রৌশনী রাফা মজুমদার
স্মরণকালে যতগুলো ইদের কথা আমার মনে আসে, তার সবগুলো আমি সিলেটে কাটিয়েছি। সিলেটে আমার দাদুবাড়িও না, নানুবাড়িও না, কিন্তু বিশ বছর ধরে সিলেটে থাকতে থাকতে সিলেটকেই আমার নিজের বাড়ি মনে হয়। তাই কোনো ইদের আগে ভিড়বাট্টা-জ্যাম ঠেলে রোজা রেখে আরেক শহরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আব্বু-আম্মুদেরও হত না, আমাদেরও সিলেট ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে ইদ কাটাতে মন চাইত না।
ছোটবেলার ইদগুলোয় আমরা গোসল সেরে নতুন জামা পরে দল বেঁধে পাড়া-পড়শি, বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি বেড়াতে যেতাম। আশেপাশের আন্টিরা সেমাই খেতে খেতে যখন আলমারি থেকে টাকা বের করে ফেরার সময় হাতে সালামি ধরিয়ে দিত। তখন এক বিশ্বজয়ের হাসি চোখেমুখে গলিয়ে পরের বাসায় যেতাম। চাঁদ রাতে পাশের বাসার আপুর পরিয়ে দেয়া মেহেদি, সেই মেহেদি ভর্তি হাত পলিথিনে বেঁধে সারা রাত রেখে দেয়া, ঘুমুতে যাওয়া। তারপর ফজরের সময়ে উঠে পলিথিন খুলে দুরুদুরু বুকে পরীক্ষা করা রাতে ঘুমের ভেতরে মেহেদি লেপ্টে গেল না তো! হাতভর্তি সরিষার তেল মাখিয়ে মেহেদির রঙ পাকাপোক্ত করে তবেই নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
ঘুম ভেঙে উঠেই মায়ের হাতের গুড়ের পায়েশ, পিঠাপুলি সব একটার পর একটা গপাগপ পেটে চালান দেয়া, বাবাদের ইদের নামাজ সেরে ফেরার পর বাবার কাছে সালামি চাওয়া, নতুন জামা পরে সামনে যাওয়ার পর মায়ের সালামি দেয়া, সবকিছুর অনুভূতিই অন্যরকম ছিল। আমার গোলগাল ভাইটা সারাক্ষণ বড় বড় চোখ নিয়ে চারদিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকত। সে তখন খুবই ছোট, বুঝতে পারত না আজকে চারদিকে এতো রঙ-ঢঙ চলছে কেন। শুধু নতুন জামা পরিয়ে দেয়ার পর মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে সেও আমার সাথে বাসায় বাসায় ঘুরতে যাবার বায়না ধরত।
খেলেধুলে গুটিগুটি পায়ে সারা পাড়া বেড়িয়েই কেটে যেত সারাদিন। সন্ধ্যা হলে সবাই মিলে গোল হয়ে বসে টিভির নাটক দেখা চলত। এখনকার মতো হাজারটা চ্যানেল তো ছিল না, হয় চ্যানেল আইতে হুমায়ূন আহমেদের কোন নাটক চলত, নয় একুশে টিভিতে অন্য কিছু দেখতাম। হুমায়ূন আহমেদের নাটক থাকলে সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর নাটকই দেখতাম। রাত হলে আবার কবে ইদ আসবে, আবার কবে এত আনন্দ হবে, সেই হিসাব গুণতে গুণতে ঘুমিয়ে পড়া হত।
অন্যান্য বার সারা মাস জুড়ে গরিব বুয়ারা, দারোয়ানেরা আব্বু-আম্মুর কাছে যাকাত চাইতে আসত। এবার যেহেতু সবই আলাদা; এবার তাই বুয়াদেরকে যাকাত বিকাশ করে দিতে হয়েছে।
এবারের ইদের সবই আলাদা।
এবারের ইদে নতুন কোন জামা নেই, ইদের দিন সকাল পর্যন্ত সবার চোখ এড়িয়ে জামা-জুতা যক্ষের ধনের মতো আড়ালে লুকিয়ে রাখার উত্তেজনা নেই। চানরাতে পাশের বাসার পিচ্চিদের সাথে বসে মেহেদি দেয়ার উৎসব নেই, পিঠে বানানোর আয়োজন নেই, আশেপাশের বাড়িবাড়ি ঘুরে হরেক পদ খাওয়া আর সালামি পাবার ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। টিভিতে নতুন কোনো নাটকও নেই।
হাজার রকম নাইয়ের মাঝেও এবারের ইদটাই সম্ভবত আমাদের সবচেয়ে সত্যিকারের ইদ হবে। এবারই আমরা প্রথম অসহায় মানুষদের কষ্ট তুমুলভাবে উপলব্ধি করতে পারব। এই ইদটা আমাদের সত্যিকার অর্থে ‘সহানুভূতি’ শব্দটার মর্ম শিখিয়ে যাবে।
তাই এই ইদে আমি সকালে ঘুম থেকে উঠেই গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে ছোট ভাইকে ইদী দেব। অনেক নেয়া হয়েছে, এবার আমার দেয়ার পালা। মায়ের সঙ্গে সেমাই বানাতে বসব, বাবা নামাজ থেকে ফিরলে নিজ হাতে সেমাই খাইয়ে দেব। বিকেলবেলা ছাদে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকব। রাতের বেলা সবাই মিলে ইউটিউবে হয়তো হাসির কোন একটা নাটক দেখতে বসব, পুরোনো এলবামগুলো খুলে বসব আর ছোটবেলার ছবিগুলো দেখে দেখে স্মৃতি রোমন্থন করব।
এই ইদ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আলাদা, তবু সেই আলাদার ভিড়েই একটুখানি অতীত এসে ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন সাজানোর সুবর্ণ সুযোগ এনে দেবে।
সবার ইদ সুন্দর হোক।