হে ধরণী, দ্বিধা হও!

Editor
8 Min Read

রাহিন আমিন


২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থীর উপাধি ছিল ‘প্যাডম্যান’। ভালোবাসার নয়, বিদ্রুপের উপাধি।  পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা আলোচনার চেষ্টা এবং নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে কাজ করতে চাওয়া সাজিথ প্রেমাদাসাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা এখনো প্যাডম্যান নামেই ডাকেন। তাতে অবশ্য প্রেমাদাসার কোনো আপত্তি নেই, তিনি বরং নিজেকে গর্বিত বলেই দাবি করেন। কিন্তু এই উপাধি যা ক্ষতি করার তা করে ফেলেছে আগেই। শ্রীলঙ্কার রক্ষণশীল বৌদ্ধ সমাজে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারেন নি প্রেমাদাসা। হেরে গিয়েছিলেন নির্বাচনে।

‘হে ধরণী দ্বিধা হও’ বাগধারাটি রামায়ণ থেকে বাংলায় এসেছে। রাবণের কাছ থেকে প্রিয়তমা পত্নীকে উদ্ধার করে আনার পর সীতার সাথে সুখের সংসার শুরু করেন রাম। কিন্তু সেই সুখ খুব বেশি দিন স্থায়ী হলো না। অযোধ্যায় সীতাকে নিয়ে নানা গুজব ছড়াতে শুরু করে। ক্ষিপ্ত প্রজারা দাবি করেন, সীতাকে তার সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হবে। রামও এখানে সীতাকে কোনো সাহায্য করলেন না। প্রজাদের দাবিই প্রায় বিনা বাক্যে মেনে নিলেন তিনি। অপমানে, লজ্জায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় সীতা মাটিকে বলেন তাকে ফিরিয়ে নিতে। পৃথিবী দু’ভাগ হয়ে তাকে ফিরিয়ে নিলো। সেই থেকে ‘হে ধরণী দ্বিধা হও’ বাংলায় অপমানসংক্রান্ত লজ্জার প্রতিশব্দে পরিণত হয়।

পিরিয়ড নিয়ে মানুষের সবচেয়ে সাধারণ অনুভূতির নাম যদি এক বাক্যে প্রকাশ করতে বলা হয়, তবে বোধহয় “হে ধরণী দ্বিধা হও”- এর থেকে ভালো কোনো বাক্য পাওয়া যাবে না। পিরিয়ড নিয়ে কথা বলা মানেই যেন গালের দু’পাশে লালচে আভা দেখা যাওয়া। কোনো নারী তার বন্ধুর সাথে নিজের মাসিক নিয়ে কথা বলছেন, আশেপাশের কেউ হয়তো মুচকি হাসছে, কেউ লজ্জায় কিংবা “এ সমাজ কোথায় যাচ্ছে?”- ধরনের হতাশায় মাথা এতটাই নিচু করে ফেলেছেন যেন মাটির ভেতর ঢুকে যেতে পারলেই বাঁচেন। কোনো নারীর হঠাৎ হয়তো পিরিয়ড হয়েছে, তার প্যান্টে হয়তো লিকেজের দাগ দেখা যাচ্ছে। পেছনে মৃদু হাসাহাসি, বাজে মন্তব্য সবই শোনা যায়। নেহাত কোন ভদ্রলোক যদি হয়ে থাকেন, তিনি হয়তো হয়রানিতে অংশ নিবেন না, কিন্তু ঠিকই লজ্জায় ধরণীকে দু’ভাগ হতে বলবেন। এই সমাজ শুধু মাসিক নিয়ে কথা বলাই বন্ধ রাখে নি, যারা বলতে চেয়েছে, তাদেরও দমিয়ে রেখেছে।

মাসিক সংক্রান্ত কুসংস্কার আসলে শহরে গ্রামে সব জায়গাতেই আছে — নানা রূপে। শহরের ট্যাবু পিরিয়ডকে ওপেন সিক্রেট বানাতে ব্যস্ত। মাসিকের ব্যাপারে সবাই জানে, কিন্তু তা নিয়ে কথা বলাতেই যত পাপ। এই পাপ এড়িয়ে চলতে অনেক কিছুই করতে হয়। সেটি বাসায় প্যাড লুকিয়ে রাখা থেকে শুরু করে রোজার মাসে রোজা না রাখতে পারলেও বাড়ির পুরুষদের সামনে রোজা রাখার অভিনয় করা পর্যন্ত বিস্তৃত।

ফার্মেসিতে প্যাড কিনতে গেলেও এমন অভিনয় করতে হয় যেন কোনো গভীর পাপ লুকাতে আসতে হয়েছে। অন্য কেউ ফার্মেসিতে থাকলে চুপচাপ অপেক্ষা করা, ফার্মেসি শেষ পর্যন্ত খালি হলে দোকানদারকে ইশারায় বুঝিয়ে দেয়া কী দরকার। দোকানদারও মহার্ঘ বুঝে ফেলেছেন এমন ভাব নিয়ে একটা খয়েরি প্যাকেটে প্যাড মোড়াচ্ছেন আর আমরাও সেই প্যাকেট ব্যাগের এক গুপ্ত কোনায় চটজলদি লুকিয়ে নিয়ে চলে আসছি। পিরিয়ড যেন এ সমাজের ভলডেমর্ট। সবর্দা সব জায়গায় উপস্থিত, কিন্তু ‘দ্য ওয়ান হু শ্যাল নট বি নেমড’। দৈনন্দিন জীবনের চিরন্তন সত্যের একটা, কিন্তু মুখে নাম তুলতে চাইলেই নৈব নৈব চ।

গ্রামীণ সমাজে শুধু এ বিষয়ে কথা বলা পাপ নয়, মাসিক নামক পুরো বিষয়টিই পাপ। একের পর এক বলে গেলে এই বিষয়ে সব কুসংস্কার মিলিয়ে একটি মহাভারত রচনা করা যাবে। তবে পিরিয়ড অশৌচের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত — এই ধারণা প্রায় সব সংস্কারেই উপস্থিত। এটি অবশ্য আজকে কালকে থেকে নয়, বহু পুরনো। প্রায় সব ধর্মীয় পুরাণে এই অশৌচের ধারণা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে এই ধারণা এসেছে বেদ থেকে। মনে করা হয়, অসুর বৃত্তকে হত্যার কারণে দেবরাজ ইন্দ্রের অপরাধ নিজেদের উপর নেন নারীরা। বিশ্বাস অনুযায়ী সেই থেকে প্রতি মাসে ইন্দ্রের অপরাধ নারীদের শরীরে মাসিকের রক্ত হয়ে ঝরে পড়ে। তাই এই রক্ত পাপের রক্ত, অপরাধের রক্ত।

অনান্য ধর্মেও মাসিককে অশৌচের সাথেই মেলানো হয়েছে। মুসলিম নারীরাও মাসিকের সময় নামাজ পড়তে পারবেন না, রাখতে পারবেন না রোজা। এমনকি এ সময় কুরআন ধরতেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাদের। ভারতে নারীরা পূজোর ঘরে তো ঢুকতে পারেনই না, অনেক জায়গায় তাদের হাতের রান্নাও অশৌচ হিসেবে ধরা হয়। নেপালে মাসিকের সময় নারীদের স্থান হয় ঘরের এক বিচ্ছিন্ন কোণে, মাটির মাঝে। কোনো বিশ্বাসে নারীরা মাসিকের প্রথম তিনদিন গোসল করতে পারবেন না। কোনো বিশ্বাসে তাদেরকে বাড়ির সবার আগে উঠে নিজের অপবিত্র কাপড় পরিষ্কার করতে হবে, যাতে অন্য কেউ না দেখে।

এগুলো তো তবুও অশৌচের ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। পিরিয়ডকে অপবিত্র মনে করা কুসংস্কার কতদূর বিস্তৃত হতে পারে সেটা অবিশ্বাস্য। গ্রামে এমন বিশ্বাসও আছে যেখানে মনে করা হয় নারীদের মাসিকের রক্ত কোনো পুরুষের চোখে পড়লে তিনি অন্ধ হয়ে যাবেন। ভারতের গ্রামগুলোয় মাসিকের সময় নারীদের কোনো গরুর কাছে যেতে দেয়া হয় না। মনে করা হয়, এ সময় কোনো নারী কোনো গাভীর সংস্পর্শে এলে সেই গাভী বন্ধ্যায় পরিণত হবে, যার ফলে আজীবন অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে সেই নারীর। পিরিয়ডের সময় কোনো প্রাকৃতিক জলাশয়ে নারীরা স্নান করলে সেই জলাশয়ের সব মাছ মরে যাবে, এমন ধারণাও প্রচলিত অনেক অঞ্চলে।

এই ট্যাবু শুধু সামাজিক বৈষম্যের সাথে সম্পর্কিত, এ কথা কিন্তু ভুলেও ভাবতে যাবেন না। ২০১৪ সালে গার্ডিয়ানের এক রিপোর্টে উঠে এসেছে মাসিক সংক্রান্ত কুসংস্কারের প্রভাব প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতে কতটা সুদূরপ্রসারী। পিরিয়ডের সময় সিয়েরা লিওনে প্রায় ২০% ছাত্রী স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। আফগানিস্তান এবং নেপালে এই সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশে পরিণত। ভারতে পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর প্রায় ২৫% ছাত্রীর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। যারা এরপরেও ভাগ্যক্রমে পড়ালেখা করতে পারে, তারা প্রতি মাসে গড়ে ৫ দিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। মেয়েরা বড় হতে থাকে, আর মাসিক তাদের পড়ালেখায় ক্রমেই আরো বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে থাকে।

মেয়েদের পড়ালেখার উপর পিরিয়ড সংক্রান্ত ট্যাবুর এই প্রভাব পুরো সমাজেই প্রভাব ফেলে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে। একজন নারী শিক্ষা গ্রহণ করলে তিনি বিয়ে করার পর জনসংখ্যার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকেন। ফলে তিনি সন্তান কম নেন, নিজের প্রতি হওয়া সামাজিক বৈষম্যগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখেন। এবং নারীর শিক্ষা শুধু নারীদের জন্যেই উপকারী নয়। দেখা গেছে, নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হারে প্রতি ১% উন্নতির জন্য একটি দেশের মাথাপিছু আয় গড়ে ০.৩% করে বাড়ে। তরুণরা যেভাবে চাকরির বাজারে অংশ নিতে পারেন, সেভাবে যদি প্রতিটি নারী পারতেন, তবে প্রতিটি দেশের জিডিপি প্রতিবছর গড়ে ১.২% করে বাড়তো।

অর্থনীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে যদি শুধু দৈনন্দিন জীবনের দিকেও তাকাতে হয়, তাহলেও এই ট্যাবু নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দেয়। ২০১৪ সালে করা এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখনো ৮৯% নারী স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে কাপড় ব্যবহার করেন। তাতেও সমস্যা হতো না, যদি এই কাপড় পরিষ্কার রাখা যেতো। কিন্তু লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা করা যায় না। অপরিষ্কার ও নোংরা কাপড়টিই ব্যবহার করতে হয় বারবার।

মাসিক স্বাস্থ্য সরাসরি যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। পিরিয়ডের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে যৌন স্বাস্থ্যের জন্য সেটি ভয়াবহ হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।

পিরিয়ড নিয়ে এই ট্যাবু আসলে শুধু একটি স্বাস্থ্যপ্রক্রিয়া নিয়ে কুসংস্কার নয়। এটি সমাজের নারীদের অবস্থার নির্দশন। তাদেরকে চাইলেই ঘরের এক কোনায় ফেলে রাখা যায়। চাইলেই তাদের পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়া যায়, চাইলেই তাদের ধর্মীয় অধিকার কেড়ে নেয়া যায়। চাইলেই প্রজনন স্বাস্থ্যের এক অমোঘ অংশকে বানিয়ে দেয়া যায় পাপের রক্ত।

হে ধরণী, দ্বিধা হও!

Share this Article
Leave a comment