন। আমার মতো স্বাধীন শিল্পীদের জন্য এমন প্রদর্শনীর আয়োজন করাটা খুবই প্রশংসনীয়। সমমনা মানুষদের কাছে নিজের কাজকে তুলে ধরতে পারায় আমি ভবিষ্যতে শিল্পী হিসেবে আরো উন্নতি করতে পারব।”

উদ্যোক্তাদের জন্য জংশনের আয়োজন ‘উদ্যোগ’ তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি চমৎকার সৃজনশীল মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের ব্যবসার প্রচার ও প্রদর্শন করতে পারছেন। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ছোট ব্যবসাগুলো অনুমেয়ভাবেই অনেক ক্ষতির শিকার হয়েছে। উদ্যোক্তাদের সমর্থনের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব নিয়ে জংশন মতামত জানায়।   

“বিভিন্ন পদ্ধতি একত্রিত করে উদ্যোক্তাদের আরো বেশি সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা উচিত। এর জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। এই উদ্দীপনা তুলে ধরার মাধ্যমে আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। নতুন উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি ধরে রাখতে এটি খুবই প্রয়োজনীয়।”    

“এ কাজ করার জন্য সরকারের ঘাড় থেকে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ভূত তাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত। এই ব্যাপারটি নীতিমালায় অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে নতুন ক্রেতার সৃষ্টি হবে, যা ভবিষ্যতে আমাদের সাহায্য করবে।”   

দিনশেষে, জংশন একটি সামগ্রিক শিল্পবিষয়ক আন্দোলন হিসেবে পরিচিত হওয়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে একটি অবিসংবাদী শিল্পবিষয়ক আন্দোলনে পরিণত হতে চায় তারা। তাদের বিশ্বাস, এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর এবং সবার নজরে পড়ার মতো উপকরণগুলো তাদের হাতে আছে। তারা সুলভ মূল্যে শিল্পীদের সেবা দিচ্ছে, তাদের প্রকল্পগুলো পরিবেশবান্ধব এবং সেখানে লিঙ্গভেদ করা হয় না। এসবের মাধ্যমে জংশন নিজেদের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটাতে চায় এবং দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একটি পরিবর্তন ঘটাতে চায়।  

‘অ্যাকুস্টিকা’-র একজন শিল্পী স্পেসপাইপার বলেন,

“আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটি শুরু থেকেই কারো কারো একচেটিয়া দখলে চলে গেছে। পাশাপাশি, বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের এখানে বিনিয়োগ আছে। এই সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে শিল্পীদের নিজের প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য জংশনের মতো আরো উদ্যোগ আমাদের দরকার। আজকের পৃথিবীতে পণ্যের বিজ্ঞাপনের চাইতে সংস্কৃতির বিকাশ বেশি জরুরি। এমন আরো আয়োজন অতি অবশ্যই হওয়া উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি।” 

জংশন ও ‘অ্যাকুস্টিকা’র সাথে যুক্ত থাকার জন্য জংশনের ফেসবুক পেইজ এবং ‘অ্যাকুস্টিকা’-র ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম পেইজ ফলো করুন। 

 


মূল লেখক: আয়ান শামস সিদ্দিকী

বঙ্গানুবাদক: তানজিনা তাবাস্‌সুম নোভা

Share this Article
Leave a comment