ক্লিং, ক্লিং!
ম্যাসেঞ্জারের নোটিফিকেশনের শব্দে গনির মনোযোগ ভঙ্গ হল — ও বই-খাতা ফেলে ফোনটা হাতে নিল।
হিয়ার ম্যাসেজ – খুলে দেখলো হিয়া একটি লিংক পাঠিয়েছে; “Section 377: India celebrates historic SC verdict।”
নিচে লিখেছে, “দোস্ত, দেখ্ কী চমৎকার!”
গনি কৌতূহলী হয়ে লিংকটা খুলে দেখল। পুরোটা পড়ে জানতে পারল যে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের কুখ্যাত ৩৭৭ ধারাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে যৌন সংখ্যালঘুদেরকে ওদের ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতা দিয়েছে; এই আনন্দে ওরা স্ফূর্তি করছে। ওদের আনন্দোৎসবের ছবি দেখে নিজের অজান্তেই গনির মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে জবাব দিল,
“হ্যাঁ,আসলেই।
So happy :’) ”
গনি এ বিষয়ে পোস্ট করার জন্য ফেইসবুকে ঢুকল, কিন্তু ঢুকে যা দেখল তাতে ওর মতামত প্রকাশের আগ্রহ চলে গেল। খবরটি দাবানলের মতো ছড়িয়েছিল। ততক্ষণে প্রায় সবাই তা জেনে গিয়েছিল, কিন্তু সবার প্রতিক্রিয়া গনির মতো ইতিবাচক হয় নি। “আসিতেছে কিয়ামত”, “Why are you gay :v ”, “এগোর সবডিরে ফাঁসি দেওয়া উচিত”, “জিনার উৎসব করতেসে মালাউনেরা”, “কোনদিন যে বাংলাদেশেও এইসব আইন করে”, “ISIS wants to know your location”, “আইন করে লাভ নাই – যেটা হারাম সেটা হারামই থাকবে” — এসব নেতিবাচক পোস্ট দেখে ও নিরাশ হল; ওর আর কিছু দেখার/বলার ইচ্ছে বাকি থাকল না। ফোন রেখে ও আবার পড়তে শুরু করল, কিন্তু ওর মন খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল। তাই ও আর পড়ায় মনোযোগ দিতে পারল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইটি রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগল, ওর মতো মানুষের প্রতি এদের বিরূপ মনোভাব কি কখনো পাল্টাবে না?
গনি যে সমকামী এ আত্মোপলব্ধি ওর একদিনে হয় নি — হয়েছে ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা ও আত্মান্বেষণের ফলে। ৭ বছর বয়সে ও এক খালুর কাছে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। চকলেট খাওয়ানোর ছলে সেই খালু সবার অজান্তে ওকে একটি অন্ধকার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল; ঐ অন্ধকারই তখন ওর অস্তিত্বকে গ্রাস করেছিল। চকলেটটা গনি আজ অবধি পায় নি; পেয়েছে শুধু এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণার অসহ্য স্মৃতি। অবজ্ঞাত হওয়ার ভয়ে ও বহুদিন অবধি ঐ কথা কাউকে বলতে পারে নি, নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিল ঐ অসহ্য কষ্ট। ৭ মাস পর ও যখন মাকে ঐ কথা বলার সাহস পেল, তখন ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত; ঐ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ওর অনেক থেরাপির প্রয়োজন পড়েছিল। আসলে কী, ও কখনোই ঐ ট্রমা থেকে পুরোপুরি সেরে উঠে নি। কিছু অঘটন মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে। কিছু আঘাত চিরকালের জন্য ওর অস্তিত্বে দাগ কেটে দেয়।
কৈশোরের প্রারম্ভে গনির আত্মসংশয় দেখা দিল — ওর বয়সী ছেলেরা যখন মেয়েদের বিষয়ে রসালাপ করতো, তখন ও চুপ মেরে যেত; বলার মতো কিছু খুঁজে পেত না। ও প্রথমদিকে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিত না। অবশ্য গুরুত্ব দেবার মতো মানসিক পরিপক্বতা তখনো ওর তৈরি হয় নি। কিন্তু স্কুলের কিছু ছেলের প্রতি ওর এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করত। ও নিজেও তা জানত, কিন্তু বুঝত না। ঐ অনুভূতির কোন নাম/সংজ্ঞা ছিল না ওর কাছে, কিন্তু সেটার অস্তিত্ব ছিল। ক্রমেই ঐ আকর্ষণ বাড়তে লাগল — অতি অমার্জিতভাবে। গনির মনোজগতে তোলপাড় হতে লাগল। ঐ আকর্ষণকে ওর মনে হতো অপ্রাকৃত, অস্বাভাবিক, নিসর্গের এক ক্রূর উপহাস; কিন্তু তর্জিত হবার ভয়ে ও কাউকে তা খুলে বলতেও পারত না। ও নিজেকে সংযত করার জন্য ঐ বিষয়ে চিন্তা করাও বাদ দিল, কিন্তু ও নিসর্গের বিরুদ্ধে বেশিদিন লড়তে পারল না। অজান্তেই নিসর্গ ওকে নিজের মতো গড়ে নিচ্ছিল। নিজের সব বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ও একসময় ইন্টারনেটের শরণাপণ্ন হল। এক পর্যায়ে ওর মনে হল, হয়তো অল্প হলেও সম্ভাবনা ছিল যে ও সমকামী, কিন্তু ঐ কথা ভাবতেও ওর ভয় লাগত। সমকাম হারাম – এই ঘৃণার মন্ত্র সর্বক্ষণ ওকে পীড়া দিত। নিজেকে ওর ধর্মভ্রষ্ট পাপীষ্ঠ বলে মনে হত, মনে হত ওর অস্তিত্বই হারাম। ও সবকিছুর জন্য ওর ঐ বিকৃত রুচির খালুকে দায়ী করত। হয়তো তার প্রভাবেই ওর অমন অধঃপতন ঘটেছিল। ও নিজের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনকে এত সহজে মেনে নিতে পারছিল না। আশেপাশের মানুষদের হোমোফোবিক মনোভাব ঐ সহজ সত্যকে স্বীকার করা থেকে ওকে বাধাগ্রস্থ করছিল।
ওর মনের মধ্যে যে এক তুমুল ঝঞ্ঝা হচ্ছিল তা কেউ টের পায় নি, প্রিয় বান্ধবী হিয়া ছাড়া। ও হিয়াকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করত। তাই হিয়া যেদিন গনির হাত চেপে ধরে জানতে চাইল ওর কী হয়েছিল, ও আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কেঁদে কেঁদে হিয়াকে সব কথা খুলে বলল। ও ভেবেছিলো হিয়া বিতৃষ্ণ হয়ে চলে যাবে, কিন্তু হিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল ঠিক উল্টো। সে গনিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আই এম প্রাউড অফ ইউ, দোস্ত। কংগ্র্যাচুলেশন্স ফর ফাইনালি কামিং আউট।” ঐ উষ্ণ আলিঙ্গনে গনির অন্তরে জমাট বাঁধা আত্মঘৃণার হিমশৈল গলে গেল: গলিত বরফগুলি অশ্রু হয়ে চোখ থেকে ঝরে পড়ল।
ঐদিন হিয়ার সঙ্গে গনির দীর্ঘ আলাপ হল। হিয়া অনেকক্ষণ ধরে গনিকে বোঝালো যে মানুষের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন সম্পূর্ণ জন্মগত ও প্রাকৃতিক; এখানে মানুষের কোনো হাত নেই। কেউ স্বেচ্ছায় সমকামী হয় না – হয় জন্ম থেকেই, নিসর্গের নিজস্ব নিয়মে। সমকাম নিসর্গের বিধিবিরুদ্ধ নয়। বস্তুত, জীবজগতের অনেক প্রাণীর মধ্যেই সমকামী প্রবণতা দেখা যায় — ভেড়া, মাছি, হাতি, হাঁস, কপোত, কুকুর, কেশরী ইত্যাদি। মানুষও তো প্রাণী, আর সব প্রাণীর সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন যে এক হবে না, তা অতি স্বাভাবিক। হিয়া ওকে এটাও বোঝাল যে ওর সমকামী হবার পিছনে ওর যৌন শোষকের কোনো ভূমিকা ছিল না – হ্যাঁ, সে যা করেছিল তা অতি ঘৃণ্য একটি অপরাধ; কিন্তু তাতে গনির কোন দোষ ছিল না। সেটা শুধু একটি অঘটন ছিল, আর ঐ অঘটন গনির সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনকে কোনভাবে প্রভাবিত করে নি।
হিয়া আরো বলল যে সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের বৈচিত্র্য কোন নব উদ্ভাবন নয় — পুরাকাল থেকেই নানা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের মানুষ সমাজে বাস করছে, কিন্ত হেটেরোসেক্সিস্ট সমাজের প্রভাবে এরা নিজেদেরকে যথার্থভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। মানুষ এদের ঘৃণা করে কারণ বেশিরভাগ মানুষই বৈচিত্র্যের প্রতি অসহিষ্ণু। তারা যা জানে না, যা বোঝে না, যে বিষয়ে তাদের স্পষ্ট জ্ঞান নেই, সেটাকেই তারা সবচেয়ে বেশি ভয় করে। যারা তাদের মতো নয়, যারা তাদের থেকে ভিন্ন, তাদেরকে তারা সহজে গ্রহণ করতে পারে না। ভয় থেকে ঘৃণা আর ঘৃণা থেকে অসহিষ্ণুতার জন্ম। এ অসহিষ্ণুতার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার জন্যই মানুষ ধর্মকে প্রয়োগ করে। হিয়া গনিকে স্নেহভরে বুঝাল যে ও সমকামী হয়ে কোন দোষ করে নি – ওর প্রাণ আর ৫ জন মানুষের প্রাণাপেক্ষা কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষ ক্রূর হতে পারে, কিন্ত স্রষ্টা ক্রূর নয়; সে তার সৃষ্টির মাঝে বিভেদ করে না। সে সব মানুষকে সমানভাবে ভালবাসে। সব প্রাণই তার কাছে অমূল্য। পাপ-পূণ্যের বিচার তার হাতে; মানুষের এখানে কোন কর্তৃত্ব নেই। তাই গনির মতো মানুষকে ঘৃণা করার কোন হক তাদের নেই। হিয়ার সঙ্গে কথা বলে ও অনেক কিছু জানতে পারল। নিজের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন সম্পর্কে ওর যত ভুল ধারণা ছিল সব দূর হয়ে গেল। অবশেষে ও নিজ সত্যকে স্বীকার করতে পারল। নিজের কাছে নিজেই স্বীকার করল, “হ্যাঁ, আমি সমকামী – এটাই আমার সত্য, আর এতে লজ্জার কিছু নেই।”
গনির আত্মান্বেষণ ঐখানেই থেমে থাকে নি; এরপর ও LGBT+ সমাজ সম্পর্কে আরো বিস্তর গবেষণা করল। ও জানতে পারল যে সমকাম ছাড়াও আরো বহু সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন আছে যেগুলো ও আগে জানত না – ফ্লুয়িড, বাইসেক্সুয়াল, অ্যারোম্যান্টিক, অটোসেক্সুয়াল, অ্যালোসেক্সুয়াল, ডেমিরোম্যান্টিক, বাইরোম্যান্টিক, কিউপিওসেক্সুয়াল ইত্যাদি।
এমন কিছু ব্যক্তির সঙ্গে ওর মৈত্রীও গড়ে উঠল। এছাড়া, হিয়ার কাছে প্রথমবারের মতো কাম আউট করলেও ঐটাই তার শেষবার ছিল না; এরপর আরো কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছেও কাম আউট করেছিল। তারাও হিয়ার মতো ওকে সাদরে গ্রহণ করেছিল, কারণ ওরা অন্যদের মতো সংকীর্ণচিত্ত ছিল না। কিন্তু আফসোস, সকলে গনির বন্ধুদের মতো ছিল না। বস্তুত, ওর অধিকাংশ সহপাঠীই ছিল খুব হোমোফোবিক; এখনো তাই আছে। শুধু ওরা কেন, অধিকাংশ বাংলাদেশিই তো এমন মনোভাব পোষণ করে। এরা খুনী, গুন্ডা, চোর, জোচ্চর, ডাকাত, ধর্ষক ও চাঁদাবাজদের যতটা না ঘৃণা করে, যৌন সংখ্যালঘুদের এর চেয়ে বেশি ঘৃণা করে। এর জন্য দায়ী মূলত ধর্মীয় গোঁড়ামি। ধর্মগ্রন্থের অনুশাসনকে এরা ধ্রুব সত্য হিসেবে গ্রহণ করে; এর নতুন ও যুগোপযোগী কোন ব্যাখ্যা শুনতে এরা নারাজ। শুধু কি তাই? ধর্মগুরুদের প্রভাবও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। সকল ধর্মীয় শিক্ষাকে এরা নির্দ্বিধায় মেনে নেয়; এসব অনুশাসনের ন্যায্যতাকে প্রশ্ন করার কথা ভাবতেও পারে না। ধর্মগুরুরাও এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক শুনতে নারাজ। এভাবেই ধর্মকে যৌন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অস্ত্ররূপে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, গুরুজনদের বিষাক্ত মনোভাবও এর জন্য দায়ী। এটা এমন এক দেশ যেখানে বয়স নির্ধারণ করে কে ঠিক, কে ভুল। গুরুজনরা এখানে দেবতুল্য। ওঁদের শ্রদ্ধা করা আর ওঁদের সব আদেশ নীরবে মান্য করা বাংলাদেশিদের চিরায়ত ঐতিহ্য। এখানে গুরুজনকে প্রশ্ন করা ধৃষ্টতা বলে বিবেচিত। জ্যেষ্ঠ প্রজন্মের এই অবিতর্কিত ক্ষমতার কারণে ওঁদের আজন্মলালিত বিষাক্ত চিন্তাধারা নিয়েই বেড়ে উঠছে এদেশের নতুন প্রজন্ম। এখানেই শেষ নয়, হেটেরোসেক্সিজম এদেশে এতটাই প্রবল যে মানুষ মনে করে সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন শ্বেতাঙ্গদের উদ্ভাবিত একটি প্রচারণা মাত্র, যা এদেশের প্রথাবিরুদ্ধ। এরা মনে করে যৌন সংখ্যালঘুদের একঘরে করে রেখে এরা দেশীয় ঐতিহ্যকে রক্ষা করছে। বস্তুত, বাঙালিদের সোশাল কন্ডিশনিং তাদের অসহিষ্ণুতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। যৌন শিক্ষার অভাবে এদেশের শিক্ষার্থীরা জেন্ডার ও সেক্সুয়ালিটি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারছে না, যার ফলে তারাও এ অজ্ঞানতার সমুদ্রে ডুবে আছে। সর্বোপরি, বৈজ্ঞানিক বিদ্যা ও চিন্তাচেতনার অভাবেই বাংলাদিশিদের মনে হোমোফোবিয়া এত জেঁকে বসেছে।
গনি এসব ভাবতে ভাবতে নিরাশ হয়ে গেছে, এমন সময় হিয়ার আরো ২টি ম্যাসেজ এল:
“Change is coming, dost :’)
দেখিস, আস্তে আস্তে মানুষের পরিবর্তন আসবেই।”
গনির মুখে আবারো হাসি ফুটে উঠল। হ্যাঁ, হিয়া ঠিকই বলেছে — পরিবর্তন আসছে। মানুষের আজন্মলালিত চিন্তাধারাতে আঘাত লেগেছে — LGBT সমাজের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। সমঅধিকারের আন্দোলনে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখন ধীরে ধীরে হলেও পরিবর্তন আসবেই — এই ভেবে গনির চোখ থেকে দু’ ফোঁটা আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।