তাসনিম জারিন অধীরা
শুকতারাটা অনেক বেশি আন্ডাররেটেড।
সবার নজর থাকে পশ্চিম আকাশে থাকা চাঁদটার দিকে। অথচ তার একটু কাছ ঘেঁষে-ই কিন্তু শুকতারাটা থাকে।
চাঁদের সাথে থাকে রোজ। শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ – শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে থাকে। অমাবস্যায় চাঁদের দেখা না পেলেও পশ্চিমা আকাশে তাকে দেখা যায়। কিছুটা ধ্রুব, সমীকরণের ধ্রুবক পদের মতো। তার বুঝি অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু মহাশূন্যের বিশালতা দেখে সবকিছুকে তুচ্ছ লাগে তার।
মৃতপ্রায় খোলসে ঢাকা থাকলেও অতিসূক্ষ্ম শূন্যতা থেকে বেরিয়ে আসা আলোটাকে একদিন ঝকঝকে ক্রিস্টালের মতো মনে হয়। আবার আরেকদিন যেন সে কিছুটা ধুলোপড়া। আবার হলদেটে ভাবও দেখা যায়। যেন একেকদিন একেক আবরণের প্রকাশ। আচ্ছা, মানুষের মতো তারও কি অভিমান হয়?
তার ধ্রুবতার সত্য কারো চোখে পড়ে না। সবাই ঐ চাঁদকেই চায়। চাঁদটাই যেন সত্য, আর সে নিছক ধুলোপড়া পুরোনো শো-পিস।
আচ্ছা, যদি কোন এক প্যারালাল ইউনিভার্সে তার ধ্রুবতাই কাম্য হয় সকলের?
রোজ গোধূলি নামলে এই পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব ছাইপাঁশ ভাবি। আমি বেহুঁশের মতো শুকতারার দিকে তাকিয়ে থাকি, চায়ের পানি গরম হওয়ার ওই অল্প সময়টুকুকে তখন অনন্তকালের যাত্রা মনে হয়। চিন্তার বুদবুদগুলি টগবগিয়ে বের হওয়ার পথ খুঁজতে থাকে।
সেই চিন্তায় বিঘ্ন ঘটায় পাতিল হতে উপচে পড়তে চাওয়া গরম দুধ। পড়ার আগেই থামিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু তা করতে গিয়ে আমার চিন্তাগুলো ছায়াপথ ধরে এগোনোর আগে তেপান্তরের মাঠেই আটকা পড়ে যায়।
“আপনি কি রোজ এইভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন?”
রান্নাঘরের সাথেই প্রায় লাগানো পাশের বাড়ির ছাদটা। শহরের বাড়িগুলোর মাঝে এক হাত ফাঁকা পাওয়াটাই সৌভাগ্য। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পাওয়া যায় এমন দূরত্বে থাকা ছেলেটার কথা শুনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি।
দেখে মনে হচ্ছে ছাদে প্রায়ই উঠে, প্রায়ই আমাকে দেখে। আজ কোন এক বিশেষ কারণে কথা বলার চেষ্টা করছে।
“আপনি কি বিরক্ত হলেন আমার কথা শুনে?”
“নাহ্।”
“তাহলে উত্তর দিলেন না যে। রোজ এমনই করে তাকিয়ে থাকেন?”
“হ্যাঁ, তাকাই, প্রায়ই।”
“কিন্তু অমাবস্যার সময় তো চাঁদ থাকে না।”
“আমি শুকতারাটা দেখি।”
আমার কথায় ছেলেটা কোনো উত্তর দিল না। আমিও চায়ের কাপে চা ঢালতে প্রস্তুতি নিলাম।
“একদিন আমাকে এক কাপ চা খাওয়াবেন?”
কী অদ্ভুত ছেলে, এইভাবে কেন কথা বলে যাচ্ছে!
“পরিচয় থাকলে আশা করি খাওয়াতে পারব।”
“ভুল হয়ে গেল। আমি এখানেই থাকি, এভাবেই রোজ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।”
“চাঁদ দেখেন?”
“নাহ, অরিওন দেখি। অনেক সময় খুঁজে পাই না। তাও চেষ্টা করি। আর আপনার মতো নানা চিন্তা চোখে জমা হতে থাকে।”
ছেলেটা বুঝল কী করে?
“আমার এই বদ্ধ জানালা দিয়ে অরিওন দেখা যায় না।”
“একদিন ছাদে যাবেন, আমাকে জানাবেন, একসাথে খুঁজলে সহজ হবে।”
“আপনি আমার বাসার ছাদে কী করে আসবেন?”
“আকাশ তো সব ছাদের জন্যই এক, চলে আসব।”
“আচ্ছা, আমি এখন যাই।”
বাসায় আমি ছাড়া আর আম্মা থাকেন। চায়ের কাপ নিয়ে তার কাছে গিয়ে বসি। আম্মা এই সময়টা নিজেকে দেন। আব্বা যতদিন ছিলেন ততদিন এই সময়টা তারা দুজন একসাথে কাটাতেন। আমি মাঝে মাঝে তাদের সাথে বসতাম। যদিও বেশিরভাগ সময়ই নিজের ঘরে থাকতাম।
এখন আব্বা নেই তাই চেষ্টা করি সময় বেশি দেয়ার।
“কী ব্যাপার? আজ এতক্ষন লাগল চা বানাতে?”
ছেলেটার কথা বলব কিনা সেটা ভাবতে ভাবতে আম্মা আবার প্রশ্ন করে বসলেন।
“এত কী ভাবছিস?”
“নাহ্, কিছু না।”
আম্মাকে কি জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কে থাকে বাড়িটায়? আবার উল্টো কিছু না ভাবলেই হয়।
“আচ্ছা আম্মা, পাশের বাড়িটায় থাকে কারা?”
“কে আবার থাকবে?”
“মানে সেটাই, চিনেন আপনি কে থাকে? সবাই কি ভাড়াটিয়া?”
আম্মা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে কেন তাকিয়ে রইলেন বুঝলাম না।
“তুই কি আদৌ এই বাড়িতে থাকিস?”
“কেন?”
“তোর দেখি কিছুই মনে নেই। অবশ্য তুই অনেক ছোট ছিলি, মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। ”
“কী মনে নেই?
“পাশের বাড়ির বাড়িওয়ালার ছেলেটা ছাদে উঠত প্রায়ই। একদিন কী হল, শুনলাম ছেলেটা নাকি ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছে। আত্মহত্যা ছিল কিনা সেটা নিয়ে অনেক কানাঘুষা শুরু হল। পুলিশের কেসও হয় নি কীভাবে যেন।
এরপর পুরো পরিবারটা এলোমেলো হয়ে গেল, তারা বাড়ি ছাড়ল। ভাড়াটিয়াদেরও বিদায় করে দিল। এখন দু’জন কেয়ারটেকার বাদে আর কেউ থাকে না বাড়িটায়।”
আম্মার কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। একটা গুমোট বাতাস বুঝি জাপটে ধরছে আমাকে।
“তা তুই হুট করে জানতে চাচ্ছিস কেন?”
“নাহ্, এমনিতেই।”
“আচ্ছা।”
খালি চায়ের কাপ নিয়ে উঠে যেতে যেতে আম্মার কথায় থমকে দাঁড়ালাম।
“ছেলেটাকে একদিন দেখেছিলাম, কথাও হয়েছিল। চা খাওয়ার আবদার করেছিল আমার কাছে। খবরটা শুনে তাই বেশ খারাপ লেগেছিল সেদিন।”
“ছেলেটার নাম কী ছিল?”
“আকাশ।”
লেখালেখি তাসনিম জারিনের কল্পনা জগতের একটা ছোটখাটো প্রকাশমাত্র। সে আড়ালে থাকা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাধারণ জিনিস সবার সামনে তুলে আনার চেষ্টা করে এবং নিজেকে ‘চিত্রকল্পী’ হিসেবে আখ্যা দিতে পছন্দ করে।