সাদিয়া তাসমিয়া তালুকদার
ব্যবসা জগতের আলোচিত বই Business in Blue Jeans– এর লেখক সুজান মো জন্মের পর থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি কথা বলতেন, খুব দ্রুতই ভুলে যেতেন অনেক কিছু, সহজে কোনো বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারতেন না। পরবর্তীতে বয়স ত্রিশের কোঠায় এসে তার এডিএইচডি (ADHD) ধরা পড়ল। তখন বোঝা গেল কেনো এত বছর তার ব্যবহার স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা আলাদা ছিল।
একই ঘটনা ঘটেছে O2e এর সিইও ব্রায়ান স্কুডেমোরের সাথেও। কিছুতেই কলেজের লেখাপড়ায় মনযোগ দিতে না পারা ব্রায়ান মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
এডিএইচডি কী, তা বলার আগে কিছু পাঠক কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করুন। যা থেকে বোঝা যাবে আপনিও সুজ্যান কিংবা ব্রায়ানের মতো এডিএইচডিতে আক্রান্ত কি না।
১। আপনার জিনিসপত্র কি খুব সহজে হারিয়ে যায়? পরিচিত মানুষেরা কি আপনার কাছে কোনো জিনিস রেখে ভরসা করতে পারেন না? প্রয়োজনীয় জিনিস কোথাও রেখে খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যান কোথায় রেখেছিলেন?
২। ইংরেজিতে একটা কথা আছে। “Third Time’s a Charm”। মানে কোনো কিছু করতে গেলে তা তৃতীয়বারে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এমন কি আপনার সাথে ছোট ছোট কাজের ক্ষেত্রেও হচ্ছে? যেমন ধরা যাক, কোথাও যাচ্ছেন। গেট খুলতে গিয়ে মনে পড়ল আপনি চাবি আনেননি। চাবি নিয়ে আসলেন কিন্তু রেখে আসলেন সেলফোনটা?
৩। আপনি কি কারো সাথে কথা বলতে বলতে অন্য কিছু ভাবতে শুরু করেন? হয়তো আপনার শিক্ষক আপনাকে একটি প্রশ্ন করেছে কিন্তু তার মাঝেই আপনি আগের দিনের কোন ঘটনা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিলেন, এমন ধরনের ঘটনা কখনো ঘটেছে আপনার জীবনে?
৪। আপনি কি প্রয়োজনীয় জিনিস গোছানোর জন্য অনেক ধরনের সামগ্রী কেনেন কিন্তু তাও সেগুলো এলোমেলো হয়ে যায় এবং পরবর্তীতেতে আবারো জিনিস গোছানোর সরঞ্জামগুলো গুছিয়ে রাখতেই আবার নতুন কোনো সরঞ্জাম নিয়ে আসতে হয়?
৫। আপনার কাছে অনেক সময় আছে কিন্তু তারপরেও কাজগুলো ঠিক সময় করা হয়ে ওঠে না? আগামীকাল থেকে শুরু করব এমনটি প্রতিদিন-ই ভাবছেন, কিন্তু সেই কালের দেখা পাচ্ছেন না?
৬। আপনি কি মাঝে মাঝে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন না? ক্লাসে যাচ্ছেন, উপস্থিত থাকতেই হবে কিন্তু মাঝপথে আপনার কোনো এক বন্ধু সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা বললে, আপনি কি ক্লাসের কথা দিব্যি ভুলে গিয়ে থিয়েটারে চলে যান? কিংবা অন্য অহেতুক কোনো কাজ করতে গিয়ে ক্লাসে দেরি করে ফেলেন?
৭। আপনি কি খুব সহজে অন্যমনস্ক হয়ে যান? আপনার আশেপাশের মানুষের অনেক সাধারণ কোনো কাজ, মাথার উপরে ফ্যানের শব্দ – এমন ছোট ছোট বিষয়-ই কি আপনার মনোযোগ নষ্ট করতে যথেষ্ট?
৮। আপনি কি এক কথা বারবার বলেন? আর অন্য কেউ যতক্ষণ না ধরিয়ে দিচ্ছে যে এই কথাটা আপনি আগেও বলেছেন, ততক্ষণ কি বুঝতে পারেন না?
৯। যেই কাজগুলো ধাপে ধাপে করতে হয়, সেগুলো করতে গিয়ে কি সবসময় ভুলে যান যে আপনি কোন ধাপে আছেন?
আমাদের মাঝে অনেকেই আছে যারা নামাজ পড়তে গিয়ে প্রতিবারই ভুলে যায় কোন রাকাতে আছি। একবার-দুবার অন্যমনস্কতার কারণে ভুল হতে পারে। কিন্তু এটা কি আপনার বারবার হচ্ছে?
১০। চোখে চশমা রেখেইই প্রতিনিয়ত চশমা খুঁজে বেড়ান? যতক্ষণ না কেউ ধরিয়ে দিচ্ছে যে চশমা আপনার চোখেই, ততক্ষন কি নিজে থেকে বুঝতেও পারছেন না?
কিংবা ছাতা ব্যাগে ভরার পরে কি পুরো বাসায় ছাতা খুঁজছেন এবং ব্যাগ খোলার আগ পর্যন্ত টেরও পাচ্ছেন না?
১২। কিছু একটা করতে গিয়ে দিব্যি ভুলে গিয়ে অন্য কিছু করা শুরু করে দিয়েছেন?
১৩। কাউকে ফোন দিয়ে রিং শুনতে শুনতেই কি ভুলে গেছেন যে কাকে ফোন দিয়েছেন?
১৪। আপনার নোটপ্যাড, যেখানে দৈনন্দি টু-ডু লিস্ট রাখেন, সেটা হারিয়ে গেলে কি আপনি অকেজো হয়ে পড়বেন?
উপরের বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর-ই যদি আপনার ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে, তবে আপনি এডিএইচডিতে ভুগছেন।
এডিএইচডি(ADHD) কী?
ইংরেজিতে এডিএইচডি বলতে বোঝায় Attention deficit hyperactivity disorder।
এটি এক ধরনের সাধারণ মানসিক ব্যাধি যেটায় আক্রান্ত মানুষদের মাঝে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা যায়।
১। তারা অনেক কিছুই সহজে ভুলে যায় এবং কোথাও কখনো সময়মতো পৌঁছাতে পারে না।
২। দুশ্চিন্তা।
৩। নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা।
৪। রাগ সামলাতে অপারগতা।
৫। যেকোন কাজে সমস্যার সম্মুখীন হওয়া।
৬। অত্যধিক আবেগপ্রবণতা।
৭। অগোছালো জীবনযাপন।
৮। অলসতা।
৯। হতাশা।
১০। সহজেই একঘেয়েমি মনোভাব চলে আসা।
১১। পড়ার সময় মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
১২। সম্পর্ক ধরে রাখতে সমস্যার সম্মুখীন হওয়া।
এডিএইচডি কেন হয়?
এডিএইচডিতে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন:
১। এডিএইচডি অনেক সময় জেনেটিকালি হয়। বংশে কারো এডিএইচডি থাকলে তা পরবর্তী প্রজন্মেও হতে পারে।
২। মস্তিষ্কের গঠনের জন্য এডিএইচডি হয়ে থাকে। এডিএইচডিতে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের যে অংশ মনোযোগের পেছনে কাজ করে, তা অন্যদের তুলনায় কম সক্রিয় হয়। তাদের মস্তিষ্কে কিছু কেমিক্যাল ইমব্যালেন্সও থাকে।
৩। মস্তিষ্কে কোনো প্রকার আঘাত
৪। জন্মের সময় পরিপূর্ণ পুষ্টি না পেলে কিংবা খুব কাছের কেউ ধূমপান করলে
আমাদের দেশে যে এই ধরনের কিছু পাত্তাই দেওয়া হয় না। অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে এ প্রজন্ম — এমন হাস্যকর অভিযোগও তোলা হয়। উল্লেখ্য, প্রযুক্তির ব্যবহারে এডিএইচডি হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং প্রযুক্তির ব্যবহারে আপনি এর সম্পর্কে ভালোমতো জানতে পারবেন।
এডিএইচডি থেকে পরিত্রাণের উপায়
দুঃখজনক হলেও সত্যি, এডিএইচডি থেকে সারাজীবনের মতো পরিত্রাণ সম্ভব নয়। তবে কিছু বিষয় মেনে চললে এডিএইচডি নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়। যেমন:
১। ফুড কালার এবং প্রিজার্ভেটিভ ব্যবহৃত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকলে আপনার মনোযোগ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আপনি সহজেই কোনো কিছু ভুলবেন না। আপনি প্রয়োজনীয় জিনিসও গোছাতে পারবেন সুন্দর করে।
যেই খাবারগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো তাদের মাঝে কার্বোনেটেড বেভারেজ, সফট ড্রিঙ্কস কিংবা প্যাকেটজাত জুস, আইসক্রিম, জেলাটিন, প্যাকেটজাত দই, সিরিয়াল এবং ব্রেডক্রাম্ব উল্লেখযোগ্য।
২। ফলমূল বেশি করে খেতে হবে।
৩। যোগব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন। যোগব্যায়াম সহজে মনে রাখতে এবং মনোযোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৪। বাইরে ঘুরে বেড়ান। প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকলে অনেক রকমের অসুখের মতো এডিএইচডিও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৫। কফি পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। কফিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন থাকে যা এডিএইচডিকে নিয়ন্ত্রনে রাখে।
৬। জিঙ্ক, এল-কারনিটাইন, ভিটামিন বি-৬ এবং ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার এডিএইচডি নিয়ন্ত্রণে খুব উপকারী।
সবসময় মনে রাখা প্রয়োজন যে মানসিক যেকোনো অসুস্থতা শারীরিক অসুখের মতোই স্বাভাবিক। একে নিরাময় করতে প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে যেতে কিংবা ঔষধ খেতে লজ্জার কিছু নেই।
প্রথমেই এডিএইচডিতে আক্রান্ত দুজন সফল মানুষের গল্প বলে নেওয়ার কারণ এই যে, এডিএইচডিতে আক্রান্ত হলে মনে রাখা প্রয়োজন যে এডিএইচডি সামান্য একটা মানসিক সমস্যা। একে কখনো এতো প্রাধান্য দেবেন না যাতে করে এটা আপনার সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমাদের আশেপাশের, অনেক কাছের মানুষের মাঝেই এডিএইচডি আছে। তা নয় কি? অনেক সময়ই আমরা বিরক্ত হই যে বারবার বলার পরেও তারা অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছে। কিংবা বারবার এক কথা কেন বলে কিংবা এতবার বলার পরেও কেন বুঝতে পারছে না।
বিরক্ত না হয়ে বরং একটু তাদের সাথে মানিয়ে চলা প্রয়োজন, কারণ এডিএইচডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের মনোযোগের সমস্যার কারণেই হীনমন্যতায় ভোগে। আমাদের কারণে যেন তা বেড়ে না যায়।