তাসনিম জারিন অধীরা
বলিউড ফিল্মের কথা ভাবলেই একটা প্রায় আড়াই ঘণ্টার নাটকীয় গল্পের কথা মাথায় আসে; যেখানে চারটা থেকে পাঁচটা – প্রায় পাঁচ মিনিট দীর্ঘ গানের মধ্য দিয়ে গল্পের শুরু থেকে শেষ পরিচালিত হয়। গল্পগুলোতে প্রেম থাকে মুখ্য, প্রেমের বিরোধিতা করে সমাজ বা পরিবার এবং সেই সূত্রে কিছু দক্ষ স্টান্ট নিয়ে দেখানো হয় মারামারির দৃশ্য। ক্লাইমেক্স দৃশ্যে গিয়ে নায়ক আর নায়িকার মিলন – ঠিক এতটাই সহজে গল্পের মূল বিষয় এবং সমাপ্তি আন্দাজ করে নেয়া যায়।
দর্শকের মাঝে চিন্তার খোরাক জাগাবে কিংবা নতুন কোনো দর্শনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে এমন সিনেমার অস্তিত্ব নব্বই-এর দশকে বলিউডে ছিল না বলেই ধরে নেয়া যায়। তবে ব্যতিক্রম যে নেই এমন নয়। দিপা মেহতার পরিচালিত ফাইয়ার (১৯৯৬) সিনেমাটি বলিউডের গতানুগতিক ধারা থেকে শুধু ভিন্ন-ই নয়, বরং সমাজের সবচেয়ে বিশাল ট্যাবুগুলোর একটিকে বুড়ো আঙুল দেখায়।
১. ফাইয়ার (১৯৯৬)
১৯৯৬ সালে প্রকাশিত সিনেমাটিতে সিতা এবং রাধা দুইজন নারীর গল্প বলা হয়, যারা তাদের স্বামীর সাহচার্য থেকে বঞ্চিত। একই বাড়িতে সম্পর্কে ভাবী–ননদ হলেও তাদের মাঝে ভালবাসার সম্পর্ক সমকামিতায় রূপ নেয়। রামায়ণে সিতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল তাঁর শুদ্ধতা প্রমাণের জন্য। সিতা সফলও হয়েছিলেন। ঠিক তেমনই রাধার সাথে সিতার সম্পর্কে যে কোন ভুল নেই, বা সমকামিতা যে কোন পাপ নয় বরং অন্য সব ভালবাসার সম্পর্কের মতো এটিও পবিত্র, তা শেষ দৃশ্যে খুবই সুনিপুণভাবে দর্শকের কাছে উপস্থাপন করতে পরিচালক সফল হন।
২. মাই ব্রাদার নিখিল (২০০৫)
নতুন শতকের শুরুতে মাই ব্রাদার নিখিল ছিল একই রকম আরেকটি মুভি। এই মুভির সাহায্যে অনেকেই তাদের নিজ পরিবারের কাছে আত্মপ্রকাশ করে। মুভিটিতে জুহি চাউলা অভিনীত অনামিকা চরিত্রের ভাই নিখিলকে এইচআইভি পজিটিভ হিসেবে পাওয়া যায়। একই সাথে তার সমকামিতার কথা সকলের কাছে প্রকাশ পায়। সমকামী হওয়ার কারণে ঈশ্বর তাকে শাস্তিস্বরূপ এইডস দিয়েছে – তাকে নিয়ে এমন ধারণা ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমাজে। কাহিনী বর্ণনা কিছুটা দুর্বল লাগলেও পরিচালক সমকামীদের জীবনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতাগুলো দর্শকদের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
৩. হানিমুন ট্রাভেলস্ (২০০৭)
মুভিটিতে ছয় জোড়া নববিবাহিত দম্পতির হানিমুনের কাহিনী চিত্রায়ণ করা হয়। মুভিতে দেখানো হয় যে সমাজ ও পরিবারের চাপের কারণে অনেক সমকামীই বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি অনেকেই বিয়ের পরও তার যৌন আকাঙ্ক্ষা যে ভিন্ন, তা উপলব্ধি করে। কিন্তু নিজের পরিচয়কে মেনে নেয়ার সাহস জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়, নিজের মনোঃকামনাকে পাথর চাপা দিতে বাধ্য হয় সমাজের ভয়ে। পারিবারিক জীবনে তো তারা সুখী থাকতে পারে-ই না, বরং এক ধরনের অনুশোচনা তাদের সারাজীবন তাড়া করে বেড়ায়।
৪. বোম্বে টকিস (২০১৩) – আজিব দাস্তা হে য়ে
করন জোহার, জোয়া আখতার, দিবাকর ব্যানার্জি এবং অনুরাগ কাশ্যাপ পরিচালিত বোম্বে টকিস (২০১৩) মুভিতে সমকামী মানুষের গল্প দেখা যায় করন জোহার পরিচালিত অংশ আজিব দাস্তা হে য়ে তে । সমকাম বিরোধী পিতার প্রহারে বেড়ে উঠা অভিনাশ তার সহকর্মী গায়িত্রির বাসায় একদিন দাওয়াতে যায়। সেখানে অভিনাশ গায়িত্রির স্বামী দেবের দেখা পায় যে নিজেও সমকামী কিন্তু তখনও আত্মপ্রকাশ করে নি। পরবর্তীতে অভিনাশ এবং দেবের মাঝে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠে এবং দেব নিজের আত্মপ্রকাশ করতে সমর্থ হয়।
৫. মারগারিটা উইথ আ স্ট্র (২০১৪)
সোনালি বোস পরিচালিত এই মুভিতে কালকি কেকলা সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত লাইলা নামক চরিত্রে অভিনয় করেন। যার নিজের শারীরিক অপারগতা থাকা সত্ত্বেও অন্য সবার মতনই যৌন চাহিদা তৈরি হয় এবং সময়ের সাথে সাথে নিজের উভকামিতাকে সে উপলব্ধি করে। শুরুতে দ্বিধাবোধ করলেও পরবর্তীতে সে নিজেকে গ্রহণ করে নিতে সক্ষম হয়।
৬. আলিগড় (২০১৫)
মুভিটি আলিগড় ইউনিভার্সিটির প্রফেসর সিরাসের জীবনকাহিনী নিয়ে তৈরি। মূলত তার সমকামিতার জন্য তাকে চাকরি থেকে মূলতবি রাখা হয় এবং সমাজে তাকে প্রচণ্ড মানসিক এবং শারীরিক হয়রানির শিকার হতে হয়। মুভিটির মধ্যে দিয়ে সমাজের এক ঘৃণ্য স্বভাবের বাস্তবিক দৃশ্য পরিচালক হানসাল মেহতা তুলে ধরেন।
৭. ডিয়ার ড্যাড (২০১৬)
তানুজ ভ্রামারের পরিচালিত এই প্রথম মুভিতে নিতিন এবং শিভাম, বাবা–ছেলের মাঝে একটা রোড ট্রিপ দেখানো হয়। যাত্রার মূল উদ্দেশ্য শিভামকে তার বাবা–মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া নিয়ে জানানো। তবে যাত্রাপথে শিভাম তার বাবা-মার বিচ্ছেদের পাশাপাশি তার বাবার সমকামিতা নিয়ে জানতে পারে। সত্য জেনে তাদের দুইজনের মাঝে দ্বন্দ্ব বিরোধের মধ্য দিয়ে গল্পটি সামনে এগোয়।
৮. কাপুর এন্ড সান্স (২০১৬)
গতানুগতিক ফ্যামিলি ড্রামার একদম যুতসই উদাহরণ কাপুর এন্ড সান্স (২০১৬) মুভিটি। স্বামী–স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া, তাদের দুই ছেলের মাঝে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব–বিবাদের আবহচিত্রের পাশাপাশি বড় ছেলের সমকামিতা মায়ের সামনে চলে আসলে সেটা নিয়ে একরকম তিক্ততা বুঝিয়ে দেয়—এখনও এই বিষয়টা বদ্ধ দরজার আড়ালেই পড়ে থাকে। একইসাথে পরিবারের কাছে সমকামীদের আত্মপ্রকাশের জন্য যে মানসিক সমর্থন দরকার সেটা যে এখনো আমাদের সমাজে অনুপস্থিত—এই সিনেমাটি তা জানিয়ে দেয় ।
৯. এক লাড়কি কো দেখা তোহ অ্যায়সা লাগা (২০১৯)
ভারতে সেকশন ৩৭৭ বাতিল হওয়ার পর সমকামিতা নিয়ে তৈরি এই মুভিতে একটা সাধারণ মেয়ের গল্প বলা হয়। মেয়েটির নিজের বিয়ে নিয়ে ছোট থেকে অনেক স্বপ্ন থাকলেও বিয়ের সময়ে সে নিজের সমকামিতা উপলব্ধি করে৷ তার বাবা শুরুর দিকে বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ না করলেও পরবর্তীতে উপলব্ধি করেন যে মেয়ের ভিন্ন সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন মেয়ের প্রতি তার স্নেহ–ভালবাসাকে কমিয়ে দিতে পারে নি৷
১০. শুভ্ মাঙ্গাল যেয়াদা সাভধান (২০২০)
আয়ুশ্মান খুরানা এবং জিতেন্দ্র কুমার অভিনীত শুভ্ মাঙ্গাল যেয়াদা সাভধান মুভিতে কার্তিক আর অমিতের সম্পর্কের কথা পরিবার জানতে পারলে অমিতকে নানানভাবে তার মতের বিপরীতে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। তাকে ‘সমাজ কি ভাববে’ সেটা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করা হয়। এছাড়াও মুভিতে অত্যন্ত হাস্যরসাত্মকভাবে সমকাম ভীতি বা বিরোধিতাকে মানসিক অসুস্থতা হিসেবে দেখানো হয়।
বলিউডে ধীরে ধীরে সমাজের এই সমকাম-ভীতি বা বিরোধিতা নিয়ে তৈরি সব মুভি এক নতুন দিকের উন্মোচন করে। এসব সিনেমা একইসাথে এই ট্যাবুকে উৎখাতে সাহায্য করার পাশাপাশি দর্শকদের মাঝে নিজেকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করতে সাহায্য করে। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে ভয় না পেয়ে যে ভারতে পরিচালক এবং অভিনেতারা এসব ট্যাবু ভাঙতে কাজ করছেন, তা নতুন দিনের আশা দেখায় মানুষকে।
লেখালেখি তাসনিম জারিনের কল্পনা জগতের একটা ছোটখাটো প্রকাশমাত্র। সে আড়ালে থাকা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাধারণ জিনিস সবার সামনে তুলে আনার চেষ্টা করে এবং নিজেকে ‘চিত্রকল্পী’ হিসেবে আখ্যা দিতে পছন্দ করে।