ফারিয়া রহমান
২০২৫-এ একটা ট্রেনে করে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার সময়ে হঠাৎই মায়ের হাসি মুখটা মনে পড়ে গেল অপলার। স্মৃতিতে ভেসে উঠে আগের কথা। মা হাসছে, উজ্জ্বল মুখে ট্রে থেকে সেমাইয়ের বাটি সবার হাতে হাতে দিয়ে বসেছে খাটের এক কোণে। ইদের দিন সন্ধ্যাবেলায় ড্রয়িংরুমে সবাই টিভির সামনে বসা। বাবা, মা, বড় আপু আর ওর বাচ্চা দুটো এবং অপলা।
অপলা চমকে ওঠে। আশ্চর্য! এত কিছু থাকতে এই দৃশ্যটা মনে পড়ল কেন হঠাৎ? ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে একটা রোজার মাস পুরোটা চোখের সামনে সাঁইসাঁই করে চলে যায় অপলার। ধীরে ধীরে সব মনে পড়তে থাকে।
২০২০। লকডাউন চলছে। চাঁদ রাতের দিন সবার খুব মন খারাপ ছিল। তা দেখে মুষড়ে পড়েছিল অপলা-ও। সেবার ফাঁকা ঢাকা দেখা হবে না জেনে কি আফসোসটাই না হচ্ছিল। সবার মন খারাপের মাঝে একমাত্র সুখী ব্যক্তি ছিল মা। হাসি মুখে সবাইকে ইদ মোবারক জানাচ্ছে, বিটিভিতে যখন ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গান হচ্ছে, তখন সেও গুনগুন করছে।
অন্যান্য দিনের থেকে একটু বেশিই উচ্ছলতা দেখে অপলার কেমন সন্দেহ হয়েছিল। মার কি মন খারাপ? সেটা ঢাকতেই কি এই খুশি খুশি ভান করছে? ভাবতে ভাবতেই অপলা দেখে মা যখন হাসছে না, তখনও তার ছোট ছোট চোখ দুটো বেশ হাসছে। করোনার ভয়, ইদে পুরানো জামা, উৎসবের অভাব কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। ইদের দিন সেই আনন্দ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। অপলা খুঁতখুঁতে মন নিয়ে মায়ের আশেপাশে ঘোরে। মা ঘর থেকে ঘরে ছুটে বেড়ায়, নাতি–নাতনিদের সাথে নিজেও শিশু হয়ে যায়, ব্যাপারটা অপলাকেও আনন্দিত করে।
ইদের রাতে অপলা রান্নাঘরে মাকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করে, “মা, তুমি এত খুশি কেন, সত্যি করে বলো তো?”
মা হেসে বলে, “নজর দিস না তো!”
অপলা বেশ কিছুক্ষণ পীড়াপীড়ি করতেই তিনি বলেন, “প্রতি বছর ইদে তোর আব্বা নামাজ পড়ে বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে চলে যায়। বড় মেয়েটা থাকে তার শ্বশুরবাড়ি। তুই তোর ভার্সিটির বন্ধুবান্ধবের সাথে ফাঁকা ঢাকা শহর দেখতে বের হয়ে যাস। বের হইতে ভাল লাগে না তাই আমি সেমাই, পায়েশ, পোলাও এসব রেঁধে একা একা টিভি দেখি। এইবার দেখ, আমরা সবাই একসাথে! তোর বাবা আর তুই বের হবি না, তোর বোনও এই বাসায় আটকা পড়ল। নতুন জামা নাই, ইদের আমেজ নাই, তবুও আমার জীবনে এমন সুন্দর ইদ অনেকদিন আসে নাই! লকডাউন আর করোনা না থাকলে কি এই আনন্দ পাইতাম বল?”
অপলার চোখে পানি চলে আসে। ভেতরে ভেতরে লজ্জাও হয় কিছুটা। সত্যিই তো! প্রতি বছর ইদের দিন সে ঘুরে ফেরে ঢাকার ফাঁকা রাস্তায়। অথচ মা একা একা বসে থাকে তাদের পথ চেয়ে। কিছু বলে না সে। মন ভরে মায়ের মুখ দেখে নেয়।
আজ পাঁচ বছর পর এই ছন্নছাড়া ট্রেনে জানালার পাশে বসে সেই মুখটা মনে পড়ে। তৃষ্ণায় অপলার গলা শুকিয়ে আসে। মা নেই আর। কিন্তু রোজা শেষে প্রতি বছর ইদ ঠিকই আসে। অপলা মনে মনে ২০২০ এর সেই লকডাউনটাকে কৃতজ্ঞতা জানায়। ট্রেনে বসে তৎকালীন সেই সারা পৃথিবীর শোক আর ব্যক্তিগত আনন্দের উদ্ভট সংকটের মাঝে অপলা ঘুরপাক খেতে খেতে এগিয়ে চলে আরও একটা ইদের দিকে।
ফারিয়া বই পড়তে ভালোবাসে। যেকোন ভাষার সাহিত্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিই তার প্যাশন। আর সে লিখে, যেন একদিন মানুষের গল্পগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে পারে।