রিফাত আহসান সাদাত
‘ইদ মোবারক’ এর শুরুতে কবে থেকে ঈ-এর জায়গায় ই এসে বসেছে সেটা বুঝতেও পারি নি। কিন্তু বানানের মতোই দীর্ঘ দিনের রীতিনীতির বিচ্যুতি ঘটেছে আমাদের জীবনযাত্রায় বিগত কয়েকমাস ধরেই। বন্দী জীবন, বন্ধ ভ্রমণ, থেমে যাওয়া ক্ষণ আমাদের প্রতিটি মানুষের মনেই জন্ম দিয়েছে একই প্রশ্নের। কবে সব আগের মতো হবে?
সময় মানুষকে এক কাতারে এনে দেয়। বর্তমান পরিস্থিতি যেন সেটারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের চিরবিদ্যমান পার্থক্য এখনো উপস্থিত, কিন্তু এই করোনার সময়ে আমাদের একত্রে গেঁথে দিয়েছে মানুষের আত্মত্যাগ। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় হলেও সবাই নিজেদের জায়গা থেকে কিছু না কিছু ছাড় দিচ্ছি। শহুরে বড়লোকের গাড়ি হাঁকানো ছেলে, যার ত্রিশ ইফতারি কাটত ত্রিশ রেস্টুরেন্টে – সেও এখন ঘরে বসে স্বাদ নিচ্ছে বন্দী জীবনের। তবে এই বন্দী জীবনের স্বাদ গরিবদের জন্যে যেন বিলাসিতা। জীবনের ঝুঁকির চেয়েও বড় চিন্তা তাদের পেটের দায়। করোনায় জীবন হারানো অবশ্যই কাম্য নয়, কিন্তু বেঁচে থেকে না খেয়ে দিন কাটানো তো আর চাইলেই সম্ভব নয়।
যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান দুর্গতদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, তাদের একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। ধনী-দরিদ্রের যেই দুটি হাত মেলানোর আদর্শ নিয়ে তারা এগিয়ে চলেছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সমাজের এই দুটি হাতকে সমান করে দেখার শিক্ষা নেবে তাদের থেকেই।
ইদ চলে এসেছে। প্রতিবারের মতোই পবিত্র রমজান মাসের শেষে বছরের অন্যতম আনন্দের উপলক্ষ্য। নিঃসন্দেহে এ বছর সেই আনন্দ উপভোগের পুরোটা সময় জুড়েই বাজবে বেদনার সুর। টিভির স্ক্রলে ভাসতে থাকা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা মোটেও রাঙাতে পারবে না পর্দার উপরের অংশে চলতে থাকা নাটক-সিনেমা বা কোনো আয়োজনকেই।
ইদ যেমন এবছর ভিন্নধর্মী তেমনি রমজান মাসও কেটেছে ব্যতিক্রমভাবেই। প্রতিদিনের ঘরে বন্দী জীবন যেমন বাড়িয়ে তুলেছে মুক্ত হাওয়ার তৃষ্ণা, তেমনি জাগিয়ে তুলেছে জীবন সম্পর্কে ভিন্ন রকমের উপলদ্ধি। এই জীবন কতটা ক্ষণস্থায়ী এবং প্রতিটি মানুষ আমাদের জীবনে কত মূল্যবান তা যেন বুঝিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে।
রমজান ও লকডাউন মিলে আমাদেরকে চারপাশ সম্বন্ধে করে তুলেছে আরও সতর্ক। ভবিষ্যৎ পৃথিবী কেমন হবে সেই উত্তর তো সময় দিবে, তবে এই সময়ের প্রাপ্ত শিক্ষাটুকু আমাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন-ই আনার কথা। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিকালীন সময়ের প্রস্তুতি, তরুণদের কঠিন মঞ্চে লড়াইয়ের জন্যে মানসিক চ্যালেঞ্জ এবং চাকুরিজীবী ও উদ্যোক্তাদের বাস্তবতার রূঢ় আঘাতের জন্যে অনেকটাই তৈরি করে দিয়েছে এই লকডাউন। সাথে রমজানের ধ্বনি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে সৃষ্টিকর্তার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের তাগিদ। করোনা না ছড়ালে কী হত সেটা না ভেবে আমরা বরং কীভাবে এই দুঃস্বপ্নের ইতি ঘটলে জীবনকে একটা অর্থপূর্ণ রূপ দেয়া যাবে সেটা নিয়ে ভাবছি।
এর সাথে ইদের আগমন আমাদের থেমে থাকা সময়টাতে একটু হলেও তুলবে আলোড়ন। তাতে আরোপিত বিধিনিষেধগুলো উঠে না গেলেও, আমাদের স্থবির মানসিকতায় সামান্য দোলা দিয়ে যাবে ঠিকই।
আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রতি, পরিবারকে আরও সময় দেয়ার প্রতি, প্রিয়জনের প্রতি আরেকটু খেয়াল রাখার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – নিজের কাছে আরো একটু দায়বদ্ধ হয়ে ওঠার প্রতিজ্ঞা করি।
ঘরে বন্দী ইদ জ্যৈষ্ঠের বিষণ্ণ বিকেলে নিয়ে আসুক একপাল বসন্তের বাতাস।
রিফাত পৃথিবীটাকে সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে।