আদনান সহিদ
২০২০ সালের শুরু থেকেই পৃথিবী এক নিস্তব্ধ ও আতঙ্কিত সময় পার করছে। করোনা নামের এই সংকট কার্যত আমাদেরকে গৃহে বন্দি করে রেখেছে। একে আমরা ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ কিংবা ‘লকডাউন’ যে নামেই ডাকি না কেন, সামাজিক, আর্থিক, ধর্মীয় ও পেশাগত জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থেকে সবাই আসলে বাসায় বসে এই সংকট অবসানের দিন-ই গুনছে।
শুধুই কি দিন গুনছে? সবাই তো নানাভাবে এই দিন পার করারও চেষ্টা করছে। কিন্তু কে ঠিক কীভাবে এই অবসাদপূর্ণ দিনগুলি পার করছে?
এই প্রশ্নের খুব দ্রুত, সহজ ও সাবলীল উত্তর দিতে পারে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার। করোনাবদ্ধ সময়ে দিন কাটানোর নানা উপায়, সামাজিক মাধ্যমে মানুষের শেয়ার করা অভিজ্ঞতা এবং একই সমান্তরালে মানবদেহের সুস্থতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
করোনাকালীন গৃহবন্দি একদল বই পড়ছেন। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা ও টেকনোলজি-নির্ভর স্মার্ট বিশ্বের বাসিন্দাদের পক্ষে বই পড়ার সময় বের করা হয়ে ওঠে না বললেই চলে। সুযোগের অভাবের যেই অজুহাত দিয়ে আমরা বই পড়া এড়িয়ে যাই, এই কোয়েন্টাইনে সেই সুযোগ নেয়ার সুযোগ নেই। তাই প্রিয় বই পড়ার পাশাপাশি চলছে বই নিয়ে রিভিউ লেখা, সামাজিক মাধ্যমে পছন্দের বইয়ের প্রচ্ছদ শেয়ার করার চ্যালেঞ্জ কিংবা প্রতিযোগিতা। মুভি এবং টিভি সিরিজও দখল করেছে এই অখণ্ড অবসর কাটানোর আরেকটি ব্যাপক জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে।
লিঙ্গ বৈষম্যের সীমানা উতরে নতুন নতুন রান্না শেখা এবং রান্না করার প্রতিযোগিতার পাশাপাশি দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমে সেগুলো শেয়ার করার ইচ্ছাও। গৃহস্থালির নানা কাজে অংশগ্রহণের ছবি কিংবা ভিডিও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই শেয়ার করে চলেছেন।
করোনা শেষে বের হয়ে কী করবেন, কোথায় ঘুরতে যাবেন, আড্ডা দেবেন, দাওয়াত খাবেন—এগুলোও রয়েছে প্রতীক্ষারত ভবিষ্যত ভাবনাচিন্তার অনেক বড় অংশ হিসেবে। কেউ কেউ আবার বৃক্ষপ্রেম, প্রাণীপ্রেমে মত্ত হয়েছেন। ক্ষুধার্ত ও অসহায়কে সহযোগিতায় হাত-পা মেলে মাঠে নেমেছেন অনেকেই।
সময় কাটাতে সৃজনশীল লেখালেখি, গান, কবিতা আবৃত্তি, হাস্যরসাত্মক বিষয়ের অবতারণা, সচেতনতামূলক লেখা, মিম, কৌতুক ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন, শেয়ার করছেন অধিকাংশ মানুষই। সেলিব্রিটি কিংবা জনপ্রিয় ব্যক্তিদের লাইভ চ্যাটে এসে আড্ডা কিংবা বন্ধুদের গ্রুপ চ্যাটে আড্ডাটা নিয়মমাফিক হয়ে উঠেছে। একদল সামাজিক মাধ্যমে শাড়ি বা পাঞ্জাবি পরা ছবি শেয়ার করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছেন অন্যদের, তো আরেক দল এবং গত পাঁচ বা দশ বছরে নিজেদের চেহারায় শারীরিক-মানসিক কী পরিবর্তন হয়েছে সেটা প্রদর্শন করেও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে মেতে আছেন।
এর মাঝে বিশেষ একদল মানুষ আবার বেশ চুপচাপ থেকে কিংবা অলস সময় কাটিয়ে এই করোনাকালীন বিপদে কী করা উচিত – কী নয়, কী শেয়ার করা উচিত – কী নয় ইত্যাদি বিষয়েও কথা বলছেন, আলোচনা-সমালোচনা করছেন।
প্রকৃতপক্ষে, এভাবেই গৃহবন্দী মানুষেরা সামাজিক মাধ্যমে অনেক কিছুই শেয়ার করার মাধ্যমে জেনে কিংবা না জেনে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার এক আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এসব কাজগুলো কিংবা এগুলোর বাইরেও যে যা-ই করে থাকুক না কেন, মনস্তত্ত্ববিদ্যার পরিভাষায় এগুলোকে ‘ডিফেন্স মেকানিজম’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। নিজের ভেতরের দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক কিংবা সংকট কাটানোর এক ধরনের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে এসব সময় কাটানোর জন্যে করা কাজ এবং কাজের বহিঃপ্রকাশগুলো। আরেকটু প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে একটি বিশেষ ডিফেন্স মেকানিজমের কথা উল্লেখ করা যায়। করোনাবদ্ধ সময়টায় আমরা পূর্বের স্বাভাবিক ও চমৎকার দিনগুলোর কথা বেশি বেশি মনে করছি, স্মৃতিগুলো, ছবিগুলো শেয়ার করছি। প্রতীক্ষায় আছি কখন আবার আগের দিনগুলোতে ফিরে যাব। ক্ষণিকের জন্য হলেও এটি ভেবে মানসিক শান্তি পাচ্ছি, চাপ মুক্ত হবার চেষ্টা করছি। মনস্তত্ত্ববিদ্যার ভাষায় এ ধরনের ডিফেন্স মেকানিজমকে বলা হয় রিগ্রেশন কিংবা প্রত্যাগতি।
আমরা সময় কাটাতে যে ধরনের ডিফেন্স মেকানিজমের আশ্রয়ই নেই না কেন, কাউকে এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা কিংবা কড়া সমালোচনা করা একেবারেই উচিত হবে না। যা করতে ভাল লাগে তাই করুন, চাইলে বই পড়ুন, খুনসুটি করুন, প্রার্থনা করুন, পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটান, ছবি তুলুন, স্মৃতিচারণ করুন কিংবা ইচ্ছা হলে যারা এগুলো করছে তাদের পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনাও করুন। এই আলোচনা-সমালোচনাও একটি জরুরি বহিঃপ্রকাশ। সব ধরনের মানসিক বহিঃপ্রকাশেরই এখন প্রয়োজন আছে। কারণ, দৈহিকভাবে করোনা আক্রান্তের দুশ্চিন্তায় লকডাইনে দিনের পর দিন গৃহবন্দী থাকতে থাকতে কমবেশি মানসিক চাপে পড়ে গেছে সবাই। এই ধরনের মানসিক চাপ থেকে অনেক বড় বড় মানসিক অসুস্থতাও গড়ে উঠতে পারে।
তাই কেবল দৈহিক নয়, এই মুহূর্তে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সবার মানসিক সুস্থতাও বেশ জরুরি। তবে মানুষের কাজের অতি কড়া সমালোচনা থেকে দূরে থাকাই ভাল। কারণ এ ধরনের সমালোচনাও অন্যদের উপর মানসিক চাপ তৈরি করে।
তাই আসুন, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারিংয়ে একে অন্যের ওপর বিরাগভাজন কিংবা বিরক্ত না হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত হই, প্রফুল্ল থাকি এবং নিজের কাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে অন্যকে উৎসাহ দেই। এটি আপনাকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে, দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে, ভেতরের রাগ-দুঃখ, কষ্ট দূর করতে সহযোগিতা করবে।
তবে গৃহে অবস্থান করতে ভুলবেন না যেন! বাসায় থেকেই আপনার কাজগুলো শেয়ার করুন এবং অহেতুক বিষয় যেমন গুজব বা ভিত্তিহীন খবর শেয়ার করবেন না।
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
হ্যাপি শেয়ারিং!
আদনান সহিদ লিখতে অণব ভালোবাসেন। শব্দেরা তার অকৃত্রিম বন্ধু, তার হয়েই কথা বলে। পাঠকেরা সে কথামালায় যোগ দিয়ে ‘বন্ধুমহল’ তৈরি করেন।