ফারিয়া রহমান
এরকম একটা ক্ষণজন্মা শুক্রবারের বিকেলবেলায় মেঘনা জানালার তীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। রাস্তার ওপারে কী একটা গানের স্কুল, বাচ্চারা বেশ আগ্রহে ছুটির এই দিনটাতে গলায় সুর তোলে, প্রস্তুতি নেয় একুশে ফেব্রুয়ারির।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?”
বাচ্চাদের একত্রিত কিন্নর কন্ঠ শুনতে মেঘনার বেশ ভালো লাগে। সে লীন হয়ে যায়। তার ভেতর থেকে খুব গোপনে কোন বিষাদময় ঢেউ হয়ে ভেসে আসে একটি মনোরম শিশুর মুখ।
মেঘনা জানালার গ্রীল আঁকড়ে ধরে শক্ত করে। মুহূর্তেই আবার হাত ছাড়িয়ে অবসাদগ্রস্থ পায়ে হেঁটে এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়ায়। ঘরভর্তি চন্দন কাঠের আগরবাতির ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে আত্মা হারায়, দুর্গতি ঘুঁচে যায়, ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যাবার জন্য বারবার করে তাড়া দেয়।
আচ্ছা, যেদিন তিস্তা মরে গেল পানিতে ডুবে, সেদিনও ঠিক এই আগরবাতিটাই জ্বেলেছিল না ওর ফুপু?
মেঘনা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। একটু পাশেই আধখোলা অবস্থায় কি অবহেলায়ই না পড়ে আছে ইলিয়াসের রচনাসমগ্রটা! ইচ্ছে হলেই ছোঁয়া যায়। কিন্তু ইচ্ছে নেই।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে সৈকত বরাবরই বেশ বাড়াবাড়ি করত। মাঝে মাঝে মেঘনার হিংসে হত খুব। “আচ্ছা, আমি যদি কখনো ইলিয়াসের চাইতেও ভাল লিখে ফেলি, তখন আমায় নিয়েও কি তুমি অমন হাত নাড়িয়ে, ভ্রু নাচিয়ে, শরীর ঝাঁকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমন আঁতলামি করবে?”
জবাবে সৈকত কিছু না বলে শুধু হাসত। সেই হাসি দেখেই প্রেমে পড়েছিল মেঘনা। নাকি কোন কবিতা? নাকি সমুদ্র পছন্দ বলেই সৈকতে জীবন বাঁধতে চেয়েছিল? কে জানে! তবে সবটাই খুব ঠিক ছিল। দারুণ ছিল। প্রতিবছর বইমেলায় যাওয়া, ইলিয়াসের জন্মদিন উদযাপন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে তিস্তার গানের স্কুলে প্রোগ্রাম।
মেয়েটা কেমন আবেগ দিয়ে গান গাইত। এত আগ্রহ দেখেই মাত্র চার বছর বয়সেই বাবা হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিল। তিস্তার সেদিন কী আনন্দ! প্রতি ভোরে আয়োজন করে রেওয়াজ করতে বসত। মেয়েটা কেমন বাড়ছিল চোখের সামনে। তিলে তিলে, চড়বড় করে। মাথা ঝাঁকিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলত।
“আমার ভাইয়ের অক্তে আঙানো…”
সৈকত মজা করে বলত মেয়ে নাকি মায়ের পেট থেকে রংপুরের এ্যাক্সেন্ট নিয়ে এসেছে। মেঘনা ওর মাথায় সরিষার তেল ডলতে ডলতে কণ্ঠে রাগী ভাব এনে সাধারণ বুলি আওড়াতো।
“কী সব বাজে বকো। সব সায়মার মায়ের দোষ। কাজ করবে কম, পান খাবে আর গল্প করবে বেশি। বেতন কেটে দিলেই খুব মজা হবে। কত করে বলি মেয়েটার সামনে একটু শুদ্ধভাবে কথা বল। শুনলে তো!”
সৈকত ব্যঙ্গ করে বলত মেয়ে যেন সায়মার মাকেই আবার মা না ডাকতে শুরু করে। এ কথার পর আমাদের কী হাসি! খুব অহেতুক ক্ষণজন্মা শুক্রবারের বিকেলবেলার হাসি। কে জানত সেই শুক্রবারের অহেতুক হাসি এই শুক্রবারের বিষাদ হয়ে বুকে পাথরের মত চেপে বসে থাকবে। অথচ কি দারুণভাবে সব পরিকল্পিত ছিল। তিস্তা বড় হয়ে গান গাবে, তারা দু’জন বড় হয়ে খুব লিখবে, খুব ঘুরবে, হয়তো কখনো সুযোগ পেলে ফিল্মও বানাবে।
মেঘনা কিছু ভাবতে পারে না আর। মেঘনার জীবনের নৌকা আটকে থাকে অন্য দুটো মানুষের জীবনের চরে। অথচ মেঘনা এমন কোন শুক্রবারে ঘরভর্তি অগোছালো বই আর ডিম খিচুড়ির কথা ভাবত। ভাবত গোসলহীন বিকেলের কথা, অর্থপূর্ণ যৌনতার কথা, অস্কারপ্রাপ্ত কোন সিনেমার কথা কিংবা তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে ভাতঘুমের কথা। সেসব ভাবনা আজ মৃত নক্ষত্রের মতো হারিয়ে গেছে। তিস্তা হারিয়েছে অন্য পৃথিবীর অন্য কোন এক মাত্রায়, আর সৈকত হারিয়েছে গভীর জনস্রোতের ভিড়ে। থেকে গেছে কেবলই মেঘনা। দেয়াল ভর্তি পিঙ্ক ফ্লয়েড এবং গডফাদারের পোস্টার, ফ্যামিলি ফটো, আর ঘরভর্তি গাদাগাদা অগোছালো বইয়ের মাঝে কেবলই আটকে গেছে সে নিজে।
“…আমি কি ভুলিতে পারি?”
বাচ্চাগুলো আবার শুরু থেকে গাইছে। মেঘনার শুনতে ভারি ভাল লাগে। অথচ সেই ভাল লাগাটা তাকে কেমন স্থবির করে দেয়। তিস্তা থাকলে সেও কি এভাবে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য প্রস্তুতি নিত না? নয় বছরের তিস্তার মুখ আট বছর পরেও মেঘনার কাছে ঠিক আগের মতই লাগে, স্বচ্ছ, টলটলে, বেশ জীবন্ত। সবকিছু বদলে গেছে, কিন্তু তিস্তার বয়স বাড়ে নি।
মেঘনা হাত বাড়িয়ে হেডফোন টেনে নিয়ে কানে জড়াল। পালাতে তো সেও চেয়েছিল। কিন্তু পারল আর কোথায়?
তাই একটা ফেব্রুয়ারিকে, একটা শুক্রবারের বিকেলকে অস্বীকার করে সে। নিজের সত্তাকে বিসর্জন দেয় নিজের মাঝেই।
কেমন একটা কষ্ট কষ্ট লেখা। ❤
OShadharon shundor lekha! <3