ডিম: “The Egg” গল্পের অনুবাদ

Editor
7 Min Read

লেখক: অ্যান্ডি উইয়ার

অনুবাদক: তানজিনা তাবাস্‌সুম নোভা


মারা যাওয়ার সময় তুমি বাড়ি ফিরছিলে।

একটা সড়ক দুর্ঘটনায় তোমার মৃত্যু হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু না হলেও ব্যাপারটা প্রাণঘাতী ছিল, নিঃসন্দেহে। তুমি তোমার স্ত্রী আর দুই সন্তানকে রেখে এসেছিলে। তোমার মৃত্যু ছিল যন্ত্রণাহীন। তোমাকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয় নি। আর, তোমার শরীর এমনভাবে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল যে, বিশ্বাস করো, মরে গিয়েই তুমি বেঁচে গিয়েছিলে।

ঠিক তখন আমার সাথে তোমার দেখা হলো। 

“কী হয়েছিল?” তুমি জানতে চাইলে, “আমি কোথায়?”

আমি উত্তর দিলাম, নীরসভাবে, “তুমি মারা গেছ।” কথা প্যাঁচানোর কোনো প্রয়োজন দেখতে পেলাম না আমি। 

“রাস্তায় একটা ট্রাক…ওটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল…”

“হ্যাঁ।” আমি বললাম।

“আ…আ…আমি মরে গেছি?”

“হ্যাঁ। কিন্তু এটা নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। সবাই-ই তো মারা যায়।”

তুমি চারপাশে তাকালে। চারপাশে শুধুই শূন্যতা। তুমি আর আমি ছাড়া কেউ নেই। “এই জায়গাটা কোথায়?” তুমি জিজ্ঞাসা করলে, “এটাই কি পরকাল?” 

“অনেকটা সেরকমই।” 

“আপনি কি ঈশ্বর?”

“হ্যাঁ। আমি ঈশ্বর।”

তুমি বললে, “আমার ছেলে-মেয়েরা…স্ত্রী — ওদের কী হবে? তারা ঠিকঠাক থাকবে তো?”

“এটাই তো আমি চাই। তুমি মাত্র মারা গেছ, আর তোমার প্রধান চিন্তা তোমার পরিবারকে নিয়ে। ভালো। খুব ভালো।”

অবাক দৃষ্টিতে তুমি আমার দিকে তাকিয়েছিলে। আমাকে দেখে তোমার ঈশ্বর মনে হচ্ছিল না, একজন পুরুষ অথবা নারীর মতো লাগছিল। অথবা, সম্ভবত কোন কর্তৃত্বপরায়ণ সত্তা। আমাকে দেখে সর্বশক্তিমান বলে মনে হচ্ছিল না তোমার, বরং একজন স্কুল শিক্ষকের মতো মনে হচ্ছিল। 

আমি তোমাকে বললাম, “চিন্তা করো না। ওরা ভালোই থাকবে। তোমার বাচ্চারা তোমাকে সবদিক দিয়ে নিখুঁত একজন বাবা হিসেবে মনে রাখবে। তোমার প্রতি ঘৃণা জন্মানোর মত যথেষ্ট সময় ওরা পায় নি। আর, তোমার স্ত্রী বাইরে কাঁদলেও ভেতরে ভেতরে স্বস্তি পাবে। সত্যি কথা বলতে কী, তোমাদের সম্পর্কটা ভেঙেই যেত। এটা জেনে তুমি একটু সান্ত্বনা পেতে পারো যে, তোমার মৃত্যুতে স্বস্তিবোধ করার জন্য তোমার স্ত্রী অপরাধবোধে ভুগবে।”

“ওহ্‌। তো, এখন কী হবে? আমি স্বর্গ না হয় নরকে যাবো, তাই তো?”

“কোনোটাই না। তোমার পুনর্জন্ম হবে।” 

“আচ্ছা, তাহলে হিন্দুরাই ঠিক ছিল।”

“সব ধর্মই কোনো না কোনোভাবে ঠিক,” আমি বললাম, “এসো আমার সাথে।”  

 সেই শূন্যতার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে তুমি জানতে চাইলে, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

“নির্দিষ্ট কোথাও না। আমি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে পছন্দ করি।”

“আচ্ছা, তাহলে এর উদ্দেশ্য কী?” তুমি বললে, “পুনর্জন্ম হলে আমি তো একটি সাদা কাগজের মতোই হয়ে যাব, তাই না? একদম ছোট শিশুর মতো? এই জীবনে আমি যা করেছি, আমার অভিজ্ঞতাগুলো—কিছুরই তো কোনো মূল্য থাকবে না।” 

“ব্যাপারটা ওরকম না। তোমার ভেতরে তোমার অতীত-জীবনের সকল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে। এই মুহূর্তে তোমার সেটা মনে নেই, এই যা।” 

আমি হাঁটা থামিয়ে তোমার দুই কাঁধ ধরে দাঁড়ালাম। “তোমার আত্মা কত মহৎ, সুন্দর, আর বিশাল, তুমি তা কল্পনাও করতে পারো না। মানুষের মন তোমার অতি ক্ষুদ্র একটা অংশই ধারণ করতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা একটি গ্লাসের পানিতে আঙুল ডুবিয়ে পানি গরম না ঠাণ্ডা তা পরীক্ষা করার মতো। তুমি তোমার আঙুলের ছোট একটি অংশ পাত্রটিতে দাও, আর যখন তুমি আঙুলটা বের করে আনো, ওটা যা অনুভব করেছে, সবই তুমি জানতে পারো।

গত ৪৮ বছর ধরে তুমি একজন মানুষের ভেতরে ছিলে, তাই তোমার বিপুল সত্তাকে তুমি এখনও অনুভব করতে পারছ না। এই জায়গায় যথেষ্ট সময় কাটালেই তোমার সব মনে পড়ে যাবে। কিন্তু, প্রতিটি নতুন জীবন শুরু করার আগে এটা করার আসলে কোনো মানে নেই।”

“মানে? আমার কতবার পুনর্জন্ম হয়েছে?”

“অনেকবার। অনেক অনেক বার। অনেক ধরনের জীবনে।” আমি বললাম, “এবার তুমি ৫৪০ সালের একজন চীনা কৃষাণী হবে।”

তুমি কিছুটা তোতলাতে শুরু করলে, “দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি আমাকে অতীতে ফেরত পাঠাচ্ছেন?” 

“তা বলতে পারো। সময়ের ধারণাটা শুধু তোমার বিশ্বেই আছে। আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে ব্যাপারটা অন্যরকম।”

“আপনি যেখান থেকে এসেছেন মানে?” তুমি জিজ্ঞেস করলে। 

“অবশ্যই।” আমি ব্যাখ্যা করলাম, “আমি তো কোথাও থেকে এসেছি। অন্য একটি জায়গা থেকে। ওখানে আমার মতো আরো অনেকেই আছে। আমি জানি, তোমার জায়গাটি সম্বন্ধে জানার কৌতূহল হচ্ছে, কিন্তু সেটি বুঝতে পারার ক্ষমতা তোমার আসলেই নেই।”

“আচ্ছা।” তুমি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লে। “কিন্তু এভাবে বিভিন্ন সময়ে যদি আমি পুনর্জন্ম নিতে থাকি, তাহলে তো আমার যেকোন মুহূর্তে নিজের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে।”

“হ্যাঁ। সবসময়ই তো হচ্ছে। কিন্তু, একটি জীবনে তুমি শুধু সেই জীবনের কথাই মনে রাখতে পারো। কাজেই এমন হলেও তুমি সেটা বুঝতে পারবে না।”

“তাহলে এসবের মানে কী?”

“তুমি সত্যিই আমার কাছে জীবনের অর্থ জানতে চাইছ? এরকম একটি গতানুগতিক প্রশ্ন করছ তুমি আমাকে!”

তুমি নাছোড়বান্দার মতো বললে, “এটি একটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন।”

আমি তোমার চোখের দিকে তাকালাম, “আমি তোমাকে পরিণত দেখতে চাই। এটিই জীবনের অর্থ। এ কারণেই আমি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছি।”

“আপনি মানবজাতির কথা বলছেন? আপনি আমাদের পরিণত দেখতে চান?”

“না। শুধু তুমি। তোমার জন্যই আমি এই মহাবিশ্ব বানিয়েছি। প্রতিটি নতুন জীবনের সাথে তুমি বেড়ে উঠো, পূর্ণাঙ্গ হও, আর আরো উন্নত বুদ্ধিমত্তায় পরিণত হও।”

“শুধু আমি? অন্যদের কী হবে?”

“এই মহাবিশ্বে আর কেউ নেই।” আমি বললাম, “শুধু তুমি আর আমি।”

তুমি শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলে, “পৃথিবীতে যে এত মানুষ আছে…”

“সবাই তুমি। তোমার বিভিন্ন জন্মের রূপ।”

“কী? আমি-ই সবাই!”

তোমার পিঠে একটা প্রশংসাসূচক চাপড় দিলাম আমি, “এই তো, বুঝে গেছ।”

“পৃথিবীতে যত মানুষ বেঁচে ছিল, সবাই আমি?”

“হ্যাঁ। আর যত মানুষ ভবিষ্যতে বাঁচবে, তারাও।”

“আমি-ই আব্রাহাম লিংকন?”

“জন উইল্‌কিস বুথ-ও তুমি-ই।”

খুবই বিতৃষ্ণার সাথে তুমি বললে, “আমি হিটলার?”

“যেসব মানুষকে সে মেরেছে, তারাও তুমি।”

“আমি যিশুখ্রিস্ট?”

“তাঁর সকল অনুসারীরাও তুমি।”

তুমি চুপ হয়ে গেলে।

“যতবার তুমি কাউকে আঘাত করেছ,” আমি বললাম, “তুমি নিজেকেই আঘাত করেছ। যতবার তুমি কাউকে দয়া দেখিয়েছ, তুমি নিজের প্রতিই দয়া দেখিয়েছ। প্রতিটি মানুষ যখনই আনন্দ বা কষ্ট অনুভব করেছে, বা ভবিষ্যতে করবে, সবই আসলে তুমি অনুভব করবে।”

তুমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবলে।

“কেন?” তুমি প্রশ্ন করলে, “এত সব কেন?”

“কেননা, একদিন তুমি আমার মতো হবে। কারণ, এটাই তুমি। তুমি আমারই মতো। তুমি আমার সন্তান।”

“কী? আপনি বলতে চাইছেন আমি ঈশ্বর?” তুমি বিশ্বাস করতে পারছিলে না।

“না। এখনও না। এখন তুমি একটি ভ্রূণ। তুমি এখনও বেড়ে উঠছ। যখন তুমি সব কালের সব জীবন যাপন করে ফেলবে, তখন তুমি জন্ম নেওয়ার মতো বেড়ে উঠবে।”

“তার মানে, এই পুরো মহাবিশ্ব,” তুমি বললে, “শুধুই একটা…”

“ডিম।” আমি বললাম। “এখন তোমার পরবর্তী জীবনে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”

তারপর আমি তোমাকে তোমার পথে পাঠিয়ে দিলাম। 

 


Tanzina Tabassum Nova is a full-time couch-potato, and a part-time reader, writer, translator, and reciter.

Share this Article
Leave a comment