‘উইমেন ইন আর্টস, বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রচেতা অহনা আলম একজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাও। সম্প্রতি ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের গল্প নিয়ে মিউজিক ভিডিও “কালো” তৈরি করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
টিডিএ-এর ডিরেক্টর রাহিন আমিন কথা বলেছেন তার সাথে। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার নিজস্ব জগৎ, শিল্প, সমাজসহ অনেক কিছু। প্রথম পর্বে তিনি কথা বলেছেন তার নিজের জীবন নিয়ে, শুনিয়েছেন “কালো” বানানোর গল্প।
রাহিন: প্রচেতা, আমরা আপনার গল্পটা শুনতে চাই। ফিল্ম বানানোর ঝোঁকটা মাথায় ঢুকলো কিভাবে? নিজেকে গড়ে তোলার গল্পটা, পরিবারের কতটুকু সমর্থন পেয়েছিলেন?
প্রচেতা: আমি ফিল্ম বানানো শুরু করি ১৫ বছর বয়স থেকে। তবে আমি ফিল্ম বানানোর চিন্তা করতাম ১৩-১৪ বছর বয়স থেকেই। ২০১৩ সালে আমি আমার প্রথম চলচ্চিত্র বানাই। কিন্তু আমি লেখালেখি শুরু করি ১২ বছর বয়স থেকে। আমি গান শেখা শুরু করি ৫ বছর বয়স থেকে, ১১ বছর ধরে গান শিখেছি। আমি ছবি আঁকা শেখাও শুরু করি ৫ বছর বয়সে। আমার সবসময়ই সৃষ্টিশীল কাজ করার একটা জায়গা ছিল।
আর এই কাজগুলোতে সাপোর্ট আমার পরিবারই দিতো। আমার ক্যারিয়ারে আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্ট আমার ফ্যামিলিই। আমার জীবনে ঐ ক্লিশেটা নেই যে আমার পরিবার আমার আর্টস্ ক্যারিয়ারে সমর্থন দেয় না।
আমার পরিবার যদি এই ক্রিয়েটিভ কাজগুলো করতে আমাকে সমর্থন না দিতো, তাহলে আমি যে চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়েছি বা চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে শুরু করেছি সেটা কখনোই হতো না। কারণ চলচ্চিত্র হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যেটা সবগুলো মাধ্যম মিলিয়ে তৈরি হয়। গান শেখা, ছবি আঁকা, লেখালেখি, বই পড়া – সব দক্ষতাই একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে লাগে।
যদি এই ভালো ক্রিয়েটিভ ভিত্তিটা আমার না থাকতো, যাকে বলা যায় একটা ‘সলিড আর্টিস্টিক বেইজ’, সেটা না থাকলে আমি যা হতে পেরেছি তার অর্ধেকও হতে পারতাম না।
রাহিন: অর্গানাইজিংয়ে মন দিলেন কবে থেকে? নিজস্ব প্রজেক্টগুলো নিয়ে কাজ শুরু করা কবে থেকে, আমরা Women in Arts, Bangladesh এবং Whiny Women নিয়ে শুনেছি। এগুলোর ব্যাপারে জানতে চাই।
প্রচেতা: সবসময়ই আমি কোনো না কোনো সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত ছিলাম। সেগুলো নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করা শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একটা কমিউনিটি ছিলো। যাদের সাথে আমি চলতে পারতাম, একসাথে কাজ করতে পারতাম। আমার একটা দারুণ টিম ছিল কাজ করার জন্যে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর, আসলে ড্রপ আউট হওয়ার পর, আমি যখন পেশাদার কাজ করতে শুরু করি, এই কমিউনিটিকে আমি অনেক মিস করেছি। আমার কাজের জায়গায় কোনো কমিউনিটি ছিলো না, এবং সে কারণেই Women in Arts তৈরি করা। একটা কমিউনিটি, একটা নিরাপদ স্পেস আরকি।
বিশ্ববিদ্যালয়েই বলতে গেলে আমার চলচ্চিত্র বানাতে আগ্রহী মানুষদের সাথে প্রথম পরিচয়। আমার প্রথম প্রোডাকশন টিমের শুরুও সেখানেই – ‘টু মাইন্ডস প্রোডাকশন’। পরে আস্তে আস্তে কিভাবে দলের অংশ হয়েও কীভাবে নেতৃত্বের ভার সামলাতে হয় – এসব শিখেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শিখতে যাওয়া, তা বাদে অন্য সবই শিখেছি(হাসি)! সেখান থেকে বের হওয়ার পর আরেকটা কমিউনিটির জন্যেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সূচনা।
রাহিন: কালো দিয়ে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের গল্প বলার যেই প্রচেষ্টা, এর শুরুটা কীভাবে? দল কিভাবে গড়ে উঠলো, শ্যুটিং থেকে শুরু করে পোস্ট প্রডাকশন, পুরো গল্পটাই আমরা জানতে চাই। এই মিউজিক ভিডিওতে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের নিয়ে গল্প বলার পিছে আপনাদের অনুপ্রেরণা কী ছিল?
প্রচেতা: আমার শর্টফিল্ম চুল-এর ফান্ডরেইজার হিসেবে আমি কালো বানানোর সিদ্ধান্ত নেই। চুল-এ আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার মেইল এবং একজন নারীর বন্ধুত্বের গল্প বলার চেষ্টা করেছি। ট্রান্সজেন্ডার পুরুষদের গল্প বাংলাদেশে খুব বেশি বলা হয় না। আমারও অনেক বন্ধু আছে, যারা ট্রান্সজেন্ডার পুরুষ। এই গল্প আমার জীবন থেকেই নেয়া।
কালো-ও একটা সত্যি গল্পের ভিত্তিতে তৈরি। আমার এক বন্ধুর বাবা একজন ট্রান্স নারী ছিলেন। দুটো গল্পই আসলে আমার চেনা মানুষদের জীবন থেকে নেয়া। আমি যখন কালো দেখি, আমি আমার এবং আমার পরিবারের মধ্যে বন্ধনটা দেখতে পাই। আমার বাবা হিজড়া না হলেও একই কনট্রোলিং মানসিকতা নিয়ে চলেন, তিনিও নিজের হতাশা অনেক সময় আমার উপর ঝাড়েন। তাই এই গল্পটা বলতে আমার একজন হিজড়া হওয়া জরুরি না। এখান থেকেই কালো বানানোর অনুপ্রেরণা এসেছে। আমি অনেক মানুষের গল্প শুনেছি। আমার মনে হয়েছে এসব গল্প বলার প্রয়োজন আমাদের সমাজে আছে। তাই বলেছি।
রাহিন: বানানোর পুরো গল্পটা?
প্রচেতা: কালো গানটা আমার কাজিন প্রগোতা নাওহা লিখে। ওকে চুল-এর ব্যাপারে বলার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় এই শর্ট ফিল্মের জন্য একটা অরিজিনাল সাউন্ডট্র্যাক লিখে দিবে। সে কালো লিখে দেয়ার পর আমার মনে হলো এই গানের একটা আলাদা মিউজিক ভিডিও থাকা উচিৎ।
ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি সালমান সাদি প্রগোতার সাথে আগে কাজ করেছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নেই সে ডি.ও.পি হবে। এসিসট্যান্ট ডিরেক্টর যারা ছিল সবাই আমার আগের বন্ধু। খুব সহজেই আমরা কাজটা শেষ করেছি।
পুরো শুটিংটা একদিন ছিলো। সকাল ছয়টা থেকে রাত বারোটা আমরা টানা শুটিং করলাম। অনেক ঝামেলা হয়েছে, ক্যাবলগুলো কাজ করছিলো না, মেমোরি কার্ড রিডার নষ্ট ছিল। মনিটর ছিলো না বলে আমার নির্দেশনা দিতে কষ্ট হচ্ছিলো। মনিটর কেনার টাকা ছিলো না। তখন সালমান আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। ওকে আসলে আমি কো-ডিরেক্টরই মনে করি।
বাবার চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তাকে খুঁজে পাওয়ার গল্পটা মজার। অভিনেত্রীর নাম নীল। নীল নিজেও একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। আমার একজন বন্ধুর মাধ্যমে তার সাথে পরিচয়। আসলে আমার ভাগ্য ভালো ছিলো। একটা ইভেন্টে অংশ নিতে গিয়ে নীলকে খুঁজে পেয়েছিলাম আমি।
রাহিন: রিলিজের পরে কী হলো? কোথায় কোথায় পুরস্কারের জন্যে মনোনয়ন পেয়েছেন? এতগুলো পুরস্কার, এত প্রশংসা – আপনি এবং আপনার দল সামলে উঠলেন কীভাবে?
প্রচেতা: রিলিজের পরে আমি কয়েকটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমাদের মিউজিক ভিডিওটা পাঠাই। কয়েকটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আমাদের কাজ এতো পছন্দ করে যে তারা আমাদের বিনা ফি-তে আবেদন করতে দেয়। সেটা দেখে অনেকগুলো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমরা আবেদন করে বসি, অনেকগুলো পুরস্কারও পাই। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুই আমার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
যেটা আমাকে সবচেয়ে আনন্দ দিয়েছে, রিলিজের পর পুরোটা দেখে আমাদের সামনের সিটগুলোর প্রায় সবাই কেঁদেছে। আমি একেবারে অচেনা মানুষদের দেখেছি এই মিউজিক ভিডিও দেখে কাঁদতে। পুরো বিষয়টা আসলে আমার চিন্তাভাবনাই বদলে দিয়েছে।
আগে আমি ডেডলাইনের কথা চিন্তা করে কাজ করতাম। এখন আমি অনুভূতির কথা চিন্তা করে কাজ করি। সত্যের কথা চিন্তা করে কাজ করি। এখন আমি সেই শিল্প তৈরি করতে চাই যেটা মানুষের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
রাহিন: কালো-র মতো সামাজিক ট্যাবু নিয়ে আর কী কী কাজ করেছেন আপনি?
প্রচেতা: আমার পরের প্রজেক্টে আমি সামাজিক মানদন্ড মেনে চলার বাধ্যবাধকতা কিভাবে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, এটা নিয়ে কাজ করছি। আরেকটি বাংলাদেশী ইন্ডি ব্যান্ড আমার সাথে আছে। আমার স্ল্যাম-জেতা কবিতা, The Indiscriminate Sun বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজে কতটা বিশাল স্থান জুড়ে আছে, সেটার কথা বলে। এই কবিতাটি নিয়ে আমি একটি শর্ট ফিল্মও বানাবো ঠিক করেছি। “Whiny Women”, আমার একটি আর্ট এক্সহিবিশন মূলত নারীদের ঘিরে যত ট্যাবু আছে সে ব্যাপারে ছিলো। আর কালো তো আছেই, যেটা একজন ট্রান্সজেন্ডার পুরুষের গল্প বলে।
ইন্টারভিউ পর্ব দুই-এর লিংক : https://thisistda.net/prachetainterview02/