ময়েজ উদ্দীন আশরাফী
বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। হ্যাঁ, পৌনে ছ’টা সকাল বটে, অন্ততপক্ষে আমার জন্য। আমার এখন স্বপ্নের রাজ্যে থাকার কথা। তার উপরে আবার ছুটির দিন।
আমাদের বসার বারান্দায় যে চেয়ারটা রাখা হয়েছে, তাকে আরামকেদারা বলা বাহুল্য হবে না। প্লাস্টিকের বাঁকানো হাতওয়ালা চেয়ার। তার উপর নরম অল্প তুলার বালিশ। অলস থেকে শুরু করে আরামপ্রিয় – যেকোন একটা ট্যাগ তার নামের সাথে থাকলেই এই সুন্দর আবহাওয়ায় এই চেয়ারটার উপর সুখনিদ্রার আয়োজন করতে বাধ্য। আমি ওখানে হেলান দিয়ে বসে পা দুটো রেলিঙের উপর তুলে দিয়েছি। এক পায়ের উপর আরেক পা। হাত দুটো আমার কাধঁ থেকে কনুই পর্যন্ত হাতলের উপর। ঠিক কনুই বরাবর দুই হাত-ই আমার পেটের দিকে মোড় নিয়ে এক হাতের উপর আরেক হাত আমার পেটের উপর আরাম করছে। আজ দু’জনার দুটি পথ দু’দিকে বেঁকে যায় নি। একদিকে এসে মিশেছে। হ্যাপি এন্ডিং যাকে বলে। বসার কায়দাটা বেশ নবাবী। হঠাৎ দেখি আমার এই বারান্দায় বসে বিলাসযাপনের দর্শনার্থী হয়ে এসেছে একটি কাক। আমার পায়ের ঠিক পাশে এসে বসেছে, রেলিঙের উপর। আমার ভয় পেয়ে পা সরিয়ে নেয়ার কথা। কিন্তু কিছুই হলো না। এর সম্ভাব্য দু’টি কারণ হতে পারে। এক, কোনো এক কারণে আমার নার্ভ ইম্পালস কাজ করছে না। দুই, আমি হয়তো জেগে নেই। কল্পনা আর বাস্তবতা মিলেমিশে গেছে। এই ধরনের ব্যাপার। কল্পনায় নাকি সব সম্ভব। তাই কাকের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করলাম৷ “কাকাবাবু, কাকাবাবু!”
“আমায় বলছ?”
“হ্যাঁ! তোমাকেই বলছি। তুমি ছাড়া আর আছে কে এখানে?”
“তা ঠিক। বল। “
“তা এই সাত সকালে আমার বাড়ির বারান্দায় কি আছে জানতে পারি?”
“পারো বৈকি। কিন্তু এই ‘তোমার বাড়ি’ ব্যাপারটা কিন্তু বেশ গোলমেলে। বিধাতা পৃথিবীতে তোমাকেও পাঠিয়েছেন, আর আমাকেও। এর মধ্যে আমাদের দুজনেরই অবাধ বিচরণ। এর মধ্যে তুমি একটি জায়গায় খুঁটি গেড়ে বলবে এটা ‘আমার বাড়ি’, তা কতটুকু যৌক্তিক বলো?”
“তা অবশ্য ঠিক বলেছেন, কাকাবাবু।”
“ঠিক তো বেশিরভাগ সময়েই বলি৷ আচ্ছা, তোমার এই কাকাবাবু ডাকটার কারণ কি জানতে পারি?”
“নিশ্চয়ই। দেখুন, এখানে অন্যান্য পাখির চেয়ে আকারে আপনি খানিকটা বড়। আপনার নাম কাক। আপনি ডাকেন কা-কা-কা করে। “কাকাবাবু”। বেশ হয়েছে না? শ্রুতিমধুর এবং যুক্তিযুক্ত।”
“তথ্যে ভুল রয়েছে, বাপু। আমরা ‘কা কা’ করে ডাকি না। ‘ক্রর্ র্ র্’ করে ডাকি। শ্রুতিমধুর কথাটা মেনে নিচ্ছি।”
“কাকাবাবু নামটা কোথা থেকে নিয়েছি, জানেন? এক গোয়েন্দা উপন্যাস থেকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা।”
“ওহ আচ্ছা। কী জানি বলছিলাম? ভুলেই গেলাম। বড্ড বেশি বকো তুমি।”
“কী বলছিলেন?”
“মনে পড়েছে। তোমার বাড়ি নিয়ে…”
“না কাকাবাবু, আমি কিছু মনে করি নি। আপনার সাথে গল্প করতে ভালোই লাগছে।”
“আহা! শুনো না! তুমি বললে তোমার বাড়ি। এই কোকিল আমার বাসায় ডিম পাড়ে৷ তোমাদের কি মনে হয় আমি জানি না? নিজের অজান্তে তার ডিমে তা দেই? আমার ঔদার্যকে তোমরা মানুষেরা এত সুকৌশলে ঢেকে দিয়েছ?
“আহ! আমি তো তবে ভুল জানতাম, সরি।”
“তা তো তোমার দোষ নয়, খোকা। তোমার চিন্তাধারাই এভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে”।
“তুমি নাকি অনেক চালাক। এই জন্য নাকি তুমি ডাস্টবিন থেকে ময়লা খাও। চালাকি করে পড়া ফাঁকি দিলে আমাদের এই কথা বলা হয়।
“চালাক আর বুদ্ধিমানের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য তোমরা বিলীন করে দিয়েছ। এই ধরো, আমি ময়লা খেতাম না। ফেলে রাখতাম। তাহলে তোমাদের আবর্জনা বাড়ত নাকি কমত?”
“আরে! এভাবে তো ভেবে দেখি নি।”
“আবার তোমরা বলো আমি নাকি চুরি করার সময় চোখ বন্ধ করে চুরি করি। কিন্তু ভেবে দেখো তো, খাদ্যব্যবস্থার জন্য কোনো প্রাণী শিকার করে না৷ তোমরা মানুষেরা তা করো। তোমরা কেবল কিছু কাগজ এবং ধাতুর দ্বারা তোমাদের মধ্যে জিনিস বিনিময় করো। আর এটাকে তোমরা চুরি বলো না। এখন দেখো, আমি যখন শিকারের দিকে দ্রুত উড়ে যাই, তখন এয়ার ফ্রিকশনের কারণে বাতাসের ঝাপটা আমার চোখে লাগে। আর সে কারণেই আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তোমরা নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক উন্নত। কিন্তু এই সহজ বিজ্ঞানটা তোমাদের মাথায় ঢুকে না?”
“হুম, তা ঠিক। তা কাকাবাবু আপনার তো দেশের জাতীয় পাখি হবার দাবি আগে। তো দোয়েল কোত্থেকে এসে আপনার জায়গা দখল করল?”
“সবই রাজনীতির খেলা। আমি নাকি কালো, অসুন্দর। কিন্তু কোকিল, ও তো কালো। তাকে তো তোমরা ঠিকই সুন্দর বলো, ও গান গাইতে পারে বলে। কোকিলের ডিম এ যদি আমি তা না দিতাম, ও তো থাকত-ই না৷ আর আমি তো ময়লা খাই তোমাদের ভালোর জন্যই।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি৷ দূর থেকে মায়ের অস্পষ্ট ডাক স্পষ্ট হতে থাকল।
“মাহিন, এই মাহিন৷ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে একা একা বসে বারান্দায় কি বিড়বিড় করছিস?”
“কিছু না।”
দেখলাম একটা কাক আমাদের রেলিঙ থেকে কা কা করতে করতে চলে গেল।
না।
কা কা না।
ক্রক্র্ র্ ক্রক্র্ র্।