তাসনিম জারিন অধীরা
“স্যার, খবর কি শুনছেন?”
“কী খবর?”
“ঐ নতুন ছোকরাটা নাকি কাল রাতে বাসায় যায় নি।”
মজনু মিয়ার এই খুচরা আলাপে কিছুটা বিরক্ত হয়েই চুপ করেছিলাম। আমার এহেন অনাগ্রহতে সে আরও ব্যস্ত হয়ে উঠে, ট্রে তে আনা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে সামনের চেয়ারে বসে পড়ে। এত বছর ধরে “দৈনিক জনজীবন”-এ কাজ করে সে খুব ভাল মতো জানে যে আমার কথার উত্তর না দেওয়ার মানে একটাই – তাকে চলে যেতে বলা হচ্ছে। কিন্তু তার এমন আচরণে তার দিকে আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালে সে এমন কথা বলে উঠল যার জন্যে আমি বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না।
ছেলেটাকে নাকি গুম করা হয়েছে!
“স্যার, কথাটা কি সত্যি?”
সিনিয়র এডিটর মোস্তফা কামালের কাছে গিয়েই এই প্রশ্ন করে বসলাম।
“বসো।”
উনি এত ঠাণ্ডা মাথায় কী করে কথা বলছেন আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। তার মানে কি তিনি সব জানেন? জেনেও চুপ করে আছেন?
“দেখ, শিহাব। মাথা ঠাণ্ডা রাখ।”
“ঠাণ্ডা রাখব? একজন মানুষ লাপাত্তা। তার পরিবারের অবস্থাটা চিন্তা করুন। কী এমন হয়েছে? ও তো শেষ ঐ ত্রাণ নিয়ে কী একটা খবরের জন্য কাজ করছিল…”
“হ্যাঁ। মানা করেছিলাম আমি।“
“কেন?”
উনার নীরবতা দেখে আর উত্তর শোনার জন্য বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে বের হয়েই মজনু মিয়াকে ডেকে পাঠালাম।
“ছেলেটা যে নিউজ কভার করছিল তার সমস্ত ডিটেইল আমার টেবিলে আধ ঘণ্টার মধ্যে চাই। তার সাথে কি আর কেউ কাজ করছিল?”
“আরেকজন ছিল, কিন্তু সেও আজকে আসে নি। ফোন দিয়ে বলেছে অসুস্থ।”
“হুম, তার ফোন নাম্বার আর বাসার ঠিকানাটাও দিয়ে যাবে। এখন যাও।”
“জি, স্যার।”
হাতে সব কাগজ পেয়ে যে খুব নতুন তথ্য পেলাম না, তাও না। ত্রাণের পণ্য যথাযথ মানুষকে না দিয়ে কেন নিজেদের জন্য মজুদ করল সেই খবরটা পেয়েই নাকি সে ঘাটাতে গিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে গুম! কোথাও একটা খটকা লাগছে।
ব্যাপারটা সরেজমিনে ঘাটাতে হবে, নাহলে কোন উপায়ই বের করতে পারব না। তার সাথে কাজ করছিল রুমি। তার বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। একজন জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া হয়ে গিয়েছে, কেউ কিছুই করবে না তা তো হতে দেওয়া যায় না।
কলিংবেল বাজতেই একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুলে দেয়।
আমার পরিচয় দিলে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও রুমি অসুস্থ বলে দেখা করতে এসেছি বলায় একটা ছোট কামরায় বসতে বলে রুমিকে ডাকবেন বলে ভেতরে গেলেন।
“স্লামালেকুম স্যার।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তোমার শরীর কেমন এখন?”
“এই তো স্যার, সিজনাল জ্বর। স্যার আপনার আসার দরকার ছিল না।”
“আমি এসেছি কাজে। তুমি শেষ কবে তরুণ ছেলেটার সাথে দেখা করেছিলে?”
এমন প্রশ্ন হয়ত সে যে আশাই করে নি তা তার চেহারাতে জমতে থাকা ঘামের বিন্দু দেখেই বলে দেওয়া যায়।
“গত পরশু রাতে, কেন স্যার? ওর কি কিছু হয়েছে?”
“আমি তো একবারও বলি নি ওর কিছু হয়েছে।”
“তুমি একটা পত্রিকার হয়ে কাজ করছ, এইভাবে মিথ্যা বলা শোভা পায় না। “
“স্যার, বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না।”
“তাহলে বেশ, এখন উঠি। তবে ছেলেটা কাল রাত থেকে বাড়ি ফিরে নি আর তুমি আজ অফিসে আসো নি। পুলিশে জিডিটা করা হলে সবার আগে তোমাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করবে ৷”
“আমি ওকে মানা করেছিলাম স্যার। ওরা সতর্ক করেছিল আমাদের, বাসা পর্যন্ত চলে এসেছিল।”
“ওরা কারা? আর সামান্য এক ত্রাণ নিয়েই বা এত হুমকি ধামকির কী আছে?”
“সামান্য না, স্যার।”
রুমির কথায় একটু সতর্ক হয়ে উঠলাম। সামান্য না? তার মানে আমি যেটা সন্দেহ করছিলাম সেটাই কি ঠিক?
রুমির থেকে সবটা শুনার পর আমি দেরি না করে বেরিয়ে পড়ি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার পথে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে গিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল, হুট করে থেমে যাই। পিছনের মানুষটার পায়ের শব্দও মুহূর্তে থেমে যায়।
পিছু নিয়েছে আমার!
রুমির কথা শুনে আগেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল এরা রুমির বাসায় নজর ঠিক রাখবে। কিন্তু আমাকে তো চেনার কথাই না।
যেভাবেই হোক এদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া লাগবেই। হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত কনকর্ডে ঢুকে গেলাম। ঢুকেই প্রচণ্ড বেগে অপর পাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে রিকশায় উঠে দ্রুত রিকশা টানতে বলে দিলাম।
ভাগ্যের জোরেই এই মুহূর্তে ফাঁকি দিতে পেরেছি ঠিক। কিন্তু পরক্ষণেই ফোনে একটা মেসেজ আসে।
“জানের ভয় যদি থাকে তবে আপনিও চুপ থাকবেন। নইলে…”
মেসেজটা পেয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আমি একটা ফোনকল করি।
সন্ধ্যা সাতটার নিউজের শিরোনামে এই গুম হওয়ার খবরটাও চলে আসে। খবর প্রচারের পর থেকে আমার ফোনে মোস্তফা স্যারের ফোন আসতে থাকে কিন্তু আমি রিসিভ করি নি। পুরানো এক কলিগের সুবিধায় খবর প্রচারের পাশাপাশি পুলিশ থেকেও হেল্প পাই। লোকেশন ট্রেস করে ফেলতে পেরেছে পুলিশ, আর রাতের মধ্যেই উদ্ধার করতে পারবে তরুণকে এই বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছে আর সাথে নিরাপত্তার খাতিরে দুইজন কন্সট্যাবল দিয়ে দিয়েছে।
সকালবেলা ঘুম ভাঙে এক ফোনকলে। রাতেই তারা নাকি তরুণকে খুঁজে পায় অক্ষত অবস্থায়।
কিন্তু কাজ আরেকটি বাকি।
আমি অফিসে গিয়ে মোস্তফা স্যারের রুমে ঢুকে গেলাম সোজা।
“কাজটা আপনার থেকে আশা করি নি, স্যার।”
“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে যা বলার সোজাসুজি বলে দাও।”
“তাকে সতর্ক অন্য কেউ না, আপনিই করেছিলেন যেন এই খবরে না জড়ায়। ঠিক একইভাবে কালকেও আমার পিছনে লোক আপনিই লাগিয়েছিলেন। কারণ ত্রাণের মজুদাগারে ত্রাণ ছাড়াও ছিল অবৈধ নেশাদ্রব্য। যা থেকে একটা ভাল অঙ্কের টাকা আপনি পান।”
“এসব কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না তুমি।“
“আমি তো বলি নি প্রমাণ করব। প্রমাণ তো আপনি করলেন, এই মাত্র।“
আমি হাত দিয়ে আমার পকেটে রাখা ফোনের দিকে ইশারা করায় উনি বুঝলেন উত্তেজনার বশে অনেক বড় ভুল করে ফেললেন।
“কাজটা ঠিক কর নি তুমি।”
“নিচে পুলিশ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। ঠিক–বেঠিক তাদের বুঝাবেন।“
লেখালেখি তাসনিম জারিনের কল্পনা জগতের একটা ছোটখাটো প্রকাশমাত্র। সে আড়ালে থাকা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাধারণ জিনিস সবার সামনে তুলে আনার চেষ্টা করে এবং নিজেকে ‘চিত্রকল্পী’ হিসেবে আখ্যা দিতে পছন্দ করে।