তাসনিম জারিন অধীরা
“শুভ, ঘুমোচ্ছিস?”
“না, আম্মা। সজাগ আছি।”
“একটা জিনিস দেওয়ার ছিল।”
আম্মা একটি খাম বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।
“কার চিঠি, আম্মা?”
আম্মা আমার কথার উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেলেন। চিঠিটার উপরে আমার নাম লিখা কিন্তু কে লিখেছে তার নাম ঠিকানা নেই। খামটা ছিঁড়ে কাগজটা হাতে নিয়ে বুকটা ধক করে উঠল।
আব্বার চিঠি!
প্রিয় শুভ,
এই চিঠিটা কবে হাতে পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, তবে তোমার আম্মা তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। আশা করি দিন-মাস-ক্ষণের হিসাবে তুমি কিছুটা সামলে উঠেছ।
এই মহামারী শুরু হবার কিছু আগ দিয়েই আমার শরীর খারাপ করা শুরু করে। কিন্তু পারিবারিক অবস্থার কথা চিন্তা করে কাজ চালিয়ে যাই। আর তোমার চোখেও কেমন এক বিষণ্ণতা দেখতাম, তার কারণটাও জানতে চেয়ে তোমার কষ্ট বাড়াতে চাই নি আমি। হয়তো জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল একটিবার, প্রায়শই এই নিয়ে এক অদ্ভুত অপরাধবোধে ভুগি। তাই এই চিঠিতে তোমার জন্যে আমার কিছু অব্যক্ত কথা রেখে যাচ্ছি, তোমার চলার পথে হয়ত একটা ছোট সম্বল হবে এটা। জীবিত থেকেও কেন জানি বলতে পারি নি, স্বল্পভাষী হওয়াটা মাঝেমধ্যে এক অভিশাপের মতন ঠেকত আমার কাছে।
তুমি আমাকে আমার যৌবনকালের কথা মনে করিয়ে দাও; সেই রাগ, সেই অভিমান, সেই চিরচেনা অল্পস্বল্প কথার আড়ালে লুকানো, সেই প্রচণ্ড আবেগের টুকরো টুকরো প্রকাশ। কিন্তু এইজন্যই তোমার জন্যে আমার বেশ চিন্তা হয়। নিজের প্রতি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কঠোর হয়ো না, আর না নিজেকে আটকে রেখো। তোমার মাঝে উড়াল দেবার শক্তি আছে, মুক্ত আকাশে উড়ে যেও। বাবা হয়েও আমি কেন জানি তোমার খুব কাছে যেতে পারি নি, যেতে পারলে হয়তো জড়িয়ে ধরে তোমাকে এগুলো বহু আগেই বলতে পারতাম৷ তোমার এই রক্তগরম বয়সেই তোমার আম্মাকে ঘরে এনেছিলাম। তুমি একাকী থাকতে পছন্দ কর ঠিক, তবুও বলব কাউকে মনে ধরলে তাকে দূরে সরিয়ে দিও না।
চারপাশে দেখার অনেক কিছু বাকি তোমার, টাকা কিছু জমিয়ে সময়ে অসময়ে দেখে নিও। আমার অনুপস্থিতিটা হয়তো তোমার জীবনকে দায়িত্ব-কর্তব্যের জালে বিষিয়ে তুলবে। তবুও নিজেকে সময় দিও। আর নিজেকে ভালবাসতে ভুলো না।
তোমাদের জন্যে হয়তো বেশি কিছু করে যেতে পারি নি। গাজীপুরের জমিটাই রয়েছে শুধু, তাও এখন পর্যন্ত বিক্রি করতে সক্ষম হই নি। স্বপ্ন ছিল একটা বাড়ি করার, কিন্তু সেটাও করতে পারি নি৷ জায়গাটা বিক্রি করে দেবার জন্যে তোমার চাচাকে বলেছি, সে তোমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করবে। তোমার আম্মাকে দেখে রেখো, সে বড়ই চাপা। একটু বুঝে নিও তাকে। আর তোমার ছোট ভাইটিকে আগলে রেখো।
ভালো থেকো বাবা। তোমাকে মনে কষ্ট দিয়ে ফেললে মাফ করে দিও। অনেক বড় মনের মানুষ হও এই দোয়া করি।
ইতি
তোমার আব্বা
চিঠিটায় যেন আব্বার গন্ধ লেগে রয়েছে। আমি খুব করে চাইছি তা শুষে নিতে। বলতে ইচ্ছা করছে যে – আব্বা, আমার চাপা কান্না পায়, উদ্ভ্রান্ত লাগে নিজেকে, কেন আমাকে নিয়ে গেলেন না? আমি ইদের নামাজ কার সাথে পড়তে যাব, আর কার সাথে কোলাকুলি করব? জানেন আব্বা, তারাবি না পড়লে এখন ভয়ও লাগে না আপনি না থাকায়। আব্বা আমি কি সবকিছু সহজেই মেনে নিচ্ছি? আমি কি আপনাকে ভুলে যাচ্ছি?
কালকে ইদ। আব্বাকে ছাড়া প্রথম ইদ। মানুষটা বুঝতেও দেয় নি কিছু। একদম নীরবে চলে গেলেন। লকডাউনে রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে এত সময় লেগে গিয়েছিল যে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে হয়তো বাইপাস সার্জারিটা অনেক আগেই করা যেত। তাহলে হয়তো আব্বা এখনও থাকতেন এই করুণ নেক্রোপলিসে। এখনও আঁধার নামত এই করুণ শহরে, এখনও হয়তো শীতল নিদ্রায় তলিয়ে যেতেন তিনি, তবুও আরও কিছুক্ষণ তাকে পাশে পেতাম।
আরও কিছু মুহূর্ত, আর কিছুটা সময়।
লেখালেখি তাসনিম জারিনের কল্পনা জগতের একটা ছোটখাটো প্রকাশমাত্র। সে আড়ালে থাকা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাধারণ জিনিস সবার সামনে তুলে আনার চেষ্টা করে এবং নিজেকে ‘চিত্রকল্পী’ হিসেবে আখ্যা দিতে পছন্দ করে।