একজন নির্বোধ যুবক

Editor
8 Min Read

সৈয়দ নাফিস কামাল


আমাদের গল্পটি একজন গ্রাম্য যুবককে নিয়ে। গল্পটি হতে পারে যুবকের সাহস কিংবা নির্বুদ্ধিতার। বস্তুত সাহস এবং নির্বুদ্ধিতা পরস্পর সম্পর্কিত। নির্বোধেরা প্রায়ই সাহসী হয় এবং সাহসীরা প্রায়ই নির্বোধ হয়।

আমাদের গ্রাম্য যুবক, যার নাম আলফাজ, যে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিশেষ ঘটনা না ঘটলে যে আর দশটা ছেলের মতো চাষবাস করে জীবন কাটিয়ে দিত এবং বছর বছর সন্তান উৎপাদন করে মানবসম্পদ বৃদ্ধিতে অবদান রাখত, ওই বিশেষ ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ে সে এই মুহূর্তে কিঞ্চিৎ অসুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বিশেষ ঘটনাটির নাম মুক্তিযুদ্ধ।

গল্প শুরু হবে একটি মিলিটারি বেইজ ক্যাম্পে। একটি আধো-অন্ধকার রুম। রুমের মাঝখানে একটি টেবিল, যার একপ্রান্তে আলফাজ এবং অন্য প্রান্তে একজন কঠিন চেহারার পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেনের চেহারায় অপরিসীম বিরক্তি। দেশে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে পূর্ব পাকিস্তানে এসে হিন্দুয়ানী বাঙালিদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব পেয়ে তিনি খুশি হতে পারেন নি। ইঁদুর মেরে হাত গন্ধ করার মতো ব্যাপার।

তার সামনের বাঙালি যুবকটি অত্যন্ত নির্বোধ শ্রেণির বলে ক্যাপ্টেনের ধারণা। যুবকের চোখেমুখে নির্বুদ্ধিতার ছাপ। ক্যাপ্টেন মোটামুটি নিশ্চিত এই যুবক নিজের বুদ্ধিতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় নি, কোন মালাউনের বাচ্চা মালাউন তার ব্রেইনওয়াশ করে তাকে এই রাস্তায় নামিয়েছে।

“ক্যাম্প কাঁহা হ্যায় তুমলোগোকা?”

আলফাজ মাথা তোলে। তাকে দেখে মনে হয় সে প্রশ্নটি বুঝতে পারে নি। ক্যাপ্টেন আবার প্রশ্ন করেন। আলফাজ নিরুত্তর। 

অফিসার ব্যস্ত হলেন না। তিনি মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ আদায় করতে জানেন। তিনি আরো জানেন আধুনিক যুদ্ধ কেবল ঢাল তলোয়ারের যুদ্ধ নয়। আধুনিক যুদ্ধ মস্তিষ্কের যুদ্ধ। তিনি আলফাজকে প্রস্তাব দেন, তার ট্রুপকে আলফাজের ক্যাম্পে নিয়ে যেতে হবে। তার সহযোদ্ধাদের নামধাম জানাতে হবে। বিনিময়ে মুক্তি পাবে আলফাজ। না হলে তাকে মেরে ফেলা হবে। তবে তা বুলেটচালিত সহজ মৃত্যু নয়। চেতনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে এমন মৃত্যু। সহজ ও শান্ত কন্ঠে ব্যাখ্যা করেন ক্যাপ্টেন।

ক্যাপ্টেনের সহজ সরল ব্যাখ্যা আলফাজকে আলোড়িত করে। তার মন ছুটে যায় কালের সীমানা পেরিয়ে আঠারো-উনিশ বছর আগের এক সময়ে।

বাবার সাথে কাশিমপুরের মেলায় গিয়েছিল ছয় বছরের শিশু আলফাজ। বাবার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল সে। একসাথে এত মানুষ আগে কখনো দেখে নি আলফাজ। হঠাৎ করে টের পেল, বাবা সাথে নেই। চারদিকে এত মানুষ, কিন্তু তার বাবা নেই। এত কাল আগের ঘটনা পুরোপুরি মনে রাখা সম্ভব নয়, তবে সে তীব্র ভয়টুকু টের পায় আলফাজ। মহাপুরুষেরা ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে। আলফাজ মহাপুরুষ নয়। সে অতি সাধারণ একজন মানুষ। শুধু কী এক নেশার ঘোরে ওঠে পড়েছে যুদ্ধ নামক আজব এক রেলগাড়িতে। এই রেলগাড়ির স্টেশন কোথায় কারো জানা নেই।

আলফাজের ভয় কি ক্যাপ্টেন টের পান? তার মুখে ক্রুর এক হাসি ফুটে ওঠে। 

“বোলো, মঞ্জুর হ্যায়?”

আলফাজ নিরুত্তর।

ক্যাপ্টেন ভাবেন, একটু আগেই যে তিনি আলফাজের চেহারায় ভীতির সঞ্চার দেখেছিলেন, সেটা কি ভুল ছিল? তিনি আবার আলফাজকে বোঝাতে উদ্যত হন। আলফাজের বয়স কম। তার সামনে সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ রয়েছে। কেন তাকে খামোখা প্রাণ দিতে হবে?

আলফাজ নিরুত্তর।

ক্যাপ্টেন বিচলিত হলেন না। সব রোগের চিকিৎসা আছে। শুধু প্রয়োগ করা জানতে হয়। তিনি ইশারায় পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুবেদারকে ডাকেন। সুবেদার এসে স্যালুট ঠুকে দাঁড়ায়। ক্যাপ্টেন তাকে কিছু একটা নির্দেশ দিয়ে সেই আধো-অন্ধকার রুম থেকে বেরিয়ে যান।

সুবেদারের চেহারা ক্যাপ্টেনের থেকেও কঠিন। তার চেহারায় একটা জল্লাদ জাতীয় ভাব আছে। একটু পর সে যে কাজটা করতে যাচ্ছে তাতে বোঝা যাবে শুধু তার চেহারা মতো নয়, তার মনও জল্লাদের মতো। এটিকে কোন নেতিবাচক চিত্রায়ন ভাববেন না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যুদ্ধে কিছু দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য জল্লাদ জাতীয় চরিত্রের প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং সে যে এখন আলফাজ নামক হতভাগ্য এক যুবকের হাতের দশটি আঙুল ভেঙে গুঁড়ো করে দিতে যাচ্ছে তা সম্পন্ন হলে মানসিক দৃঢ়তার জন্য তার একটা হাততালি প্রাপ্য।

সুবেদারের ‘মুক্তি কাঁহা হ্যায়’ চিৎকার, হাতুড়ির আঘাত এবং আলফাজের আর্তনাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে যে বীভৎস পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা থেকে একটু দূরে আসা যাক। আমরা বেরিয়ে আসি সেই আধো-অন্ধকার ঘর থেকে। ক্যাম্পের বাইরে ক্যাপ্টেন সাহেবকে দেখা যাচ্ছে ধূমপান করতে। আমাদের এই পাক অফিসার সচরাচর ধূমপান করেন না। নার্ভ দুর্বল হয়ে পড়লে করেন। আজ নার্ভ দুর্বল করার মতো কোন ঘটনা ঘটে নি, তবু তিনি ধূমপান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন।

ক্যাপ্টেন একজন কাব্যপ্রেমী মানুষ। অস্ত্র আর কবিতার যে চিরায়ত সংঘাত, তা তাকে কিছুটা পীড়িত করে। এই মুহূর্তে তিনি পাকিস্তানের বিপ্লবী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের একটি শায়ের আবৃত্তি করছেন। শায়েরটি এমন–

“ঔর ভি দুখ হ্যায় জামানে মে মোহাব্বাত কি সিভা /

রাহাতে ঔর ভি হ্যায় ভাসল কি রাহাত কে সিভা।”

যার অর্থ – ভালবাসার দুঃখ ছাড়াও পৃথিবীতে আরও দুঃখ রয়েছে, মিলনের আনন্দ ছাড়াও পৃথিবীতে আরও আনন্দ রয়েছে। 

ঠিক কী কারণে ক্যাপ্টেনের মনে এই গভীর ভাবের জন্ম হয়েছে তা বলা শক্ত। তবে এমনটা তার প্রায়ই হয়। হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে করে ঊর্দি আর বন্দুক ফেলে দিয়ে ভারতীয় সন্ন্যাসীর মতো হিমালয়ে চলে যেতে। মিলনের আনন্দ ছাড়াও পৃথিবীতে যে আরও আনন্দ আছে, তার সুলুক অনুসন্ধান করতে।

দু’ঘন্টা পর যখন ক্যাপ্টেন অন্ধকার ঘরটিতে ঢুকলেন তখন টেবিলে প্রচুর রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে। বুটের শব্দে মাথা তোলে আলফাজ।

“কুছ ত্যার কিয়া? কুছ বাতাওগে ইয়া নেহী?”

আলফাজ নিরুত্তর। ক্যাপ্টেনের সন্দেহ হয় – ভাষাগত কোন সমস্যা হচ্ছে কি? সন্দেহ দূর করতে তিনি ডেকে পাঠান এক বাঙালি অনুচরকে। সে এসে প্রশ্ন তর্জমা করে শোনায় আলফাজকে।

আলফাজ নিরুত্তর।

বাঙালি অনুচরটি এবার বলে, “কইয়া দে ব্যাটা। কইয়া দে। হিন্দু মালাউনদের লাহান কাম কইরা জাহান্নামি হইস না।”

এবার এক চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটে। আলফাজ একদলা থুথু ছুঁড়ে দেয় অনুচরটির মুখে। এই আকস্মিক ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়ে অনুচরটি। তবে ক্যাপ্টেনের সামনে কিছু করতে সাহস পায় না সে। 

ক্যাপ্টেন মনে মনে পুলক অনুভব করেন। তার মনে হয় এইসব ইতর শ্রেণির কাপুরুষদের সাথে এমনই হওয়া উচিৎ।

আলফাজ চোখের সামনে একটি গ্রাম দেখতে পায়। সেই গ্রামে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। পুড়ছে মানুষ, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু। ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে আকাশ। আলফাজদের টিনের বাড়িটা ভেঙে পড়েছে। কাছে যেতেই প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। আলফাজ জানে কীসের দুর্গন্ধ। তবু সে এগিয়ে যায়।

“সুবেদার, ইসকো লে যাও।”

ক্যাপ্টেনের কন্ঠে সম্বিৎ ফেরে আলফাজের। কোথায় নিয়ে যাবে, কেন নিয়ে যাবে – এসব প্রশ্ন তাড়িত করে না তাকে। তার খোলা আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে। বিগত তিনদিন যাবৎ সে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ায় নি। তার গ্রামের আকাশের মত পরিচ্ছন্ন খোলা আকাশ।

 

আলফাজের মাথার কয়েক হাত পেছনে রাইফেলের সেফটি লিভার চেঞ্জ করার শব্দ তার কানে যায় না। তার দুই চোখ অধীর আগ্রহে এক আকাশ খুঁজছে। যে আকাশে ভয় আর আতঙ্কের কালো মেঘ নেই। ফসল কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে মাঠে শুয়ে পড়লে যে আকাশ দেখে ক্লান্তি কেটে যায়।

 


নাফিস লিখতে ভালোবাসে এবং তার লেখার মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে চায়। 

Share this Article
Leave a comment