ফারিয়া রহমান
“রহিম করিম দুই ভাই,
সামনে পাইল মরা গাই,
একজন কয় খাইয়া যাই,
আর’জন কয় নিয়া যাই।”
বোধ সম্পূর্ণরূপে হারানোর ঠিক আগ মুহূর্তে ঋজু যখন শরীর মুচড়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, তখন তার মস্তিষ্কের এক অজানা কোণ থেকে বড় বোন রেশমার কণ্ঠের এই ছড়াখানি ভেসে আসে। শৈশবে মাঠজুড়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এমন সব অর্থহীন ছড়া বলে দুজন খুব হাসত। হাসতে হাসতে ঘাসের ফাঁকে ফড়িং ধরে তা নিয়ে দুজন খেলত। ঋজুর মনে পড়ে এক সন্ধ্যার কথা। একটা ছোট কাচের আয়না, যার পেছনে শাবনূরের ছবি, সেই আয়নায় দেখতে দেখতে ঋজু রেশমার লম্বা চুলে দুই বেণী করে দিচ্ছে।
তারপর রেশমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ঋজু আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, “বুবু, আমার বেণী হইব কবে?”
রেশমা আয়নায় ঋজুর মুখ দেখতে দেখতেই হাসে। বলে, “বড় হইলে একদিন তুই আর আমি দূরে যামুগা। তহন তুই চুল বড় করবি, আমি তর চুলে বেণী কইরা ফুল গুঁইজ্জা দিমু।”
“খেজুর বেণি হইব, বুবু?” ঋজু উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“খেজুর, ফ্রেন্স সব হইব,” রেশমা ঋজুকে আশ্বাস দেয়।
ঋজুর অবিশ্বাস তাও যায় না। সে একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করে, “তুমি পারো নি?”
“পারি না আবার! সব পারি!” রেশমা জোর দেয়। “মাদ্দর বাইত্তে ডাহা থন আফু আইল যেন, হ্যায় দেহাইল না মুবাইলে? আমি একবার দেইখ্যাই শিখ্যা গেসি।“
ঋজু খুশি খুশি কণ্ঠে বোনকে অনুরোধ করে, “আমারে শিগাইবা?”
“শিগামুরে বলদা। আয় লিবিস্টিক দিয়া দেই।” রেশমা ঋজুর হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। “না বুবু! আব্বায় মারব!”
“ধুর! আব্বায় আইজকা আইব না। কই বইয়া তাস খেলতাসে কে জানে।”
“তাইলে আমারে এট্টু শাড়ি পরাইয়া দেও না শাবনূরের মত!”
রেশমা মহোৎসাহে প্যাঁচ দিয়ে ঋজুকে শাড়ি পরিয়ে দেয়। ঋজু নিমুরা নিমুরা গান গেয়ে রেশমার চারপাশ ঘুরে নাচে। রেশমার মনে হয় ঋজু তার ভাই নয়, বোন। এসব স্মৃতি যখন ঋজুর মানসপটে ভেসে ওঠে তখন তার শরীর জুড়ে কতগুলো লোভী আর বর্বর হাত মাকড়সার মত কিলবিল করছে। উল্টো করে শুইয়ে একজন তার মাথা মাটির সাথে চেপে রেখেছে। কোমরের তল থেকে নিম্নাংশে কোন বোধ নেই। ছোট থেকেই “মেয়েদের” মত আচার ব্যবহার করায় গ্রামের সবাই ঋজুকে মাইজ্ঞা বলে সম্বোধন করত। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি, কী অলীক এক সত্য লুকিয়ে রাখছে ঋজু আর তার বোন। ঋজু অসংখ্য বার রেশমাকে জিজ্ঞেস করেছে, “বুবু, আমি এমন ক্যা?” রেশমা প্রতিবারই দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিয়েছে, “আল্লা তরে যেমন বানাইসে তুই হেম্নেই সুন্দর।” ঋজু আবার প্রশ্ন করেছে, “এমনে পলাইয়া আর কয়দিন থাকুম বুবু?” শান্ত রেশমা বলেছে, “দেহিস, আমরা ঠিক একদিন দূরে চইলা যামু।”
কিন্তু তাদের আর যাওয়া হয় নি। আঠারো বছর লুকিয়ে রাখা সত্য একসময় প্রকাশ পায়। ঋজু ভুল করে। বিশ্বাস করার ভুল। একদিন তার বন্ধু পলাশ যখন ফোনে মেয়েদের শরীর দেখতে অস্বীকার করার জন্য ঋজুকে অপমান করতে থাকে, হয়তো ঋজুর ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। আবেগের বশে পলাশকে বলে বসে তার মেয়ে ভালো লাগে না, ছেলে ভালো লাগে। পলাশ এক মুহূর্ত চুপ থেকে হেসে কথাটি উড়িয়ে দেয়।
সপ্তাহখানেক পর ঋজুদের বাড়ির দরজায় টোকা পড়ে, “ঋজু, বাইত আছোস নি?”
ঋজু দরজা খুলে বেড়িয়ে এলে দেখে পলাশ দাঁড়িয়ে আছে। পলাশ বলে, “মাসুমের ভাইয়ের গায়ে হলুদ, যাবি না?”
ঋজু রেশমাকে বলে বারোটার মধ্যেই ফিরে আসবে। কিন্তু ঋজুর আর ফিরে আসা হয় না। তার বাড়ি থেকে মাসুমের বাড়ি যাওয়ার মাঝে কিছু ফসলের ক্ষেত পড়ে। সেই ক্ষেতের মাঝে সরু পথ ধরে কথা বলতে বলতে রাতের আঁধারে দুজন হেঁটে যায়। বাতাসে সবেমাত্র কাটা নতুন ধানের ঘ্রাণ। অর্ধেক চাঁদের আলোয়ে কিছু দূরে আরও চার পাঁচজন মানুষ কিংবা পশুর শরীরের রেখা দেখা যায়। কাছে গেলে চিনতে পারে, আসগর মেম্বারের ছেলে শাকিল, গৃহস্থবাড়ীর ছেলে মনোয়ার এবং তাদের দুইজন বন্ধু। ঋজু কাছে যেয়ে হেসে বলে, “শাকিল ভাই নি? মাসুমগো বাইত যান না?”
শাকিল হাসে। বলে, “হ যামু। পরে যামু।“
ঋজু “আচ্ছা” বলে সামনে এগোতে গেলেই শাকিল থামিয়ে দেয়, “আরে হুন হুন। যাস কই? পলাশের কাছে কী হুনলাম?”
ঋজুর গলা শুকিয়ে আসে। সে অন্ধকারের আলোয়ে পলাশের দিকে তাকায়। পলাশ হাসছে। শাকিল তাড়া দেয়, “কী রে কথা কস না ক্যা? আমগোরেও ক?” শাকিলের কণ্ঠে ব্যঙ্গাত্মক সুর পাওয়া যায়। একজন চিৎকার করে গান শুরু করে, চোলিকে ভিতার কেয়া হে চুনরি কে পিছে…
বাকিদের কেউ কেউ ঋজুর গায়ে চুলে হাত বোলাতে থাকলে ঋজু কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। সে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে, “ভাই আমি তো অইডা ফাইজলামি কইরা কইসিলাম।“
এবার মনোয়ার কথা বলে ওঠে, “হ তো আমগো লগেও কর ফাইজলামি। তর পোলা ভাল্লাগে, তাইলে এমন মোচড়াইতাছস ক্যান? এডি করলে তো তোর আরাম লাগার কথা! হা হা হা!”
বাকিরা সেই হাসিতে যোগ দেয়। তারপর হঠাৎ একজন ঋজুর মুখ চেপে ধরে আরেকটু অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। হাত–পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঋজু চিৎকার করে কাঁদতে চায়। সবাই মিলে তার পরনের শার্ট আর প্যান্টখানা খুলে ফেলে। ঋজুর হয়তো লজ্জা হয় খুব। নগ্নতার লজ্জা নয়, জন্মানোর লজ্জা। সেই লজ্জার প্রখরতায় এক সময়ে আর বোধ থাকে না। আবছা ঘোরে ঋজুর রেশমার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে শৈশবের সব স্মৃতি। একে একে সবগুলো হাত যখন তার শরীর ত্যাগ করে, তখন ঋজু বোধহীন হয়ে পড়ে আছে।
হঠাৎ তলপেটে দুটো লাথি দিয়ে ঋজুর মুখে থু মারে কে যেন। “মাইজ্ঞা শালা!” বলে দলটা আস্তে আস্তে চলে যায়। ঋজুর মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ বের হয়। সে হাত মুঠ করে মাটি আঁকড়ে ধরে মনে মনে নিজের মৃত্যু কামনা করে। একজন ঋজু অভিমান করে পৃথিবীর বুক ত্যাগ করে। নতুন ধান কাটা খোলা মাঠে অর্ধেক চাঁদের আলোয়ে যে নীরবে পড়ে রয়, সে ঋজু নয়, একটি রক্ত মাংসের শরীর মাত্র।
ফারিয়া বই পড়তে ভালোবাসে। যেকোন ভাষার সাহিত্যই তার প্যাশন। আর সে লিখে, যেন একদিন মানুষের গল্পগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে পারে।