ভিন্নমতের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার দোষ সিস্টেমের, শিল্পের নয়: প্রচেতা অহনা

Editor
10 Min Read

‘উইমেন ইন আর্টস, বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রচেতা অহনা আলম একজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাও। সম্প্রতি ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের গল্প নিয়ে মিউজিক ভিডিও “কালো” তৈরি করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

টিডিএ-এর ডিরেক্টর রাহিন আমিন কথা বলেছেন তার সাথে। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার নিজস্ব জগৎ, শিল্প, সমাজসহ অনেককিছু। দ্বিতীয় পর্বে তিনি কথা বলেছেন সামাজিক ট্যাবু ভাঙার ক্ষেত্রে শিল্পের অবদান নিয়ে, উঠে এসেছে এই প্রজন্মের শিল্পীদের দোষ-গুণ।   

ইন্টারভিউ পর্ব এক-এর লিংক: https://thisistda.net/prachetainterview01/

 

রাহিন: প্রচেতা, একটু আগে কালো-র গল্প শোনাতে গিয়ে জানালেন, আগে ডেডলাইনের কথা চিন্তা করে কাজ করতেন। এখানে একটা প্রশ্ন করতে চাই।

গণমানুষের চাহিদা কিংবা চাকরির প্রয়োজনে তৈরি শিল্প এবং নিজের অনুভূতিচালিত শিল্পের মাঝে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?

অনেক শিল্পীকেই চাকরির প্রয়োজনে ডেডলাইন মাথায় রেখে অনেক কিছু তৈরি করতে হয়। টাকার প্রয়োজনে তৈরি শিল্প কি স্বকীয়তার রঙ হারায়?

প্রচেতা: সৃষ্টিশীল কাজে এসব কারণে অনেক বাধা তৈরি হয়। কিন্ত পুরোপুরি টাকার জন্য করা হয়, এমন জিনিসকে আমি শিল্প বলব না। এটা মার্কেটিং, এবং মার্কেটিং একেবারেই ভিন্ন বিষয়।

রাহিন: একজন শিল্পী হিসেবে সামাজিক ট্যাবু ভাঙার ক্ষেত্রে শিল্পের অবদান কতটুক বলে আপনি মনে করেন?

প্রচেতা: আমার মনে হয় শিল্প ট্যাবুর বিরুদ্ধে কতটা অবদান রাখতে পারে কিংবা কতটুকু কার্যকর, সেটা মাপার কোনো উপায় আমাদের নেই। তবে শিল্প এবং সংবাদমাধ্যম, এই দুটো ছাড়া কিন্তু পৃথিবীর সামষ্টিক রেকর্ড রাখার কোনো মাধ্যম নেই। এবং আমাদের চিন্তাভাবনা কোনদিকে যাচ্ছে, তাতে কী কী সমস্যা দেখা দিচ্ছে – সেটা বোঝার জন্য এই সামষ্টিক রেকর্ডের বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না।

রাহিন: সামাজিকভাবে অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্যে কাজ করা কি একজন শিল্পীর দায়িত্ববোধের মাঝে পরে? এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন?

প্রচেতা: একজন শিল্পীর দায়িত্ব শিল্পের মাধ্যমে সত্য প্রকাশ করা। যদি তাদের সত্য অধিকারবঞ্চিত মানুষদের ব্যাপারে হয়ে থাকে, তবে সেটাই তার দায়িত্ব।

রাহিন: তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে, প্রতিটি মানুষের একটি আলাদা সত্য আছে। এবং তারা সেই সত্য প্রকাশ করে নিজস্ব শিল্প তৈরির মাধ্যমে, তাই তো?

প্রচেতা: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।

রাহিন: তবে আপনার নিজস্ব সত্যের ব্যাপারে বলুন। যেই সত্য আপনাকে শিল্প তৈরিতে অনুপ্রাণিত করে।

প্রচেতা: আমার সত্য বহুমুখী। আমার তীব্র অনুভূতি এটাকে চালনা করে। আমার মধ্যেই অনেক কিছু আছে যে ব্যাপারে আমি এখনো জানি না, বুঝে উঠতে পারি না। তা খুঁজতেই আমি শিল্পের আশ্রয় নেই। এটাই আমার ফিল্ম-মেকিংয়ের পেছনে কাজ করে।

অনেক সময়ই আমার শিল্প আমার নিজের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একটা পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়। কালো  আমার টিনএজ জীবনের অনেক উত্তর খুঁজতে সাহায্য করেছে। আমি যেভাবে বড় হয়েছি, যত কষ্ট পেয়েছি, সেগুলোর কোনো ব্যাখা আমার কাছে ছিল না। কালো-তে বাবা-মেয়ের যেই সম্পর্কের ডাইনামিক আমি দেখাতে চেয়েছি, সেটি আমার নিজের অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সাহায্য করেছে।

সামাজিক একটা ট্যাবু নিয়ে কাজ করেছি সেটা সত্যি, কিন্তু কালো  মূলত আমার কাছে একটা বাবা-মেয়ের সম্পর্কের গল্প ছিল। তাদের মিলনের মধ্যে দিয়ে মনে হয়েছে আমি নিজের ভেতরের একটা সত্যকে খুঁজে পেয়েছি।

রাহিন: একজন শিল্পীকে বিচার করার ক্ষেত্রে তার সামাজিক দায়বদ্ধতা পূরণের জায়গাটিকে কতটুকু মূল্য দেয়া উচিত? একজন খুবই গুণী শিল্পী, যদি সামাজিক ট্যাবু কিংবা সমাজের অনাচারের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলে – সেটা কি তার সমালোচনার কারণ হওয়া উচিত? কিংবা সমাজের জন্যে দিনের পর দিন কাজ করে যাওয়া একজন শিল্পীর অতিরিক্ত প্রশংসা পাওয়া কি প্রাপ্য?

প্রচেতা: আমি মনে করি, একজন মানুষ কিভাবে শিল্প তৈরি করল, কিংবা শিল্পে অবদান রাখল, পুরোটাই তাদের উপর নির্ভর করে। যদিও, কোন শিল্প যতই দুর্দান্ত, আনকনভেনশনাল কিংবা সৃষ্টিশীল হোক না কেন, সেটা যদি আজকের পৃথিবীর ব্যাপারে কিছু না বলে, আমি সেটার সাথে নিজের মানসিকতাকে মেলাতে পারি না।

রাহিন: আজকে ট্রান্সফোবিয়া, হোমোফোবিয়া এবং বাইফোবিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য ঘোষিত আন্তর্জাতিক দিবস। একজন শিল্পী হিসেবে বাংলাদেশের এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির বর্তমান অবস্থা কেমন বলে আপনার মনে হয়?

প্রচেতা:  ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের নিয়ে আমাদের যেই ভয়, বা ট্যাবু – তাতে মারাত্মক অগ্রগতি এসেছে। সে কারণেই আমার কালো  মানুষ গ্রহণ করেছে। কিন্তু ‘বাইফোবিয়া’ এবং ‘হোমোফোবিয়া’ দূর করতে আমাদের এখনো অনেকদূর যেতে হবে। আমাদের কমিউনিটিতেই আমি অনেক উভকামী এবং সমকামী মানুষকে চিনি, যারা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে ভয় পায়। এমনকি নিজের বাবা-মার কাছেও সত্যি কথাটা তারা বলতে পারে না। নিজের জেন্ডার ফ্লুয়িডিটি নিয়ে কথা বলতে আমারও অস্বস্তি বোধ হয়। সম্ভবত এ ব্যাপারে নিজেকে প্রকাশ করতে আমি শিল্পের সাহায্য নিই।

বাংলাদেশ LGBTQ কমিউনিটির জন্য তো নিরাপদ-ই না। বৈষম্য কমানোর ব্যাপারে কাজ করতে তো আমাদের এখনো অনেক দেরি।

রাহিন: ট্যাবু সাধারণত একটা সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট, একটি সামাজিকভাবে তৈরি বিষয়। বাংলাদেশের সমাজে এলজিবিটিকিউদের বিরুদ্ধে ট্যাবু, মৌলবাদীদের হুঙ্কার পেরিয়ে যেই আন্দোলন গড়ে উঠার চেষ্টা চলছে, সেখানে শিল্পীরা এবং মিডিয়াকর্মীরা কতটুকু অবদান রাখতে পারে? সেই অবদান রাখতে আমাদের শিল্পসমাজ কতটুকু সফল?

LGBTQ-দের প্রতি অত্যন্ত কঠিন এই সমাজে তারা কি কথা বলার যথেষ্ট প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে? বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে তাদেরকে কতটুকু স্থান দেয়া হয়?

প্রচেতা: শিল্প এবং মিডিয়া সেই জায়গা যেখানে আমরা নিজেদের খুঁজতে যাই। অন্যদের বুঝতে যাই। শিল্প এবং সংবাদমাধ্যমে যা আসে, সেটাই দিনশেষে ‘নর্মাল’-এ পরিণত হয়। আমরা সেটাকেই গ্রহণযোগ্য ভাবি, যেটাকে আমরা শিল্পে দেখি। তাই শিল্প এবং মিডিয়া দুটোই দারুণ সব বদল আনার ক্ষমতা রাখে। যদিও আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এখন সেই জায়গায় নেই যে আমরা কোনো বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ধারণ করব। আমাদের সেই ম্যাচিউরিটি এখনো আসে নি। আমার মনে হয়, LGBTQ কমিউনিটির মানুষেরা মিডিয়ায় প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার আশা করবে – এমন সময় এখনো আসে নি। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের জীবনযাত্রা সরকারি কোন স্বীকৃতি না পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মেইনস্ট্রিমে তাদের জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

রাহিন:  আমরা কি একটি সমাজ হিসেবে এগোনোর বদলে পিছিয়েছি? ভিন্ন মতের প্রতি, আনকনভেনশনালের প্রতি আমরা আরো অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি?

৮০’র দশকেও আমাদের আহমদ শরীফ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো কবি এবং বুদ্ধিজীবী ছিল। রুদ্র সেই যুগে ধর্মকে হেমলক বিষের সাথে তুলনা করেও মোটামুটি নিরাপদ একটি জীবন কাটিয়েছেন। তসলিমা নাসরিন ছিলেন, যাকে পরে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়।

গত ২০ বছরে সমাজ হিসেবে আরো রক্ষণশীল হয়ে পড়ার বিষয়টি যদি সত্যি হয়, তবে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কি তাদের উদারপন্থা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন? যেই লিবারেল চিন্তাচেতনার আন্দোলনে মিডিয়া এবং শিল্প নেতৃত্ব দিয়ে থাকে, সেই নেতৃত্ব দিতে কি আমরা ব্যর্থ হয়েছি?

প্রচেতা: আমার মনে হয় সময় বদলে গেছে। মানুষ ভায়োলেন্সের মাঝে ঢুকে পড়েছে, তাদের মাঝে আগ্রাসী চিন্তাভাবনা ঢুকে গেছে। আমাদের সিস্টেম আরো কতৃত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে, অথোরেটারিয়ান হয়ে গেছে। যদিও এই কথা বলা প্রচণ্ড ভুল হবে যে আমরা একদমই এগোই নি। হিজড়াদের এখন আগের থেকে অনেক বেশি অধিকার আছে।

দোষটা আসলে বুদ্ধিজীবীদের নয় কিংবা শিল্পীদের নয়। আমার মনে হয় সমস্যাটা সিস্টেমে, যেটা মানুষের মাঝে ভয় ছড়িয়ে দেয়। আমাদের উদারপন্থার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভিন্ন মতের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারার দোষটা সিস্টেমের, শিল্পের নয়।

রাহিন: এই জেনারেশনের একজন আর্টিস্ট হিসেবে, আপনি আমাদের প্রজন্মের শিল্পীদের সাথে আগের প্রজন্মের শিল্পীদের কাজে কী মৌলিক পার্থক্য দেখতে পান?

প্রচেতা: প্রযুক্তির একটি বিশাল অবদান এখন আমাদের কাজে আছেই। এখন আমি যেভাবে আমার শিল্প বানাই সেভাবে আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষেরা করতে পারতেন না। যেমন, কালো  রিলিজের সময় আমার কোনো পেপারওয়ার্কের মাঝে দিয়ে যাওয়া লাগে নাই। কোনো গাইডলাইন, সেন্সরশিপ, কোনো ঝামেলা হয় নি শুধু ইন্টারনেট থাকাতে। এত ছোট বয়সেই ফিল্ম বানাতে পারার পিছনে এটিও একটি বড় কারণ। আগে তো এগুলো ছিল না।

রাহিন: আমাদের মানে আমাদের প্রজন্মের যারা আছি, আমরা কি আমাদের কাজ নিয়ে গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছি? আমরা আমাদের শিল্পে যে ভাষায় গল্প বলার চেষ্টা করি, সেই ভাষার সাথে দেশের মেজরিটি কি নিজেদের মেলাতে পারেন?

যেমন, এই প্রজন্মের আগে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন। যিনি মানুষকে দিয়ে বই পড়িয়েছেন। শুধু তার বই নয়। পুরো একটা প্রজন্মকে তিনি শিল্প এবং সাহিত্য দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। আমাদের তো কোনো হুমায়ূন আহমেদ নাই।

আমরা কি এই জায়গাটি পূরণ করতে পারছি? এই যে মানুষকে শিল্পের দিকে টেনে আনা, দেশের সাধারণ মিডল ক্লাসের কাছে নিজেদের কাজ নিয়ে পৌঁছানো, এটা কি আমরা পারছি? বা এখন না পারলেও, সামনে কি পারব?

প্রচেতা: এই প্রশ্নের জবাব দেয়া আসলে কঠিন, কারণ আমরা তো ভবিষ্যতে কী হবে সেটা জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় অনেক নতুন শিল্পী উঠে আসছেন, এদেরকে তুলে আনতে হবে। আরেকজনের জায়গা পূরণ করতে পারব নাকি সেটি আসলে আমার বিচার করার বিষয় না।

রাহিন: কিন্তু একটি জেনারেশন হিসেবে, শিল্প তৈরির যে সাধারণ একটি ট্রেন্ড আমরা তৈরি করছি, বা যেভাবে শিল্পীরা কাজ করছেন, এর মাঝে আপনি কি মৌলিক কোনো ভুল খুঁজে পান?

প্রচেতা: আমার প্রজন্মের শিল্পীরা অনেক বেশি ট্র্যাশ মিডিয়া তৈরি করে। যেগুলো আপনাকে ভাবার বদলে একটা অন্য জগতে নিয়ে যায়। আসল সমস্যাগুলোর থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।

তবে আমার মনে হয় এটা হচ্ছে কারণ আমাদের ঝুঁকি নেয়ার কোনো পরিবেশ নেই। তাই আমরা চ্যালেঞ্জিং শিল্প, প্রতিবাদী শিল্প তৈরি করতে পারি না। সত্যের পথে ছুটতে হলে যেই ঝুঁকি নেয়ার পরিবেশ দরকার সেটাই আমাদের নেই।

 

Share this Article
Leave a comment