সম্পাদকীয়: মানুষের অধিকারের চেয়ে কিছুই বড় নয়

Editor
9 Min Read

আমরা প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদের খবর পড়ছি, ভয়ে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্রতিবাদী মানুষের উপর পুলিশের হামলা, গাড়ি উঠিয়ে দেয়ার ঘটনা আমাদেরকে হতবাক করে দিচ্ছে, রাগে-কষ্টে-ক্ষোভে আমাদের মাথা ভারি হয়ে আসছে, কিন্তু আমরা কিছু করতে পারছি না।

আমরা সবসময়-ই লেখালেখি নিয়ে থাকতে চাই, এবং এমন একটি অনিশ্চিত সময়ে আমাদের দৌড়ে কলমের কাছে আশ্রয় নিতে ইচ্ছে করে। আমাদের রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার নিচে আশ্রয় নিতে ইচ্ছে করে, যেই রুদ্র এদেশে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে কলম হাতে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা – ‘’সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি’’।

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবাদ একটা ভঙ্গুর সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মানুষের ক্ষোভ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, শুধুমাত্র তখনই দেশজুড়ে এমন প্রতিবাদ গড়ে উঠা সম্ভব। আমাদের সভ্য সমাজের যেই ল’ এন্ড অর্ডার এই মানুষগুলোকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছে, সেই অর্ডার মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের সামনে ভেঙ্গেচুরে বানের জলে ভেসে যাওয়া যে মাত্র সেকেন্ডের ব্যাপার – এই প্রতিবাদ তার প্রমাণ দেয়।

এর মাঝেই কিছু মানুষ ভায়োলেন্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তারা ছিনতাই এবং লুটপাটের বিষয়টি সামনে আনছেন। আমরা মনে করি, লুটপাটের এই ধরনের ঘটনা আন্দোলনের একটা ছোট অংশ, পুরোটা নয়। মব মেন্টালিটি কীভাবে কাজ করে সেটা সাইকোলজির একটা জটিল বিষয়। মানুষ যখন একই জিনিসের ক্ষোভ নিয়ে একসাথে মিলিত হয়, তখন তাদের ক্ষোভ কীভাবে বেরিয়ে আসে, সেটি বোঝা মুশকিল।

আমাদের বাংলাদেশও রক্তাক্ত আন্দোলনের মাঝে গড়ে উঠা দেশ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, এবং স্বাধীনতার পরেও গণতান্ত্রিক অধিকারের উদ্দেশ্যে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে, এই দেশের মানুষ তাদের অধিকারের জন্যে কখনোই হিংস্র প্রতিবাদে ভয় পায় নি, এখনো ভয় পায় না বলেই আমরা ভাবতে চাই।

হ্যাঁ, আমরা বলছি না এই লুটপাট নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য। এতে হয়তো কারো ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে, হয়তো কারো সারাজীবনের সঞ্চয় ধুলোয় মিশে গেছে। এই লুটপাটের পিছে যে মানুষের অসৎ উদ্দেশ্য নেই, সেটা বলাও ঠিক হবে না।

কিন্তু এই মানুষগুলো দিনের পর দিন মুদ্রার উল্টো পিঠটা দেখে এসেছে। এই মানুষগুলো দিনের পর দিন পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এই মানুষগুলোর সারাজীবন ধরে জানতো যে এই দেশে যেকোনো সময়ে তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত কররার ঘটনা ঘটতে পারে, তারা যেকোনো সময়ে বৈষম্যের শিকার হতে পারে। এবং তারা সবসময়-ই জেনে এসেছে যে যদি এমন কিছু ঘটে, তারা আসলে সেটা নিয়ে কিছু্ই করতে পারবে না।

জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনা একটা ট্রিগার পয়েন্ট ছিল। একটা জাগরণের ডাক যেন। এখন এটা একটা অ্যানার্কি। বছরের পর বছর আইন-শৃঙ্খলার নামে চলতে থাকা, সভ্য সমাজের নামে চলতে থাকা বৈষম্য দূর করতে আমরা এটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। একটা ‘আস ভার্সেস দেম’ মানসিকতা নিয়ে চলতে থাকা আন্দোলনে কী হয়, অ্যানার্কিতে কী হয় – সেটা আমাদের সাধারণ সমাজের নৈতিকতার ধারণা দিয়ে বিচার করাটা অহেতুক।

বরং এই যে দিনের পর দিন অবহেলায়, বৈষম্যের মাঝে দিন কাটানো মানুষগুলোর মধ্যে এখন একটি ‘তাদের বিরুদ্ধে আমরা’ মানসিকতা গড়ে উঠেছে, এর পিছে একটা ভঙ্গুর সিস্টেমের দোষ দেখি আমরা, এই মানুষগুলোর নয়।

এই লুটপাটকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলব না। কিন্তু এই অ্যানার্কির প্রয়োজন আমরা অনুভব করি। সব কিছু গুড়িয়ে দেয়ার একটা সময় আসে, যাকে বিপ্লব বলে। সেই বিপ্লব আমাদের সভ্য সমাজের নৈতিকতাকে কোন দাম দেয় না। আমরা মনে করি, দেয়াও উচিত না।

যারা শান্ত প্রতিবাদের কথা বলছেন, মাত্র একদিন আগে হোয়াইট হাউসের সামনে মানুষের শান্ত মিছিলের উপর পুলিশ রাবার বুলেট আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে সরিয়ে দিয়েছে। এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই রাস্তার উপর দিয়ে হেটে সেন্ট জনস্ চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে বাইবেল হাতে ছবি তুলেছেন। মানুষের শান্ত প্রতিবাদের প্রতিও সরকার একই আচরণ দেখিয়েছে, যাতে তাদের প্রেসিডেন্ট ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে দাঁড়াতে পারেন। সিএনএন বলছে, একেবারে শান্ত মানুষের উপর এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্দেশে হয়েছে।

জর্জ ফ্লয়েডের ভাই সাংবাদিকদের বলেছেন, এই হিংস্র প্রতিবাদ তার ভাইকে ফিরিয়ে আনবে না। তিনি মানুষকে থামবার আহ্বান জানিয়েছেন। অনেকে সেটাও উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছেন। জর্জ ফ্লয়েডের পরিবার এই মুহূর্তে প্রচণ্ড শোকাহত। জর্জ ফ্লয়েডকে নিয়ে তার ভাইয়ের শোক আমরা শ্রদ্ধা করি।

একই সাথে আমরা এটাও মনে করি, আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জর্জ ফ্লয়েডের ভাই মানুষের সামনে এসে কী বলেছেন সেটার গুরুত্ব খুবই কম। জর্জ ফ্লয়েড এখন আর কোন পরিবারের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি এখন একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। নির্যাতনের প্রতীক, বৈষম্যের প্রতীক।

সাধারণ জনতার এই বিপুল ক্ষোভ আসলে একজন মানুষের মৃত্যুর কারণে তৈরি হয় নি। এই ক্ষোভের পিছে আরো হাজার হাজার মানুষের মৃ্ত্যু আছে, এই ক্ষোভের পিছে মানুষের অনেক অনেক বছরের বঞ্চনা আছে। একদিনের একটি ঘটনায় এত বিশাল ক্ষোভের উদগীরণ হয় না। একটা সিস্টেমের সর্বোপরি বৈষম্যমূলক আচরণ এর আসল কারণ।

তাই জর্জ ফ্লয়েডের ভাইয়ের মানুষকে থামতে বলা উচিত নয়। এই আন্দোলন জর্জ ফ্লয়েডকে বাঁচিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে নি। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর আনাচে কানাচে যতো জর্জ ফ্লয়েড আছেন, সবার প্রতি বৈষম্য কমানো। যাতে পৃথিবীতে জর্জ ফ্লয়েডের সংখ্যা একটু হলেও কমে, একটা হলেও কমে। মানুষের এখন সেটাই করা উচিত, যাতে সরকার তাদের দাবির সামনে নতজানু হতে বাধ্য হয়। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে। তাতে যদি রক্তাক্ত আন্দোলনের প্রয়োজন হয়, আমরা এই প্রতিবাদের পাশেই থাকতে চাই।

যারা অর্থনীতির কথা বলছেন, তাদের বোঝা উচিত, মানুষের অধিকারের চেয়ে কিছুই বড় নয়। যেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই মানুষগুলোকে দিনের পর দিন অবহেলা করে গেছে, সেই ব্যবস্থা দিয়ে এই মানুষগুলোর কিছুই যায় আসে না, যাওয়া-আসাও উচিত না। আমরা আন্দোলনের এই অংশটাকে কেন্দ্রবিন্দুতে না এনে পিছের কারণগুলোকে দেখতে চাই। আমরা এই প্রতিবাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে চাই।

আমরা মনে করি, এই বিক্ষোভের আমাদের দরকার আছে। মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন পৃথিবীতে ২০১১ থেকে ১৩ সালে রাশিয়ান স্নো রেভ্যুলেশনের পরে আর আসে নি। এরপরে আমরা পুতিনের কর্তৃত্ববাদ দেখেছি, ইন্টারনেট সেন্সরশিপ দেখছি, কিন্তু মানুষের অধিকার আদায় হতে দেখি নি। বিশ্বের নানা প্রান্তে শুধু নির্যাতন বেড়েছে, মানুষের বঞ্চনা বেড়েছে। মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার বুঝে পায় নি।

এর মাঝে আমরা অনেক আন্দোলনকেই জ্বলে উঠতে উঠতে নিভে যেতে দেখেছি। বিএলএফের পাঠকদের কাছে আমাদের অনুরোধ, আপনারা ছোট ছোট বিষয়ে সমালোচনা করে এই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ নিভিয়ে দেবেন না। এই আন্দোলনের শেষ দেখা এখন আমাদের প্রয়োজন, পৃথিবীর প্রয়োজন।

এই পৃথিবীর সব নির্যাতিত মানুষের নাম এখন জর্জ ফ্লয়েড। এই বিপ্লব সারা পৃথিবীর মানুষের অধিকার আদায়ের বিপ্লব। এই আন্দোলন যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদের আরো দশ বছর আরেকটা বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে।

ততদিনে যে এই বৈষম্য আমার কিংবা আপনার অধিকার এবং প্রাণ কেড়ে নিবে না, সেই নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবে?

বিএলএফের জর্জ ফ্লয়েড প্লে-লিস্ট থেকে আরো জানুন এই প্রতিবাদের ব্যাপারে:

০১. আন্দোলনে পুলিশের হামলার চিত্র:

https://twitter.com/explicitxshady/status/1267424684716548097?s=09

https://twitter.com/Faytuks/status/1267897105177358337?s=09

https://twitter.com/jameelajamil/status/1267877210758627328?s=19

https://twitter.com/royalWadadli/status/1267984693233844224?s=19

https://twitter.com/jazz_inmypants/status/1267925372177440769?s=19

https://twitter.com/MekaFromThe703/status/1267638186676834306?s=19

০২. কোনো কোনো প্রতিবাদ কেন হিংস্র হয়ে উঠে, পড়ুন বিবিসির প্রতিবেদনে:

George Floyd death: Why do some protests turn violent?

০৩. আক্রমণাত্মক আন্দোলনের বিরুদ্ধে কেন কথা বলা উচিত নয়:

What we’re missing when we condemn “violence” at protests

০৪. আন্দোলনটি ‘All Lives Matter’ না হয়ে কেন ‘Black Lives Matter’:

Why you should stop saying “all lives matter,” explained in 9 different ways

০৫. বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকানদের বঞ্চনার ইতিহাস:

A Timeline of Events That Led to the 2020 ‘Fed Up’-rising

০৬. আফ্রিকান আমেরিকানদের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র, সিএনএনের রিপোর্ট:

US black-white inequality in 6 stark charts

০৭. প্রতিবাদের উপর সিএনএন এবং ওয়াশিংটন পোস্টের লাইভ আপডেটের লিংক:

Live updates on the protests from CNN

Live updates from the Washington Post

০৮. ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের ওয়েবসাইট:

blacklivesmatter.com

০৯. আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে চাইলে ডোনেট করতে পারেন এখানে:

Split a donation between 70+ community bail funds, mutual aid funds, and racial justice organizers

Donate to Black Lives Matter

Share this Article
Leave a comment