আদনান সহিদ
প্রখ্যাত কলম্বিয়ান কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতে, ”একজন মানুষ বুঝতে পারে কখন সে পরিণত হচ্ছে, কারণ তখন তাকে দেখতে তার নিজ বাবার মতো লাগে।”
আব্বুর সাথে আমার বাহ্যিক মিল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খেয়াল করা হয় নি কখনও। তবে ‘বাবার মত’ দেখাক বা না দেখাক নিজের মাঝে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো আবিষ্কার করতে পারলে যারপরনাই আনন্দিত হব। কারণ এককথায় আব্বু ছিল সৎ, পরিশ্রমী, সহজ-সরল এবং জ্ঞানী। তার সাথে আমার সম্পর্কটা সবসময়ই ছিল ভৌগোলিক অবস্থানগত দূরত্বের অথচ হৃদয়ের খুব কাছের। গত চার বছর ধরে দূর নক্ষত্র হয়েও যেমন আমার দৃষ্টিসীমার খুব কাছেই অবস্থান করছে আব্বু।
সরকারি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির পোস্টিংয়ের সুবাদে ছোটবেলা থেকেই বছরের পর বছর আব্বুকে কাছে পাই নি। একপর্যায়ে দেশের বাইরেও চলে যেতে হয় তাঁকে। স্বাভাবিকভাবেই তার বেশি স্মৃতি জড়ো হওয়ার সুযোগ হয় নি মেমরি লেনে। তবু অল্প কিছু উল্লেখযোগ্য স্মৃতি বিনিময় করছি পাঠকের সাথে।
ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ি। শুক্রবার। জুম্মার নামাজের দিন। প্রচণ্ড বৃষ্টি। রাস্তায় প্রায় হাঁটু পানি উঠেছে। মসজিদে যাওয়ার সময় আব্বু বলল, ”স্যান্ডেলটা খুলে হাতে নাও, পানির জায়গাটা পার হয়ে আবার পায়ে দিও। হাঁটতে সুবিধা হবে।” আমার কিশোর মনে আত্মসম্মানবোধ জেগে উঠল। স্যান্ডেল হাতে নিয়ে কেন হাঁটব? সব মানুষ দেখবে। লজ্জারও ব্যাপার। আব্বু কয়েকবার বলার পর আমি রেগে স্যান্ডেল দুইটা খুলে হাতে নিলাম। তারপর পাঞ্জাবির দুই পকেটে স্যান্ডেল দুইটা ঢুকালাম। আব্বু রেগে গিয়েছিল কি মজা পেয়েছিল বুঝি নি। শান্ত,স্বাভাবিকস্বরে বলেছিল, ”ঠিক আছে, চল।”
ভিনদেশে চাকরিরত অবস্থায় প্রতি মাসেই আমাকে একটা করে চিঠি লিখত আব্বু। আমিও নিয়মিত লিখতাম তাকে। সেই চিঠিগুলোতে আব্বু আমার হাতের লেখা খেয়াল করত। বাংলাদেশে কী করছি, কেমন জ্ঞান অর্জন করছি বুঝতে চাইত এবং নানা ধরনের জিজ্ঞাসা ও পরামর্শ থাকত তার ফিরতি চিঠিতে। সাথে থাকত সুন্দর পোস্টকার্ড, শিক্ষণীয় ছবি ও মজার সব পেপার কাটিং। মনে পড়ে, একবার এক চিঠিতে তার ছাদে পালন করা নানা জাতের কয়েকশ’ কবুতরের ছবি পেয়েছি। কী যে সুন্দর! আর গ্রিনহাউসে নিজ হাতে চাষ করা নানা জাতের সবজির ছবি। প্রবাস জীবনের একাকিত্ব কাটানোর এমন সুন্দর ব্যবস্থা ছিল তার।
আব্বু কয়েক মাসের ছুটিতে যখনই বাংলাদেশে আসত আমাকে নিয়ে জগিংয়ে বের হতো ভোরবেলায়। জগিংয়ের পথে নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করত আর আমাকেও উদ্বুদ্ধ করত সেসব দেখে চিন্তাশীল হতে। ইহলোক ছেড়ে যাবার আগেও যে ক’দিন তাকে কাছে পেয়েছি তখনও বেশ কিছু পরামর্শবাণী ও চিরন্তন কথামালা শুনিয়ে গেছে। কৈশোরে বড়দের ক্রমাগত উপদেশ বা পরামর্শ শুনতে সাধারণত ভাল না লাগলেও ভেবে দেখেছি কেন আব্বু এত কথা বলত, লিখত চিঠিতে কিংবা উপদেশ দিত? আসলে সামনাসামনি দেখা হবার সুযোগের অভাবেই নানা উপদেশ ও কথামালায় দূর থেকে আমাকে অনুপ্রাণিত করার একটা প্রচেষ্টা থাকত তার। জেনারেশন গ্যাপের কারণে মাঝে মাঝে যে তার কথা বা উপদেশগুলো দুর্বোধ্য বা বিরক্ত লাগে নি এমন নয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বুঝেছি সেগুলো আসলে চিরন্তন-সকল যুগের, সকল কালের। আমার উদ্দেশ্যে তার তেমন কিছু উপদেশ ও কথামালা শেয়ার করলাম পাঠকদের সাথে:
১. তোমার পা সবসময় মাটিতে থাকবে। দুইটা কারণে: প্রথমত, তুমি মাটির তৈরি। মাটি ছেড়ে বেশি দূরে অর্থাৎ উপরে উঠে গেলে মানসিক-শারীরিক সুস্থতা নষ্ট হবে। মাটিই ঔষধি। দ্বিতীয়ত, মানুষ যখন হাঁটে একবার মাটিতে পা ফেলে আবার পা তোলে, আবার ফেলে! এটাই হাঁটার প্রকৃত ছন্দ। পা শূন্যে রেখে হাঁটা যায় না। দেমাগ অহংকারে এই ছন্দ নষ্ট করো না। পরে তোমার ‘পা’টাই আর থাকবে না। মাটির অবস্থান ঠিকই থাকবে।
২. আমি তোমাকে বিশ্বাস করি কিন্তু যাচাই করব—এজন্য কিছু মনে করতে পারবে না।
৩. কালি-কলম-মন, লেখে তিনজন (পড়তে বসার সময় স্মরণ করিয়ে দিত)
৪. অর্থের হিসাব করবে, হিসাব রাখবে – এটা তোমার আয়না।
৫. কখনো রাজনীতি করতে চাইলে আগে শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্যারিয়ার ঠিক করবে। রাজনীতি কখনোই আলাদা কিছু না বরং সবকিছু মিলেই একটা ক্যারিয়ার। তোমার শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে রাজনীতি করবে না, ধারে কাছেও যাবে না।
৬. সকাল বেলার (ভোর রাতের) হাওয়া লক্ষ-কোটি রোগের ‘ওষুধ বা দাওয়াই’ হিসেবে কাজ করে। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরতে চাইলে এই হাওয়াটাই গায়ে লাগাতে চেষ্টা করবে।
৭. বাইম মাছ কাদায় চলে, কাদায় থাকে কিন্তু তার পিচ্ছিল গায়ে কাদা লাগে না। অনেক খারাপের মাঝে চলতে গিয়ে বাইম মাছ হয়ে যেও। বিপদমুক্ত থাকবে।
ছোটবেলায় আব্বু আমাকে যে দুজন স্পোর্টসম্যানের গল্প করে সবসময় উৎসাহ দিত আমেরিকান বক্সার মুহাম্মদ আলি তাঁদের অন্যতম। অপরজন ছিলেন স্প্রিন্টার কার্ল লুইস। ১৯৭৩ সালে কেন নরটনের কাছে পরাজয়ের পর মুহাম্মাদ আলী বলেছিলেন, “আমি কখনও হারার কথা ভাবি নি, কিন্তু এবার তাই হলো। আমাদের সবাইকে জীবনে পরাজয়ের স্বাদ নিতে হবে।”
মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে আব্বুকে হারানোই জীবনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পরাজয় মনে হয়েছে। এই পরাজয়ে কিছু সময় জীবন থমকে গিয়েছিল, ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি সময়। প্রসঙ্গক্রমে জনপ্রিয় টিভি সিরিজ গেম অফ থ্রোন্স-এর লেখক জর্জ আর.আর. মার্টিনের কথাটা মনে পড়ল, ”ভয় পাওয়াতে লজ্জার কিছু নেই। বাবা বলেছিলেন, ভয়কে মোকাবেলা করাটাই মুখ্য বিষয়।” আর এই ভয়কে মোকাবেলা করার শক্তি আব্বুর কথা এবং উপদেশগুলো থেকেই খুঁজে নিয়েছি সবসময়। আরও বাতলে নিয়েছি কঠিন পথে সহজে হাঁটার কিছু উপায়।
প্রথম হাঁটতে শিখলে আব্বু আমাকে কার্টুন আঁকা একজোড়া জুতো কিনে দেয়। আমার প্রথম হাঁটার জুতো! প্রায় তিন দশক পরেও সেই জুতোর একটা পাটি সযত্নে রয়েছে আমার কাছে! আরেক পাটি নেই। আজ আমি হাঁটতে পারি, হাঁটি অনেক দূরের উদ্দেশ্যে। হাঁটতে শেখাই, স্বপ্নও দেখাই আমার ছাত্র-ছাত্রীদের। শুধু আমার শিক্ষক,আব্বু নেই আমার পাশে। যেমন আমিও তাঁর পাশে নেই। কিন্তু আমার হারানো এক পাটি জুতো যেন রয়ে গেছে তাঁর কাছেই। জুতোর অন্য পাটিটি হাতে নিয়ে প্রায়ই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্তের মতো বলে উঠতে ইচ্ছে করে, ”আমার এক পাটি জুতো!”
আদনান সহিদ লিখতে অণব ভালোবাসেন। শব্দেরা তার অকৃত্রিম বন্ধু, তার হয়েই কথা বলে। পাঠকেরা সে কথামালায় যোগ দিলে এক ‘আনন্দমেলা’ তৈরি হয় বলে তার বিশ্বাস।