তাসনিম জারিন অধীরা
Polycystic Ovary Syndrome (পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম) – সাধারণ ভাবে পিসিওএস বা পিকোস হিসেবে পরিচিত নারী শরীরের প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত হরমোনাল একটি রোগ। রোগের নাম অনুযায়ী পিকোস বহনকারী নারীর ডিম্বাশয়ে সাধারণত কিছু সিস্ট তৈরি হয়ে থাকতে পারে, আবার অনেক নারীর ডিম্বাশয়ে সিস্ট তৈরি হয় না। তবে অন্যান্য মূল লক্ষণের মধ্যে সেইসকল নারীর অনিয়মিত মাসিক হয়ে থাকে।
পুরুষ প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত হরমোন (অ্যান্ড্রোজেন, টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি) যা প্রত্যেক নারীর শরীরেই সামান্য মাত্রায় উৎপাদন হওয়ার কথা, পিকোস-এর কারণে তা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে মুখমণ্ডল এবং দেহের বিভিন্ন স্থান, যেমন: বুকে ও পেটে ক্রমশ লোম বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও যদি কোন রকম ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে গর্ভাবস্থাজনিত সমস্যার পাশাপাশি ডায়াবেটিস আর হৃদরোগজনিত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ৷
লক্ষণ
পিকোস হলে যেসকল লক্ষণ নারী দেহে দেখা যায়:
১. অনিয়মিত পিরিয়ড
২. দেহে অস্বাভাবিক পরিমাণে পুরুষ প্রজনন হরমোনের উপস্থিতি
৩. ওভারি বা ডিম্বাশয়ে সিস্ট তৈরি হওয়া
৪. দেহের বিভিন্ন অংশে – বুকে, পেটে আর মুখমণ্ডলে অতিরিক্ত লোম উৎপত্তি
৫. অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
কারণ
PCOS (পিকোস) কেন হয় তার নির্দিষ্ট কোন কারণ এখনও জানা যায় নি। দেহের কিছু হরমোনের অস্বাভাবিক মাত্রা আর জিনগত কারণে পিকোস হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়।
- অতিরিক্ত অ্যান্ড্রোজেন: অ্যান্ড্রোজেন মূলত পুরুষ দেহের হরমোন হলেও নারীদেহে তা অল্প পরিমাণে তৈরি হয়ে থাকে। পিকোস বহনকারী নারী দেহে এই হরমোনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, যা অভ্যুলেশন বা ডিম্বস্ফুটনে বাধা দেয় এবং মুখমণ্ডলসহ বুকে ও পেটে লোমের বৃদ্ধি ঘটায়।
- অতিরিক্ত ইনসুলিন: দেহের অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন নামক হরমোন গ্লুকোজ ভেঙে শক্তিতে পরিণত করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পিকোসের কারণে অধিকাংশ নারী যাদের স্থূলতা রয়েছে বা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস রয়েছে, আবার যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে না অথবা যাদের পরিবারের কারো ডায়াবেটিস আছে, তাদের দেহের কোষ ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্ট হয়ে পড়ে; অর্থাৎ কোষ ইনসুলিন ব্যবহার করে না। ফলে দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ইনসুলিন ওজন বৃদ্ধির কারণ হয়ে থাকে। এছাড়াও এর কারণে অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রাও বেড়ে গিয়ে পিরিয়ড অনিয়মিতভাবে হয়ে থাকে।
- জিনগত কারণ: পরিবারের কারো এই রোগ আগে থেকে থাকলে সেই জিন বহন করার কারণেও পিকোস হয়ে থাকে।
পিকোস হলে করণীয়
উপর্যুক্ত লক্ষণগুলির মুখোমুখি হলে অবশ্যই একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ বা হরমোন বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া জরুরি। ডাক্তারের নির্দেশিত ওষুধের পাশাপাশি বাড়িতে কিছু নিয়ম মেনে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করলে পিকোস-এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এর মূল সমস্যাই হল অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে করণীয় হল:
- নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস: সঠিক খাদ্য খাওয়া আর কিছু নির্দিষ্ট খাবার পরিহার করার মধ্য দিয়েই নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস তৈরি করা যায়। আমিষ আর শর্করা জাতীয় খাদ্য সীমিত পরিমাণে খেতে হবে। কেননা এ জাতীয় খাদ্য পরিপাকে কোষের ইনসুলিন ব্যবহার করা প্রয়োজন। উদ্ভিজ্জ আমিষ খেতে হবে, প্রচুর পরিমাণে ফল ও শাকসবজি খেতে হবে। অতিরিক্ত ফ্যাট জাতীয় খাদ্য এবং ফাস্ট ফুড পরিহার করতে হবে।
- ক্যাফেইন পরিহার: ক্যাফেইন গ্রহণে হরমোন মাত্রায় পরিবর্তন আসে। তাই ক্যাফেইনের পরিবর্তে হার্বাল গ্রিন টি খাওয়া উত্তম।
- নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম স্থূলতা নির্মূল করতে অনেক সাহায্য করে। তবে ওজন কমাতে গিয়ে মনে রাখতে হবে যে অতিরিক্ত ব্যায়ামও দেহের জন্য ক্ষতিকর। ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম বাদেও নিয়মিত সাঁতার কাটা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত ঘুম: ঘুম আমাদের সাধারণ স্ট্রেস লেভেলে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি হরমোনের আচরণেও প্রভাব ফেলে। পিকোস বহনকারী নারীদের অধিকাংশেরই নিয়মিত ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। তাই ঘুমের রুটিন মেনে নিয়মিত ছয় থেকে আট ঘন্টা ঘুমানো জরুরি। পাশাপাশি ঘুমের আগে ফ্যাট জাতীয় খাদ্য পরিহার করা উচিত।
- মেডিটেশন: পিকোস-এর ফলে অনেক নারীই বিষণ্নতায় ভুগে, ফলস্বরূপ ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। তাই দুশ্চিন্তা কমাতে মেডিটেশন বা ইয়োগা অনেক উপকারী।
মনে রাখা প্রয়োজন, পিকোস হলে অতিরিক্ত ওজন কমানো খুবই জরুরি। কেননা স্থূলতার কারণে ভবিষ্যতে গর্ভাবস্থায় জটিলতা হওয়ার পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তাই কোন নারীদেহে পিকোস ধরা পড়লে ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী চললে এবং নিয়ন্ত্রিত ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে পিকোস-এর প্রভাব অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
লেখালেখি তাসনিম জারিনের কল্পনা জগতের একটা ছোটখাটো প্রকাশমাত্র। সে আড়ালে থাকা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাধারণ জিনিস সবার সামনে তুলে আনার চেষ্টা করে এবং নিজেকে ‘চিত্রকল্পী’ হিসেবে আখ্যা দিতে পছন্দ করে।