প্রজন্মের দ্বন্দ্ব

Editor
11 Min Read

রাহিন আমিন


ভোর হওয়ার পিছে কাদের অবদান বেশি, তা নিয়ে তর্ক হচ্ছে। মানুষের সাথে ঝগড়া করছে সূর্য, আকাশ এবং সময়। যেন ভোর হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কার জন্য ভোর হলো, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

‘সূর্য বললো, ইশ্/আমি উঠলাম ভাগ্যিস/তাই রাত্রির হলো ভোর। মানুষ বললো ধুত্/তোর যুক্তিটা অদ্ভুত/আমরা ছিলাম বলেই দিলাম সূর্য নামটা তোর/ সূর্যটা নামটা তোর।’ 

কবীর সুমনের গান থেকে উঠে আসা স্যাটায়ার।

সূর্যের জায়গায় আপনাকে চিন্তা করে দেখুন, আর মানুষের জায়গায় আপনার মাকে। হয়তো অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু দুজনের মত মিলছে না। কখনো কি আপনার মা আপনাকে জন্ম দেয়া এবং বড় করার পিছে তার অবদান শুনিয়ে দেননি?

জেনারেশন গ্যাপ নামের এই বিষয়টি যতো ভালো করে দেখা হয়, ততো তার ব্যাঙ্গাত্মক জায়গাটা চোখে পড়ে। এখানে যুক্তিতর্কের থেকে অনেক বেশি যা হয়, তার নাম নিছক দোষারোপ। এই লেখার জন্য কয়েক প্রজন্মের মানুষকে প্রশ্ন করা হয়েছিল জেনারেশন গ্যাপের নানা বিষয় নিয়ে। তাতে জমা পড়েছে কয়েক দিস্তা অভিযোগ। এক তরুণী সাবলীলভাবে বলে দিলেন, ‘যারা এখন বয়স্ক, তাদের গড়ে উঠার মাঝেই সমস্যা ছিল, তাই তাদের সাথে আমাদের এই পার্থক্য।’ মধ্যবয়সী আরেকজনকে প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘আমরা মুরুব্বী, আমরা তো ভালো বুঝবোই। নবীনেরা ভুল করছে, তাদের ঠিক পথে রাখার দায়িত্ব তো আমাদেরই।’

এত নালিশ, এত অভিযোগের শুরুটা কোথায়? ‘জেনারেশন গ্যাপ’ এই শব্দযুগলের জন্ম ১৯৬০ সালে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে। দেখা গেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যেই প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, তারা আগের প্রজন্মের থেকে অনেক বেশি আলাদা। সেটা আরো চোখে পড়লো যখন সে সময়ের তরুণরা আগের প্রজন্মের প্রায় সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ জানাতে লাগলেন। তাদের উদারপন্থা ভেঙ্গেচুরে দিতে লাগলো সব প্রাচীন রক্ষণশীলতাকে। হ্যাঁ, যাদের আজ আমরা রক্ষণশীল বলি, তাদের চিন্তাধারাকেও একসময় উদার বলা হতো।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের এই বিশাল পার্থক্যের পিছের কারণটা আসলে এটাই। সময়ের ব্যবধান। সমাজ কখনো এক জায়গায় আটকে থাকে না। ৩০ বছর আগের একটি বাচ্চা যে সমাজে বেড়ে উঠেছে, সে সমাজের সাথে এখনকার সমাজের কোনো মিল নেই। পরিবার ব্যবস্থা বলুন, ধর্ম, পড়ালেখার ব্যবস্থা কিংবা সামাজিক রীতিনীতি, বদল এসেছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। প্রতিটি জায়গায়। তাই এই সমাজে যেই সন্তান গড়ে উঠছে তার সাথে ৩০ বছর আগে জন্মানো একজন মানুষের চিন্তায় মিল থাকে না। থাকার কথাও না।

পার্থক্য তাই দেখা যায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। গানের রুচি বদলে যায়। বদলে যায় লেখকদের লেখার ধরণ এবং বিষয়। যে ভাষায় আমরা কথা বলি, তার ধরণও বদলে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাখা বদলে যায়, সামাজিক নৈতিকতার অনেক কিছু নতুন রূপে দেখা দেয়। তাই আজ যা উদার, সময়ের আপেক্ষিকতায় কাল হয়তো তা রক্ষণশীল।

কিন্তু সমাজ তো শুধু একটি প্রজন্মের মানুষ দিয়ে গঠিত নয়। ফলে দ্বন্দ্ব দেখা যায় নানা বয়সের মানুষের মাঝে। মতান্তর সমাজের অনিবার্য অংশ, সেটা থাকবেই। সমস্যা হয় যখন প্রতিটি প্রজন্মই ‘আমরাই সবচেয়ে ভালো জানি’ এই কাপড় চোখে বেঁধে রাখে। আগের প্রজন্মের বলেই সবাই ভুলভাবে বড় হয়েছেন, আর মুরুব্বী বলেই ভালো বুঝবেন – এমন ধারণা সমাজে আছে বলেই কোনো প্রজন্মের কেউই একে অন্যের চেতনাকে ধারণ করতে পারে না। আর সমাজের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলো যেহেতু তরুণদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তাই তারুণ্যের চেতনা সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বিষয়টি তখন আর যুক্তিতর্কের পর্যায়ে থাকে না। সূর্য আর মানুষের সেই ঝগড়ায় পরিণত হয়।

আরেকটি ঘটনা বলা যাক। এক মেয়ে সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ করেছে। ধরা যাক তার নাম সেতু। ছুটিতে বসে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার স্বপ্ন মেডিকেলে ভর্তি হবে। এমন সময় তাদের বাসায় দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় উঠে আসলেন। তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে এখন বিদেশ যাবে, যাওয়ার আগে তিনি তার বিয়ে দিতে চান। আর সেতুও যেহেতু ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছে, এখনই বিয়ে দেয়ার সঠিক সময়। তাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা। ছেলে বিদেশ যাবে শুনে মেয়ের মাও দু’হাত তুলে রাজি। বাসায় ঝগড়া, চিৎকার প্রায় মারামারির পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর সেই বিয়ের প্রস্তাব কোনোমতে থামানো হলো।

উপমহাদেশীয় এই সমাজে মেয়েদের বিয়ের বিষয়টি যেন জেনারেশন গ্যাপের সবচেয়ে বড় নিদর্শক। আপনার মা-বাবার আগের প্রজন্মের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমাদের দাদী-নানিদের যুগে প্রায় সব মেয়ের বিয়ে দেয়া হতো ৮-১৩ বছর বয়সে। আমাদের মা-বাবারা আরেকটু বেশি সচেতন। তাদের যুগে সেটা ১৮-২৩ বছরে পরিণত। যা হয়েছিল দু’প্রজন্ম আগে শুরু হওয়া আধুনিক লেখাপড়ার ব্যবস্থা বাল্যবিবাহ প্রথা থামানোর উদ্যোগ নেয়াতে। কিন্তু তখনো, পুরো সমাজ মনে করতো একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ হওয়া উচিত কারো ঘরের বউ হয়ে তার সংসার সামলানো। সংসারকেন্দ্রিক হওয়ার গুণকে(!) নারীর নৈতিকতার অংশ হিসেবে মনে করা হয়েছে অনন্তকাল ধরে। এখনো হয়।

কিন্তু গত বিশ বছরে প্রযুক্তির দুর্দান্ত উন্নতি হয়েছে। ইন্টারনেট আমাদের হাতের মুঠোয় সারা বিশ্বের সব সংস্কৃতির একটি ছোট অংশ হলেও এনে দিয়েছে। তাই আগের যেকোনো সময়ের থেকে আমরা অনেক বেশি সচেতন, আগের যেকোনো সময়ের থেকে আমরা এখন আগের থেকে বেশি স্বাধীনচেতা। বৈশ্বিক যেই যৌক্তিক আন্দোলনগুলোকে আগে অতিআধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতি হিসেবে ট্যাগ দিয়ে এদেশের মানুষ নর্দমায় ফেলে দিতো, সেসব আন্দোলনের প্রভাব এখন আমাদের সমাজেও স্পষ্ট। এত শহস্র যুগ পরে এসে অবশেষে আমাদের সমাজ ধীরে ধীরে হলেও নারী পুরুষের সমতা, সমকামীতা, বৃহন্নলাদের অধিকার – এসব কঠিন শব্দ উচ্চারণ করতে শিখছে।

তাই শিক্ষিত সমাজে এখন নারীরাও পুরুষদের মতো বিয়ের আগে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার চিন্তা করছেন। সংসার এখন আমাদের কাছে একজন নারী এবং একজন পুরুষের যৌথ প্রয়াসের নাম। শুধু একজন নারীর দায়িত্ব নয়। কিন্তু আমাদের মা’রা নাছোরবান্দা। তাদের অনেকের কাছেই এখনো একজন নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় তার স্বামী এবং সংসারই। তারা তাদের সময়ে হয়তো আধুনিক ছিলেন, আমাদের সময়ে বড়ই মরচে পড়া হয়ে গেছেন।

জেনারেশন গ্যাপের সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়টি এখানেই। প্রতিটি প্রজন্মই কিন্তু তাদের নিজেদের সময়ে আধুনিকতার অন্য নাম ছিলেন। নতুন ধারণা, নতুন চেতনার প্রতিনিধি হয়ে আগের অনেক ক্ষতিকর ধারণা এবং বিষয়কে তারা দুমড়েমুচড়ে দিয়েছেন। কিন্তু সময় গিয়েছে, নতুন প্রজন্ম এসেছে, নতুন ধারণা-চেতনা-নীতি এসেছে, আর তারা রক্ষণশীলতার অপর পিঠ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গত কয়েক প্রজন্মের প্রায় সবাই সমাজে বদল আসতে দেখে ভয় পেয়েছেন। নব্য আধুনিকতার প্রতি হয়ে উঠেছেন সন্দেহপ্রবণ এবং অবিশ্বাসী।

আমরাও কি এমনই হবো? কে জানে!

বদল, নতুন ধারণা, নতুন চেতনার প্রতি এই অবিশ্বাস আসলে জেনারেশন গ্যাপের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হয়ে দাঁড়ায়। এই বদলের সবকিছু যে ভালো – এমনটা নয়। কিন্তু সবকিছু খারাপও নয়। বৈশ্বিক যেই চেতনাগুলো এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে, প্রায় সবগুলোর বৈজ্ঞানিক এবং যৌক্তিক ভিত্তি আছে। কিন্ত পোশাকের স্বাধীনতা কিংবা সমকামীদের অধিকারের মতো অতি জরুরি বিষয়গুলো যখন সামনে আনা হয়, আমাদের আগের প্রজন্মের অনেকেই তা ‘এটি আমাদের সংস্কৃতি নয়’ বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

এই যেমন, এই লেখার জন্য নানা বয়সী মানুষের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। বৃহন্নলাদের অধিকার নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই ইমেইল করে পাঠিয়েছেন, এটি আমাদের সংস্কৃতি নয়। পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে আরেকজন মধ্যবয়সী নারী বললেন, ‘আমি ক্যাথরিন মাসুদের পোশাকে আরাম, শালীনতা এবং সংস্কৃতির মিশ্রণ দেখেছি। আরামের দোহাই দিয়ে অশালীন পোশাকের দিকে ঝুঁকে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

যুক্তি দুটোর মাঝেই গুরুতর গলদ আছে। প্রথম কথা, সংস্কৃতি তাই, যা আমরা করে আসছি এবং করতে চাই। এটি কোনো ধ্রুব সত্যের নাম নয়। হাজার বছর আগে আমাদের যেই সংস্কৃতি ছিল এবং এখন যেই সংস্কৃতিতে আমরা বড় হচ্ছি, দুটো এক নয়। মানুষ বদলায়, তাই সংস্কৃতিও বদলায়। জাতি হিসেবে নিজেদের কীভাবে আমরা গড়ে তুলতে চাই, সেটা সংস্কৃতির বিশাল অংশ। আগে কখনো আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিল না বলে এখন হতে পারবে না, এমন কোনো নিয়ম নেই। থাকা উচিতও নয়। তাই সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার না দিতে চাওয়া কখনোই কোনো ভালো বিষয় হতে পারে না।

পোশাকের শালীনতা বিষয়টি একেবারেই আপেক্ষিক। আমার কাছে শালীনতা মানে যা, আপনার কাছে সেটা নাও হতে পারে। সে বিষয়ে কথা না বলাই ভালো। কিন্তু যিনি ক্যাথরিন মাসুদের উদাহরণ দিয়েছেন, তিনি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন, ক্যাথরিন মাসুদ এমন সমাজ থেকে এসেছেন, যেখানে শালীনতার বিচারমাত্রা আমাদের এই দেশের থেকে অনেক শিথিল। ক্যাথরিন যে নিজে শাড়ি পড়তে ভালোবাসেন, সেই ভালোবাসার পিছে শালীনতার পরিসীমা মেনে চলার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না। বরং পোশাক হিসেবে শাড়ির প্রতি অনুরাগ জন্মেছে বলেই হয়তো তিনি শাড়ি পরে তৃপ্তি বোধ করেন।

শালীনতার প্রশ্ন বাদেও, যে পোশাক পড়ে আমি দিনের পুরোটা সময় কাটাবো, সে পোশাকটি কী হবে বা কেমন হবে, সে বিষয়ে স্বাধীনতা থাকাটা আমার অধিকারের মাঝে পড়ে। কিন্তু না, অধিকারের ব্যাপারে পরোয়া করা তো আমাদের সংস্কৃতি নয়ই!

এগুলো নাহয় অনেক ভারি বিষয়। আরো অনেক মৌলিক বিষয়কেও সংস্কৃতি নয় বলে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। যেমন মাসিকের বিষয়টি। ‘মেনস্ট্রুয়েশনাল হেল্থ’ নিয়ে এদেশের প্রতিটি মেয়ে, প্রতিটি নারীর এবং প্রতিটি পুরুষের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এটি কোনোভাবেই ট্যাবু নয়, ট্যাবু হওয়া উচিত নয়।

কিংবা ধর্ষণ যে শুধু একজন ধর্ষকের দোষে হয়, সে বিষয়টিকে অস্বীকার করা। সামাজিক হোক বা ধার্মিক কারণে, আমাদের আগের প্রজন্মের অনেকেই মনে করেন মেয়েদের রাতে চলাফেরা কিংবা পোশাকের স্বাধীনতা ধর্ষণের অন্যতম কারণ। তাই ধর্ষণের পরে বিচার চাওয়ার আন্দোলন যতো বেশি হয়, তার থেকে বেশি চলে ভিক্টিমের উপর দোষারোপ।

এসব বিষয়ে এসে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের পার্থক্যগুলো যেন প্রায় অন্ধত্বের পর্যায়ে নেমে যায়। শুধু মাত্র একটি প্রজন্ম বদলে যাওয়া সমাজের সাথে খাপ খেতে পারছে না বলে যখন অন্য মানুষরা তাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন এই জেনারেশন গ্যাপের ভয়ংকর রূপটা চোখের সামনে আসে।

মুদ্রার উলটো পিঠটাও আছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমরা এগিয়ে আছি বলেই আগের প্রজন্মের মানুষদের মতকে প্রাধান্য না দেয়ার বিষয়টি প্রায় সব জায়গায় দেখা যায়। সব প্রজন্মই নিজেদের বিশ্বাসে প্রবলভাবে আটকে থাকে বলে সমাজে এসব বিষয় নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয় না।

তাই আমরা সুমনের গানের সূর্য হয়েই থেকে যাই। আর আগের প্রজন্মের মানুষেরা আমাদের ক্রমাগত মনে করিয়ে দেন, তারা আছেন বলেই আমরা আছি।

Share this Article
Leave a comment